You dont have javascript enabled! Please enable it! শত্রুর চোখে মুক্তিযুদ্ধ | ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী - সংগ্রামের নোটবুক

শত্রুর চোখে মুক্তিযুদ্ধ
ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী
=================
ব্রিগেডিয়ার আবদুল রহমান সিদ্দিকী ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আন্তবাহিনী তথ্য সংযােগ (আইএসপিআর) বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যকার আলােচনা প্রচারের জন্য ১৬ মার্চ তিনি ঢাকায় আসেন। তিনি ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন। সেই দিনগুলাের স্মৃতি নিয়ে ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী ইস্ট পাকিস্তান : দ্য এন্ডগেম-এন অনলুকারস জার্নাল ১৯৬৯-১৯৭১ (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৫) নামে একটি বই প্রকাশ করেন। বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ নিচে দেওয়া হলাে।
আওয়ামী লীগ ২৩ মার্চ প্রতিরােধ দিবস পালনের ডাক দেয়, যদিও দিনটি সরকারিভাবে পাকিস্তান দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। ঘুমন্ত বাঘ’ মওলানা ভাসানী তাঁর সন্তোষের বাসস্থান থেকে একে স্বাধীনতা দিবস’ বলে ঘােষণা দেন। একটি সাধারণ বিস্ফোরণের আশঙ্কা ছিল। ওই দিন প্রেসিডেন্টের রীতিমাফিক পাকিস্তান দিবসের বাণী দেওয়ার কথা। জেনারেল পীরজাদা ২২ তারিখে রােয়েদাদকে [রােয়েদাদ খান, পাকিস্তানের তথ্যসচিব] ডেকে বাণীর খসড়া তৈরি করতে বলেন। এক অশুভ লক্ষণ দিয়ে ২৩ মার্চ সূচিত হলাে, যত দূর দেখা যায়, বাড়ির ছাদে কালাে পতাকার পাশাপাশি নতুন তৈরি বাংলাদেশের। পতাকা উড়ছে। শুধু সেনানিবাসের ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউস, দ্বিতীয় রাজধানীর সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দপ্তর ও প্রেসিডেন্ট ভবনে পাকিস্তানি পতাকা। দেখা যায়। এ ছাড়া মােহাম্মদপুর ও মিরপুরের বিহারি-অধ্যুষিত এলাকায়ও ভবনশীর্ষে একগুচ্ছ জাতীয় পতাকা উড্ডীন দেখা যায়। অন্যান্য সরকারি ভবনে বাংলাদেশের পতাকার পাশে জাতীয় পতাকা ওড়ানাে হয়।
পৃষ্ঠা: ৪৪
সব গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক মুজিবকে মহান জাতীয় নেতা হিসেবে অভিনন্দিত করে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। পতাকায় বাংলাদেশের অবয়বসংবলিত প্রাণবন্ত ও সুস্পষ্ট রেখাচিত্রের পটভূমিকায় পাকিস্তানের প্রতিচ্ছবি বরং অনেকটা স্লান ও অস্পষ্ট মনে হলাে। নতুন পতাকাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। মুজিবের বাড়ি একটি তীর্থস্থানে রূপ নিল, যেখানে শতসহস্র মানুষ দলে দলে এই মহান। নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে গেল। স্টেডিয়ামের বাইরে বায়তুল মােকাররম চত্বরে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ জি ওসমানী সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক বাঙালি সদস্যদের নিয়ে এক সমাবেশের আয়ােজন করলেন।
দ্রুত হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঘুরে অশান্ত ও বিষাদগ্রস্ত মনে মেসে ফিরে রােয়েদাদের কক্ষে গেলাম। প্রেসিডেন্টের পাকিস্তান দিবসের বাণীর যে খসড়া তিনি করেছিলেন, তা বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করে জেনারেল পীরজাদা [মে. জেনারেল এস জি এম এম পীরজাদা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল] অনুমােদন করায় তিনি খুশি। আমরা পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করলাম এবং একমত হলাম যে তা ভালাে না এবং দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রােয়েদাদ সামরিক বাহিনীর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষপাতী।
সন্ধ্যায় আমরা আবার মিলিত হয়ে একসঙ্গে দীর্ঘ পথ হাঁটলাম। ঢাকা টিভি (পূর্বতন পিটিভি) ঘােষণা করেছে যে তারা জাতীয় পতাকা প্রদর্শন এবং জাতীয় সংগীত বাজিয়ে অনুষ্ঠান শুরু বা শেষ করবে না। এটা আমাদের ধৈর্যের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে গেল এবং জাতীয় পতাকার প্রতি এ রকম নির্লজ্জ ভঙ্গিতে অসম্মান প্রদর্শন আমাদের ক্ষুব্ধ করল। মিডিয়ার ব্যবস্থাপনা বাঙালি কর্মচারীদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। তারা সবাই একদল ‘বিশ্বাসঘাতক’। উত্তপ্ত বাদানুবাদের পর শেষ পর্যন্ত টিভি কর্মচারীরা মধ্যরাতের এক মিনিট পর জাতীয় পতাকা দেখাতে রাজি হয়। সুতরাং সম্প্রচার সময় দু-তিন মিনিট বাড়িয়ে নিত্যদিনের মতাে জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হলাে—যখন প্রকৃতপক্ষে ২৪ তারিখের প্রত্যুষ।
সকালের নিয়মিত সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে যাওয়ার পথে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে ইয়াহিয়াবিরােধী স্লোগানদানরত একদল উচ্ছল তরুণ আমাকে ঘিরে ধরে। জনতা ক্রোধান্বিত ছিল এবং ইতিপূর্বে মুজিবের বাড়ির বাইরে দেখা জনতার আচরণের সঙ্গে এটা তীব্র বৈসাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। আমি পােশাক পরিহিত অবস্থায় তারকাখচিত নম্বরফলকযুক্ত গাড়িতে বসে ছিলাম। তারা ক্রুদ্ধস্বরে বাংলায় কটুক্তিপূর্ণ
পৃষ্ঠা: ৪৫
কথাবার্তা বলছিল। এর মধ্যে আমি স্পষ্টই বুঝতে পারি পাঞ্জাবি, শালা পাঞ্জাবি। একজন যুবক জিপের কাছে এসে দাঁড়াল। সে সােজাসুজি আমার। চোখের দিকে তাকাল। ওই সময়ের মতাে এত ঘৃণা ও অন্ধ উত্তেজনা আমি আগে কখনাে দেখিনি। দেখে মনে হচ্ছিল যে সে আমাকে আক্রমণ করবে। এবং গাড়ি থেকে টেনে বের করবে।
২৪ মার্চ সন্ধ্যায় আমাকে আতিথেয়তাদানকারী কর্নেল নকি ও আমি জনশূন্য গলফ মাঠে স্বল্প সময় সান্ধ্যভ্রমণ করলাম। এটা খুবই নিস্তব্ধ ও অসহনীয় মনে হলাে। নকিও উল্লেখ করলেন যে কিছু একটা নিকটবর্তী, সম্ভবত সামরিক বাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। তার মূল্যায়ন অনুযায়ী আলােচনা ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে। তিনি কর্নেল এস ডি আহমেদ [লে. কর্নেল এস ডি আহমেদ, মার্শাল ল সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার) ও ব্রিগেডিয়ার জিলানী যে কত খুশি হয়েছেন, সে সম্পর্কে আলাপ করলেন। তাঁরাই সামরিক শক্তি প্রয়ােগের পক্ষে ছিলেন এবং বাঙালিদের যথাযথভাবে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন।
২৪ মার্চ দিনটি ছিল অত্যন্ত উত্তেজনাকর। সেনানিবাস সশস্ত্র ছাউনির মতাে মনে হলাে। ২১ মার্চ ভুট্টো ও তার দলের লােকজন ঢাকা আগমনের পর থেকে প্রকৃতপক্ষে সবকিছু খারাপের দিকে মােড় নেয়। মনে হলাে অবস্থা চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেছে, যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। যাহােক, তখনাে আলােচনা চলছিল। পিপিপির [ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি] বাইরে বেশ কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা ঢাকায় ছিলেন, যাঁদের মধ্যে খান আবদুল ওয়ালী খান, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, সর্দার শওকত হায়াত খান, মওলানা শাহ আহমেদ নুরানী, মওলানা মুফতি মাহমুদ এবং সর্দার গাউস। বক্সের নাম আমার স্মরণ আছে। প্রেসিডেন্ট তখন পর্যন্ত শহরে অবস্থান করছিলেন এবং এটা আশা করা হয় যে এখনাে অলৌকিক একটা কিছু ঘটতে পারে। যাহােক, উত্তেজনা বাড়তে থাকল। সেনানিবাসের ভেতরে ট্রানজিট ক্যাম্প ভর্তি মনে হলাে। স্পষ্টতই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন সৈন্য এনে সৈন্যসংখ্যা বাড়ানাে হয়েছে।
২৩ মার্চ ছুটি থাকায় ২৪ তারিখে কোনাে পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। ২৫ তারিখ সকালে সংবাদপত্রে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, বল এখন প্রেসিডেন্ট ও তার দলের কোর্টে। তাঁর দল এরই মধ্যে ২৭ মার্চ প্রতিবাদ দিবস ঘােষণা। করেছে। এটা উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতাে বিষয়ে পরিণত হলাে।
২৬ তারিখে আমার রাওয়ালপিন্ডি প্রত্যাবর্তনের কথা বিধায় গাড়ি করে প্রেসিডেন্ট ভবনে গেলাম। সেখানে প্রথম কাজ ছিল পীরজাদা ও ইসহাকের
পৃষ্ঠা: ৪৬
[প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব] কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়া। আমি খায়রুল কবীরের মার্সিডিজ গাড়িতে বেসামরিক পােশাকে প্রেসিডেন্ট ভবনে গেলাম।
সেনানিবাস থেকে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের রাস্তা জনশূন্য দেখাচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রবেশপথ মজবুত কাটাতার দিয়ে জোরালােভাবে বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে এবং সে এলাকাও বিস্ময়করভাবে নির্জন। বাইরে কোনাে স্লোগানমুখর জনতা বা অপেক্ষমাণ সংবাদকর্মী নেই, যা তিন দিন ধরে ছিল। ঢাকা জনমানবহীন শহরে পরিণত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ভবনে রওনা দেওয়ার আগে আমি পীরজাদার বাঙালি স্টাফ সহকারী কর্নেল মাহমুদ চৌধুরীকে ফোন করলাম। পােশাক পরা না থাকায় আমাকে ভেতরে প্রবেশ করার বিষয়টি দ্বাররক্ষীদের অবহিত করার জন্য আমি তাঁকে অনুরােধ করি। প্রবেশের পর আমি সরাসরি বসার ঘরে চলে গেলাম। সেখানে ইসহাক এবং এডিসি ছিল। আমি এডিসিকে মাহমুদ চৌধুরীকে ডেকে আনতে বলি। তিনি তৎক্ষণাৎ এলেন। আমি তাকে বললাম যে জরুরি ভিত্তিতে আমার পীরজাদার সঙ্গে দেখা করা দরকার।
কয়েক মিনিট পর মাহমুদ জানালেন যে পীরজাদা আমার জন্য লনে অপেক্ষা করছেন। তিনি বললেন, দয়া করে আলাপ সংক্ষিপ্ত করবেন—এই পাঁচ মিনিটের মতাে। আমি বেরিয়ে গিয়ে দেখলাম পীরজাদা আমার জন্য অপেক্ষমাণ। আমরা কুশল বিনিময় করলাম। তিনি বললেন, ‘ব্যাপার কী?
পরদিন আমার রাওয়ালপিন্ডি যাওয়ার কথা দিয়ে আলাপ শুরু করলাম। আমি তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে দ্রুত একটি ব্যাখ্যা দিয়ে ত্বরিত তাজউদ্দীনের বিবৃতির প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে চাইলাম, এটা কি এখন অথবা কখনাে না গােছের বার্তা? ২৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনসহ সংঘটিত অন্যান্য ঘটনায় প্রেসিডেন্ট কি ভীষণ অখুশি?
পীরজাদা মন্তব্য করার আগে তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন, বললেন যে ২৩ মার্চের ঘটনায় (বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানাে ইত্যাদি) প্রেসিডেন্ট খুবই মর্মাহত হয়েছেন। সবকিছুর একটা সীমা আছে। শহরে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানের অবস্থানকালে এসব ঘটনায় এটাকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে। ২৩ তারিখে অধিনায়ক টিক্কা খানের সঙ্গে মধ্যাহ্নভােজনের জন্য প্রেসিডেন্টের সেনানিবাসে যাত্রাপথে কয়েকটি প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রদর্শনের কথাও তিনি উল্লেখ করলেন।
‘মনে হয়, তিনি বললেন, তারা সবাই উন্মাদ হয়ে গেছে। এটা নিশ্চয়ই কারও দাবি আদায়ের জন্য চাপ প্রয়ােগের প্রকৃষ্ট পন্থা নয়। প্রেসিডেন্টকে এতটা চাপে রেখে তারা কাউকেই সাহায্য করছে না। সব সত্ত্বেও দেশের
পৃষ্ঠা: ৪৭
সংহতি রক্ষা করা প্রেসিডেন্টেরই কাজ। সেটিকে নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলতে পারাে না, পারাে কি?
ইত্যবসরে ভুট্টো তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক জে এ রহিমকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে এলেন। তারা গাড়ি থেকে নেমে হাত উত্তোলন করে জেনারেলকে তাদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করলেন। আমি প্রস্থানে উদ্যোগী হলে পীরজাদা বাধা দিলেন। তিনি দর্শনার্থীদের বসার ঘরে যেতে ইশারা করে বললেন, এরপর কী করা যায়? পরিস্থিতি এরই মধ্যে অনেক দূর গড়িয়েছে। সেনাবাহিনী যুক্তিসংগত কারণেই ক্ষিপ্ত। ইতিহাসে কোনাে জাতির সেনাবাহিনী এভাবে সাধারণ মানুষের কাছে এত নিগৃহীত হয়নি।’
আমি তার কাছে জানতে চাইলাম যে কর্তৃপক্ষ কী চাইছে—এক না দুই পাকিস্তান?
তিনি বললেন, ‘এক পাকিস্তান’।
আমি বললাম, কিন্তু, কেমনে?
এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলে দেওয়া তাঁর উত্তর ছিল অনেকটা ‘অপেক্ষা করাে এবং দেখাে’ ধরনের। তার কাছে থেকে বিদায়ের অনুমতি চেয়ে বললাম, স্যার, আমি একটি বিনম্র, অতি বিনম্র অনুরােধ করতে চাই, তা হলাে এই দেশ যদি দ্বিখণ্ডিত হয়, তাহলে মুজিবুর রহমানই এই দ্বিখণ্ডিতকরণে পৌরহিত্য করুক। অনুগ্রহ করে সেনাবাহিনীকে এর বাইরে রাখুন। আমি যখন তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিই, তখন আন্তরিকভাবে প্রেসিডেন্টের জন্য প্রার্থনা করলাম, যাতে তিনি জনগণকে আস্থায় আনতে যথাশিগগির জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা ছিল পুরােপুরি যন্ত্রণাদায়ক। ফেরার পথে সভাকক্ষ পর্যন্ত প্রসারিত কাচঘেরা বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কতগুলাে কাগজের ওপর চোখ বােলাচ্ছেন। সাদা শার্ট ও সােনালি রঙের চশমা পরিহিত প্রেসিডেন্টকে কাজে সম্পূর্ণ নিমগ্ন মনে হলাে। পরে জানতে পারি যে পরদিন ইসলামাবাদ থেকে তাঁর যে ভাষণ দেওয়ার কথা, এ সময় তিনি তার খসড়া পরীক্ষা করছিলেন।
প্রেরণা আর হতাশার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করলাম। অনেক জরুরি কাজে জড়িত থাকা সত্ত্বেও পীরজাদা আমাকে সময় দেওয়া ও আমার প্রতি মনােযােগ দেওয়ায় ভালাে লাগছিল। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক আলােচনায় ব্যর্থতার আভাস পেয়ে হতাশ হলাম। আমি জানতাম না যে। প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে পথ পরিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঘটনাটি আমি পরে জানতে পারি। বাড়ি ফিরে আসার পর আমার আতিথেয়তাকারী কর্নেল নকি বললেন, ‘মনে হয় আজ মধ্যরাতে অভিযান শুরু হবে।
পৃষ্ঠা: ৪৮
কর্নেল নকির স্ত্রী কিশওয়ার জেনারেল হামিদের স্টাফ অফিসার মেজর জালালের একটি টেলিফোন কলের কথা আমাকে জানান। টেলিফোনের বার্তাটি ছিল যে পরদিন আমার রাওয়ালপিন্ডি যাওয়া হচ্ছে না। তার পরিবর্তে সকালে প্রথমে আমাকে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দপ্তরে হাজির হতে হবে।
নৈমিত্তিক দিবানিদ্রার জন্য সােলঝেনিৎসিনের ফুল সার্কেল বইটি নিয়ে শয্যাগত হলাম বটে, তবে এতে মনঃসংযােগ করা অথবা ঘুমানাে কঠিন। হলাে। কী ঘটতে যাচ্ছে? এ প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আমাকে তাড়া করতে থাকল। ওই দিন সন্ধ্যায় হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বদরুদ্দিনের [এস জি এম বদরুদ্দিন, মর্নিং নিউজ] সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ নির্ধারিত ছিল এবং সন্ধ্যা ছয়টায় তিনি আমাকে উঠিয়ে নেওয়ার কথা। ওই অপরাহে ঘড়ির কাঁটা যত মন্থর গতিতে চলছিল, তার চেয়ে ধীরে চলার সুযােগ ছিল না, আমার হাতে সময় ভীষণভাবে ঝুলে রইল। আমি অস্থিরতা বােধ করলাম।
সন্ধ্যার পর বদরুদ্দিন তাঁর ফিয়াট গাড়িতে এলেন। দৃশ্যত তাঁকেও বিষাদগ্রস্ত মনে হলাে। আমি আসন্ন অভিযান সম্পর্কে আলােচনা এড়িয়ে যাই। কিন্তু তিনি নিজে মনে করেন যে সেনাবাহিনীকে অপমান করে এবং উসকে দিয়ে শেখ মুজিব সশস্ত্র বাহিনীর রােষের পাত্র হয়েছেন। এটা করা তাঁর প্রয়ােজন ছিল না। তিনি আরও মর্যাদাসম্পন্ন ও কৌশলী হতে পারতেন; তবে জনশূন্য এক ভিন্ন নগরীর মধ্য দিয়ে হােটেলে যাওয়ার পথে আমরা জয় বাংলা স্লোগানদানরত ট্রাকভর্তি বাঙালি তরুণের সাক্ষাৎ পাই। তাদের কিছুসংখ্যক অবশ্য মফস্বলে বাড়ি ফিরছিল, যেখান থেকে তারা ওই দিন এসেছিল। তাদের স্লোগান আগের চেয়ে ভীতিপ্রদ ও জোরালাে স্বরে মনে হলাে অথবা সম্ভবত আমি নিছক কল্পনা করছিলাম। হােটেলের পানশালায় আমরা নীরবে পানীয় গ্রহণ করলাম। প্রদেশে সংখ্যালঘু বিহারিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বদরুদ্দিন দুর্ভাবনায় ছিলেন। বিহারিরা ইতিমধ্যে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি কোনাে বড় আকারের গন্ডগােল শুরু হয়, তবে বিহারিরা বাঙালিদের রােষের প্রথম বলি হবে। আমরা প্রায় পৌনে আটটায় পানশালা ত্যাগ করলাম। লাউঞ্জটি ছিল পূর্ণ। পরিচিতজনদের মধ্যেই আমাকে খুঁজে পেলাম। যেমন মাজহার আলী খান, মিঞা মাহমুদ আলী কাসুরী, নােমান জুবেরী এবং পাকিস্তান অবজারভার-এর এবিএম মূসা।
মাজহার আলী খানের সঙ্গে আলিঙ্গন করে দু-চার কথা বললাম। তিনি শুধু মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। কিন্তু সেখানে কে আসছিলেন এবং যাচ্ছিলেন সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি রেহমান সােবহানের সঙ্গে অবস্থান করছেন। প্রকৃতপক্ষে সােবহান সে সময় বাইরে গাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আমাকে প্রখ্যাত আইনজীবী মাহমুদ আলী কাসুরীর
পৃষ্ঠা: ৪৯
সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এর মধ্যে মূসা আমার কাছে এসে বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট সবেমাত্র ঢাকা ত্যাগ করেছেন।’
তাঁর আকস্মিক প্রস্থানের বিষয়ে কিছু না জেনে আমি তীক্ষ কণ্ঠে বললাম, “কিন্তু কয়েক ঘণ্টা আগ পর্যন্ত তাে তিনি এখানে ছিলেন।
মূসা পুনর্ব্যক্ত করলেন, না, তিনি ঠিক সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে চলে গেছেন।
আমাকে নিশ্চয়ই কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখাচ্ছিল। মূসার সঙ্গে করমর্দন ও স্বাভাবিক আনুষ্ঠানিকতা বিনিময়ের পর প্রস্থান করলাম। আমি দেখতে পেলাম, তিনি বিরক্ত ও ভীত। তাঁর মুখমণ্ডল খুব অন্ধকার মনে হলাে। মা বদরুদ্দিন আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবেন বলে আমি তাকে অপেক্ষা করাতে চাইনি। ফিরতি পথে আমরা বেশি কথা বলিনি। সহসাই সামরিক তৎপরতা শুরু হতে যাচ্ছে। ব্যাপারটি জানতে পেরে আমার মন ও বিবেক ভীষণভাবে ভারাক্রান্ত হলাে।
রাস্তা প্রায় জনশূন্য, শুধু একদল পথচারী ক্লান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে অথবা কোনাে গাড়ি চলছে। তবে রাস্তা ছিল সম্পূর্ণ পরিষ্কার; পথে কোনাে প্রতিবন্ধকতা নেই, যান চলাচলে বাধাদানকারী কোনাে দল বা ফেলে রাখা বৃক্ষ নেই। সেনানিবাসের প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতায় গাড়ি থামিয়ে কালাে পতাকা ও বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে গতানুগতিক নিয়ম অনুসরণ করলাম। আমি কর্তব্যরত সৈনিককে বললাম আমার সাথি বদরুদ্দিন আমাকে নামিয়ে দিয়ে শহরে ফেরত আসবেন। দায়িত্ব পালনকারী প্রহরীরা সঙ্গোপনে বদরুদ্দিন সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চাইলেন। আসন্ন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বদরুদ্দিন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। আমরা বিদায় নেওয়ার সময় বদরুদ্দিন বললেন, তিনি প্রথমে অফিসে যাবেন, যেখানে তার কিছু করণীয় আছে।
রাত ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে রকেট লঞ্চারের বিকট শব্দ, ট্যাংকের গােলা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের অবিরাম শব্দে জেগে উঠলাম। সামরিক অভিযান, যা রাত একটায় শুরু হওয়ার কথা, এক ঘণ্টা বা তার কাছাকাছি সময় আগে শুরু হয়। আক্রমণ ছিল জোরালাে। মেশিনগানের বিস্ফোরণ, রকেট লঞ্চার ও ট্যাংকের গােলার বজ্রের ন্যায় বিক্ষিপ্ত উচ্চ শব্দের সঙ্গে ক্ষুদ্র স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও কামানের গােলার কর্ণবিদারী শব্দ একাকার হয়ে গেল। – বাড়ির সবাই জেগে উঠল। ঘরের কাচঘেরা বারান্দা রাস্তামুখী। কিশওয়ার পর্দা একদিকে টেনে দিলে দেখলাম দিগন্ত লাল শিখায় উজ্জ্বল। এটা ছিল ভয়ানকভাবে আতঙ্কজনক। ঢাকা জ্বলছিল। কিশওয়ার চাপা স্বরে পবিত্র
পৃষ্ঠা: ৫০
কোরআন তিলাওয়াত করছেন। অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার কঠিন দিনগুলাে সরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরােদস্তুর বিভীষিকার শুরু হলাে। পূর্বে সতর্ক করা সত্ত্বেও হতবুদ্ধি, চিন্তাশক্তিরহিত হয়ে এই ভয়াবহ বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করা আমার জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। ঘুমানাের জন্য আবার শুয়ে পড়লাম। পরের দিনটিও খুব প্রলম্বিত হতে যাচ্ছে এবং আমার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া আবশ্যক। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আবার আধঘণ্টাখানেক পর জেগে উঠলাম। কিশওয়ার জাগ্রত অবস্থায় চেয়ারে বসা। তিনি বললেন, ‘টেলিফোন অকেজো হয়ে গেছে। আমি বললাম, ভালােই, এক ভয়ানক উৎকণ্ঠার অবসান হলাে।’
অপ্রতিহত প্রচণ্ডতায় চলা গােলাগুলির শব্দ খুব কাছের নয়। দিগন্তে এখনাে গাঢ় কমলা রঙের শিখা। সৈন্যরা স্পষ্টতই সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে টহল দিচ্ছে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ ও রােষের মধ্যে মাঝেমধ্যে ক্ষীণ স্বরে উচ্চারিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান চাপা পড়ে যাচ্ছিল। স্লোগান কেন্দ্রীভূত নয়। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে নয়, বরং আক্রান্ত ব্যক্তিদের ছােট ছােট দল থেকে আসছিল। এগুলাে সহসাই নিস্তব্ধ হয়ে গােলাগুলির সীমারেখা শহরের গভীরে ও সেনানিবাসের দূরবর্তী স্থানে এগিয়ে যাচ্ছিল।
ভয়ার্ত চিৎকার, প্রার্থনার সুর এবং মেশিনগানের দমক তীব্রগতিতে অন্ধকারের আস্তরণ ভেদ করে গেল। দূরবর্তী স্থানে কেন্দ্রীভূত প্রচণ্ড গােলাগুলি কমে এলেও কাছাকাছি মেশিনগানের গুলির ইতস্তত বিস্ফোরণ তখনাে শােনা যাচ্ছে। স্লোগানদাতাদের শব্দ কমে ক্রমবর্ধিষ্ণু গােলাগুলির পরিমাণের মাঝে কার্যত অবলুপ্ত হলাে। আমি বেশ জাগা অবস্থায়, কিন্তু বিছানায় শুয়ে বিস্ময়করভাবে শান্ত থাকলাম। ওই মুহূর্তে উত্তরদান দূরের কথা, প্রশ্ন করাও অসম্ভব ছিল। এটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া একটি গােলযােগপূর্ণ ঘটনার মােড়-পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে উত্তরােত্তর বেড়ে ওঠা টানাপােড়েনের অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বেদনাদায়ক সমাপ্তি।
অবশেষে এলােমেলাে স্বপ্নের বিহ্বলতা ও দুঃস্বপ্নের কল্পনায় তাড়িত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। এভাবেই দিনের আলাে না ফোটা পর্যন্ত চালালাম। দূরদিগন্ত তখনাে বহ্নিমান; উদীয়মান সূর্যের প্রথম এবং অবগুণ্ঠিত আলােকরশ্মি একে একে হালকা রং এবং হতশ্রী ভাব এনে দিল। শহরে বিষাদের সঙ্গে সূর্যোদয় হলাে। বিছানার পার্শ্বটেবিলে রাখা সকালের চা তৃপ্তি ও কৃতজ্ঞতাসহ পান করলাম। সকালবেলার টুকিটাকি কাজ সারতে তাড়াতাড়ি শয্যা ছাড়লাম। দাড়ি কামানাে, স্নান, কাপড় পরা ও প্রাতরাশ শেষে ঘরের বাইরে বেরােলাম।
পৃষ্ঠা: ৫১
বাঙালি গাড়িচালক আনিসুর রহমানসহ গাড়ি আমার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিল। সে স্টেনগান নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। সে বরাবরের ন্যায় পুরােপুরি শান্ত, নির্লিপ্ত ও সজাগ ছিল; তবে তাকে কিছুটা উত্তেজিত মনে হচ্ছিল, সামান্য ভীতও। হতে পারে এসব কিছু আমি শুধু শুধু কল্পনা করছিলাম। বাইরে এতটাই নীরব যে কোনাে কিছু সচল বলে মনে হচ্ছিল না। সংলগ্ন বাড়ির ছাদে ওড়ানাে কালাে পতাকা চুপসে যাওয়া ক্যানভাসের মতাে দেখাচ্ছিল। এর বাঙালি বাসিন্দারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল এবং তাদের হতভম্ব দেখাচ্ছিল। তারা অপলক দৃষ্টিতে আমাকে উর্দি পরা অবস্থায় দেখছিল, তাদের দৃশ্যত ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। বাতাসে পুড়ে ঝলসে যাওয়া লাশ ও ধোয়ার গন্ধ। সর্বত্র অসহনীয় নীরবতা।
চালক কেতাদুরস্তভাবে অভিবাদন জানাল, তার কাধে অস্ত্র ঝােলানাে। মনে মনে ভাবলাম, সে যদি ওই অস্ত্র দিয়ে আমাকে গুলি করে, তাহলে কেমন হবে। তাকে শান্ত ও অবিচলিত দেখালেও সে খুবই বিচলিত হওয়ার কথা। আমি আসনে বসার পর সে বন্দুক পেছনের আসনে রেখে নিজ আসনে উঠে গাড়ির চাবি ঘােরাল। ঘটঘট শব্দে ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর আমরা বেরিয়ে এলাম। হঠাৎ জিপ থেকে কিছু দূরে ডান দিকে একটি মৃতদেহ দেখলাম, যার ওপর মাছি লােভীদের মতাে ভােজন উৎসবে ব্যস্ত। নরম রাস্তায় গাড়ির চাকার চাপে উপচে ওঠা মাটিতে গাড়ি লাফিয়ে উঠলে ভালােভাবে দেখার জন্য মাথা ঘােরালাম। লাশের দেহে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন, ক্ষরণ শেষে জমাটবাঁধা রক্ত শুকিয়ে গেছে।
মৃতদেহটির অদূরে একটি ভাঙা ট্রানজিস্টর পড়ে আছে। হত্যাকাণ্ডের আগে হাতাহাতি হয়ে থাকবে। হতভাগা লােকটির কাছ থেকে হত্যাকারী রেডিওটি অবশ্যই ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মনে মনে ভাবলাম, বাঙালি চালক লাশটি দেখেছে কি না? দেখে থাকলে এ নিয়ে সে কী ভাবছে? আমরা সহসাই ১৪ ডিভিশনের সদর দপ্তরমুখী রাস্তায় উঠলাম। যাত্রাপথে সশস্ত্র সৈন্যরা আমাকে অভিবাদন জানাতে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ডান হাত দিয়ে আড়াআড়িভাবে রাইফেলে আঘাত করছিল। গত কদিনের চেয়ে তাদের খুবই আলাদা লাগছিল, মুখমণ্ডল উজ্জ্বল ও মাথা উঁচু করে চলছে। তাদের চলাফেরায় অবর্ণনীয় শক্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল। তাদের অভিবাদন ছিল স্পষ্ট, অনিদ্রার সুস্পষ্ট আভাস সত্ত্বেও তাদের সতর্ক ও সতেজ দেখাচ্ছিল। মুখাবয়বে বিজয়ের দীপ্তি। দুশ্চিন্তা, অবমাননা ও প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে, তাদের মর্যাদা ও সম্মান পুনরুদ্ধার হয়েছে।
নিত্যপ্রয়ােজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য সামগ্রী জোগান দেওয়ার ঝুপড়ি দোকানগুলাে ভস্মস্তুপে পরিণত হয়েছে। লাগাতার বন্ধ রাখার পরিণতি
পৃষ্ঠা: ৫২
সম্পর্কে সামরিক বাহিনীর সতর্কীকরণ সত্ত্বেও, বিপণিকেন্দ্রগুলাে অসহযােগ আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার পর থেকেই বন্ধ রয়েছে। বাজারে অগ্নিসংযােগ করা হয়েছে। কিছু কিছু পুড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ এখনাে ধিকিধিকি জ্বলছে আর অরুচিকর দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সৈন্য বহনকারী কিছুসংখ্যক জিপ ও ট্রাক আমাদের পাশ দিয়ে চলার সময় আমাকে দস্তুরমাফিক সালাম দিল।
কমান্ড সদর দপ্তরে সবকিছু শান্ত। চিফ অব স্টাফের অফিসে গেলাম। ব্রিগেডিয়ার এল ইড্রস [ব্রিগেডিয়ার আলী এল ইদ্রুস, পূর্বাঞ্চল কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ) আসনে বসা। তাঁকে ভালােভাবে জানতাম। অবস্থা সম্পর্কে তাঁকে খুব একটা খুশি মনে হলাে না এবং আগেই শাস্তিমূলক কার্যক্রম গ্রহণের ‘বাঞ্ছনীয়তা’র ব্যাপারে কিছু বললেন। তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে তিনি তাঁর পূর্বতন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুবের [লে. জেনারেল সাহেবজাদা মুহাম্মদ ইয়াকুব খান, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পূর্বাঞ্চল কমান্ডের প্রধান] বরাত দিলেন। জেনারেল অনেক আগেই, বলতে গেলে ১ জানুয়ারি, পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের শপথ গ্রহণের দুই দিন আগে, তার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। ওই সময়ে স্বল্প শক্তি প্রয়ােগে সবকিছু অঙ্কুরে বিনষ্ট করা সম্ভব ছিল।
যাহােক, সে সময় ইয়াকুবের কথায় কর্ণপাত না করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার অবাধ সুযােগ সৃষ্টি করা হয়, আর এখন তা হাতের বাইরে চলে গেছে। এখন এতই বিলম্ব হয়ে গেছে যে ক্ষুদ্র অগ্নিশিখা থেকে তৈরি বৃহৎ দাবানলের ন্যায় আন্দোলন ঢাকা থেকে বিস্তৃত হয়ে প্রদেশের প্রত্যন্ত আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। উপস্থিত সৈন্যসংখ্যা দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহের মুখােমুখি এবং বিশ্বাসের বাইরে চলে গেছে। এটা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের জন্য সত্য এবং বাঙালি পুলিশও এর ব্যতিক্রম নয়।
এল ইদ্রুসকে দেখে ও তাঁর কথায় মনে হচ্ছিল তিনি যুদ্ধের বাইরে রয়েছেন। তিনি কোরের চিফ অব স্টাফ, কিন্তু সেনা অভিযান পরিচালনাসংক্রান্ত যাবতীয় পরিকল্পনা থেকে তাঁকে বাইরে রাখা হয়েছে। গােটা পরিকল্পনাটি গৃহীত হয়েছে দ্বিতীয় রাজধানীর সামরিক আইন সদর দপ্তরে। তাকে বললাম, আমি জেনারেল হামিদসহ অন্যদের দেখা কোথায় পাব। আমার ওপর নির্দেশ ছিল যে সকালের প্রথম কাজ হিসেবে সদর দপ্তরে হাজির হওয়া। আচমকা তা স্মরণ করে তিনি বললেন, “ওহ! তাই। সে ক্ষেত্রে আপনার বরং ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে যাওয়া উচিত। সবাই সেখানে। ধন্যবাদ দিয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসের দিকে চললাম।
কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে গিয়ে সরাসরি অভ্যর্থনাকক্ষে প্রবেশ করলাম। প্রথমেই অপ্রত্যাশিতভাবে জেনারেল ওমরের [জাতীয় নিরাপত্তা
পৃষ্ঠা: ৫৩
বাহিনীর প্রধান] দেখা পেলাম। তাকে খুশি দেখাচ্ছিল না। তাঁকে অভিবাদন জানালাম। আলিঙ্গন করে বললেন, তিনি আমাকে দেখে খুশি হয়েছেন। লাগােয়া খাওয়ার কক্ষে জেনারেল হামিদ [পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান] ও টিক্কা সকালের নাশতা করছিলেন। চামড়ার গভীর সােফার এক চেয়ারে নৌ অধিনায়ক রিয়ার অ্যাডমিরাল রশিদকে [রিয়ার অ্যাডমিরাল রশিদ আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান] উপবিষ্ট দেখে পরস্পর কুশল বিনিময় করলাম। অ্যাডমিরাল তাঁর স্টাফ অফিসারসহ চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইতিমধ্যে হামিদ বৈঠকখানায় এলেন। আরামদায়ক প্রাতরাশের পর তাঁকে বেশ হালকা মনে হলাে। তার পেছনে টিক্কা। আমি দুই জেনারেলকে অভিবাদন করলাম।
আমি কী করার পরিকল্পনা করছি, তা হামিদ জানতে চাইলেন।
‘স্যার, অবিলম্বে বেতার সম্প্রচার শুরু করা। ‘বেশ’, তিনি বললেন, ‘শুরু করাে’।
জেনারেলদের কাছ হতে বিদায় নিয়ে কামরা ত্যাগ করলাম। বারান্দায় বের হয়ে আবার ওমরের সাক্ষাৎ পেলাম। হামিদের সঙ্গে আমার সংক্ষিপ্ত আলাপের বিষয়টি তাকে অবহিত করলাম। আরও বললাম যে আমি পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, তারপর সামরিক আইনের বিভিন্ন ঘােষণা এবং পুনরায় তিলাওয়াতের মাধ্যমে সম্প্রচার শুরু করতে যাচ্ছি। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত সম্প্রচারের সময়কে তিলাওয়াত ও সামরিক আইনসংশ্লিষ্ট ঘােষণার মধ্যে সীমিত রাখা হবে। আর অবশ্যই জাতীয় সম্প্রচারের আওতায় সংবাদ প্রচার করা হবে। নির্ধারিত সময়ে জাতীয় সংগীত বাজানাে ছাড়া কোনাে সংগীত পরিবেশিত হবে না। তিনি পরিকল্পনা সমর্থন করলেন আর মেসে অবস্থানরত রােয়েদাদ খানের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিলেন। যাত্রাপথে তখনাে বিভিন্ন দিক থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখলাম। আর দূর থেকে রাইফেলের সিঙ্গল শট এবং মেশিনগানের গুলির বিক্ষিপ্ত শব্দ শুনতে পেলাম। সামরিক ট্রাক ও জিপ দ্রুতগতিতে শহর অভিমুখে যাচ্ছিল আর তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল।
গাড়ি নিয়ে অফিসার মেসের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত কামরায় গেলাম। রােয়েদাদ খান এইমাত্র বেরিয়ে গেছেন। খাবার ঘরে টেলিফোনের কাছে জেনারেল ওসমান মিঠঠাকে [মে. জেনারেল এ ও মিঠা, কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল] দেখলাম। তিনি কোনাে দূরবর্তী স্থানে সংযােগ পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন—খুব সম্ভব চট্টগ্রামে। তাঁর কথা বােঝানাের জন্য অপর প্রান্তের ব্যক্তির উদ্দেশে রগরগে সামরিক ভাষায় হলফ করছিলেন। ভাবলাম, চলে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলা উচিত। তাই টেলিফোনে
পৃষ্ঠা: ৫৪
তার কথা বলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলাম। কথা শেষ হতেই অভিবাদন জানিয়ে তিনি কেমন আছেন জানতে চাইলাম। উচ্চরবে তিনি বললেন, তুমি এখানে কী ছাই করছ?
স্যার, আমার কাজ—আমি এখনই সম্প্রচার ভবনে গিয়ে প্রচার শুরু করতে যাচ্ছি।’
‘চুলােয় যাক রেডিও। তিনি গালমন্দ করলেন।
তিনি কথা বলার মেজাজে নেই দেখতে পেয়ে তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বেতার কেন্দ্রের দিকে চললাম। সেনানিবাসের দিকের রাস্তায় প্রতিবন্ধকের দৃশ্য এক ঘণ্টা আগে যেমন ছিল, অনেকটা তেমনই আছে। অশুভ ধরনের নিস্তব্ধতা, তার সঙ্গে ঝুপড়ি দোকানগুলাের ভস্ম থেকে বেরিয়ে আসা ধোয়া। শুধু কাকের কা-কা ধ্বনির শব্দ আরও বেড়ে গেছে এবং ঘন ঘন শােনা যাচ্ছে। তারা আকাশ থেকে গলিত শবদেহের ওপর নেমে গলিত মাংস ছিড়ে নিতে ব্যস্ত।
কুর্মিটোলার রাস্তায় প্রতিবন্ধকের বাইরে গত রাতের অভিযানের বীভৎস ধ্বংসাবশেষ সহসাই দৃশ্যমান হলাে। দেখে মনে হচ্ছিল রাস্তার কোনাে কোনাে জায়গা খােদাই করা হয়েছে। রাস্তা বন্ধ করার জন্য আস্ত গাছ ফেলে রাখা হয়েছে। সিমেন্টের পাইপ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি প্রতিবন্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। রাস্তা পরিষ্কার করতে অবশ্যই রকেট লঞ্চার ব্যবহার করা হয়ে থাকবে। যার ফলে পেছনে বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
কুখ্যাত ফার্মগেটের কাছে সন্ত্রাস ও ধ্বংস চিহ্ন আরও সুস্পষ্ট। কাটাতার ও কংক্রিটের স্থূপ দিয়ে এটাই সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান বলে দৃষ্টিগােচর হলাে। বিক্ষোভকারীরা কত সুন্দরভাবে এবং তাড়াতাড়ি তাদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুত করেছে, এটা বিস্ময়কর। আগের রাতে আমি যখন এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যাই, তখন এটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার ছিল। বিমানবন্দরের পরের সব দোকান পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং তখনাে ধিকি ধিকি জ্বলছে। বিভিন্ন দিক থেকে সেনাদলগুলাে আন্দোলনকারীদের ঘাঁটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে একত্র হচ্ছিল। প্রথম সেনাদল সেনানিবাসের দক্ষিণ দিকে মূল শহর অভিমুখে রওনা হয়। দ্বিতীয়টি দক্ষিণ-পূর্ব দিকের পথ অনুসরণ করে দ্বিতীয় রাজধানী, মিরপুর ও মােহাম্মদপুর মুহাজির অভিবাসনকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে এবং তৃতীয়টি টঙ্গী শিল্প এলাকা হয়ে সামনে অগ্রসর হয়।
আওয়ামী লীগের বিক্ষোভকারীরা যে আগেই অভিযানের সংবাদ পেয়েছিল, তা তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও ব্যারিকেড নির্মাণ থেকে স্পষ্ট, তারা অবশ্যই দুই থেকে তিন ঘণ্টার বেশি সময়ের সতর্কসংকেত পেয়ে থাকবে। এই কারণে অভিযান শুরুর সময় এক-দেড় ঘণ্টা এগিয়ে আনা হয়। সামনে
পৃষ্ঠা: ৫৫
এগােনাের সব রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণে প্রতিরােধ মােকাবিলা এবং প্রতিবন্ধক ভেঙে ফেলতে সমন্বিতভাবে কামান দাগানাে হয়, হত্যা করতে নয়। কোনাে কোনাে স্থানে পাকা রাস্তা ঘোঁটানাে মাখনের মতাে মন্থিত হয়ে গেছে। এটা এমন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে কেউ বড় গর্তের সারি ও ভগ্নাংশ পরিহার করতে চাইলে বিকল্প পথে যেতে হচ্ছে। যাহােক, জওয়ানরা ফার্মগেটের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের সামনে তাদের তল্লাশি ও নিরাপত্তাচৌকি স্থাপন করছে।
রাস্তায় আমারটিই একমাত্র পদমর্যাদাসূচক তারকাখচিত জিপ ছিল। আমার মনে পড়ে না সামরিক বাহিনীতে দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময়ে জওয়ানদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের কাছ থেকে ওই দিনের মতাে এত বেশি আর সুন্দর অভিবাদন পেয়েছি। চারদিকের বিষন্নতার তুলনায় তাদের দৃশ্যত নিরুদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ও মুখে হাসিখুশির ছটাও দেখা যাচ্ছে। যানবাহন নিয়ন্ত্রণের বাতি স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে, লাল থেকে হলুদ ও তারপর সবুজে পরিবর্তিত হচ্ছে। এত সকালেও দৃশ্যটি আতঙ্কজনক ছিল। এক দোকানের নিচে ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া গৃহহীন একজন ভিখারি দেখলাম। সে ছিল নগ্ন এবং তার শরীর ছিল অপরিষ্কার, কঙ্কালসার এবং ধূলিমলিন। সে শূন্যদৃষ্টিতে আশপাশে লক্ষ করছিল, জিপটি দেখল এবং আত্মরক্ষার জন্য দোকানের সম্মুখভাগের নিচে যতটা সম্ভব নিচু হয়ে ঢুকে। গেল। মােটর ইঞ্জিনের নিয়মিত শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া কোনাে আওয়াজ শােনা যাচ্ছিল না।
ঢাকা গতকালের প্রতিবাদের পথ থেকে আজকে মৃত্যু ও ধ্বংসের রাস্তায় এগিয়ে গেল। ট্রাকভর্তি প্রতিশােধ-পিপাসু আরক্ত চোখের স্লোগানমুখর তরুণ প্রতিবাদকারীদের এখন দূর অতীতের অংশ মনে হলাে। কালাে পতাকা এবং লাল-সবুজের বাংলাদেশের পতাকা এখনাে বাড়ির ছাদে উড়ছে। কিন্তু ওইগুলাের পশ্চাতে সেদিন যে শক্তি ও উত্তেজনা ছিল, তা নেই বলে ঠাহর হলাে। ওইগুলাে এখন হয়তাে নিষ্প্রাণ কাপড়ের টুকরা। ঢাকা এক প্রেতপুরী, শূন্য চক্ষুকোটরসংবলিত এক বিকটদর্শন করােটির ভেতরে-বাইরে মাছি। ভনভন করছে। দ্রুত আবর্তিত বিশৃঙ্খল চিন্তায় আমার মস্তিষ্ক আকীর্ণ। আমাকে পরিস্থিতি আত্মস্থ করার অনুপযােগী মনে হলাে। আমরা রেডিও পাকিস্তানের বন্ধ প্রবেশদ্বারের বাইরে থামলাম। জনৈক সৈনিকের মাথা ফটকশীর্ষে দৃষ্টিগােচর হলাে এবং তৎক্ষণাৎ সে পিছিয়ে গিয়ে দ্বার খুলে দিল। আমরা গাড়ি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। আরেক দফা কেতাদুরস্ত অভিবাদন দেখলাম। জিপ থেকে নামলাম এবং স্টুডিওতে রােয়েদাদ ও মেজর অকিলকে খোজ করলাম।
পৃষ্ঠা: ৫৬
ইতিমধ্যে সশস্ত্র প্রহরায় কিছুসংখ্যক বাঙালি কর্মচারীকে কেন্দ্রে আনা হয়েছে। তারা সামরিক আইনবিধি বঙ্গানুবাদ করছিলেন। রােয়েদাদকে অভিনন্দন জানালাম। আমাকে সেখানে দেখে তিনি খুশি হলেন। জেনারেল টিক্কা ও হামিদের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি তাকে জানালাম। অচিরেই দেখতে দুর্বল মােহাম্মদপুরের এক বিহারি মওলানা এবং বেতার কেন্দ্রের কতিপয় কর্মচারী আমাদের সঙ্গে শামিল হলেন। সালিকও [মেজর সিদ্দিক সালিক, ঢাকায় প্রেস লিয়াজেঁ অফিসার] এল। তাকে বেতার-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি আমাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে অফিসে আটকে পড়া সাংবাদিকদের বের হতে সহায়তা করতে বললাম। আমরা ঠিক করলাম যে দুপুর ১২টায় পাকিস্তান অবজারভার অফিসে মিলিত হব।
আমরা ঢাকা বেতার কেন্দ্র’-এর পরিবর্তে প্রচলিত পরিচিত ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা দিয়ে সম্প্রচার চালুর সিদ্ধান্ত নিই। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও তরজমা দিয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করা হয়। অতঃপর অকিল ইংরেজিতে বিশেষ সম্প্রচার শুরু করে, তারপর বাংলা তরজমা পেশ করে। ঘােষণাগুলাে পুনঃপুন প্রচার করা হয় এবং বেলা ১১টা ৩০ মিনিট নাগাদ প্রচার শেষ হয়।
কিছুক্ষণ পর আমরা অবজারভার অফিসের দিকে চললাম। আমি নিজে গাড়ি চালালাম, বাঙালি চালক আমার পাশে বসল। ঢাকা ক্লাবের কাছে হাতপা ছড়ানাে অবস্থায় পড়ে থাকা দুটো মৃতদেহ দেখলাম। রাস্তার কয়েকটি সংগমস্থল ও তল্লাশিচৌকিতে দেখা গেল যে সব অবরােধ এবং ব্যারিকেড ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বা কামান দাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রখর সূর্য কিরণের নিচে গাঢ় সবুজ রমনার বিশাল সবুজ বেষ্টনী ভীষণ নিঃসঙ্গ। গুলমােহর ও চম্পকগাছগুলাে এখনাে দাঁড়িয়ে যেন ঘটনার যন্ত্রণাদায়ক চিন্তায় আচ্ছন্ন। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের দিক থেকে এখনাে রাইফেলের গুলির বিক্ষিপ্ত শব্দ শােনা যাচ্ছে। সড়ক বিভাজকের গােল চত্বরের পেছন দিক থেকে একটি ডজ-ট্রাক আসতে দেখলাম। সালিক চালকের পাশে সামনের আসনে বসা। প্রায় একসঙ্গে গতি মন্থর করে আমরা একে অপরের পাশে থামলাম। পাকিস্তান অবজারভার-এর মাহবুবুল হক (মাহবুব ভাই) পেছনের আসনে বসা। আমরা নেমে কুশল বিনিময় করলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, মাহবুব ভাই, কেমন আছেন, সব ঠিকঠাক তাে?)। দৃশ্যত বিচলিত মাহবুব আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। বললাম, ‘পত্রিকার খবর কী, কখন বেরােচ্ছে।’
মাহবুব বললেন, তাঁরা পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টা করবেন, তবে এটা সম্ভব -ও হতে পারে। অধিকাংশ কর্মচারী গত রাত থেকে কোনাে খাবার ছাড়া
পৃষ্ঠা: ৫৭
অফিসে আটকা আছে। আহার ও কিছু বিশ্রাম করার জন্য তাদের প্রথম বাড়ি যেতে হবে। অধিকন্তু টেলিফোন আর সংবাদ সংস্থা সবকিছুই নিষ্ক্রিয়। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই দিন সন্ধ্যায় প্রদেয় প্রেসিডেন্টের ভাষণ এবং সামরিক আইনের বিভিন্ন আদেশসমূহ এক বা দুই পাতায় ছাপিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব কি না। পরে হঠাৎ আমার নিজের প্রস্তাবের অযৌক্তিকতা অনুধাবন করলাম। পত্রিকা যদিওবা ছাপা হয়, তবে তা পাঠ করবে কারা? নগরীতে ৪৮ ঘণ্টার কারফিউ জারি আছে। আমি সালিককে জিজ্ঞেস করলাম যে সে সাংবাদিকদের পাস সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে কি না। সে বলল, মধ্যাহ্নভােজের পর সমস্যাটির সুরাহা করবে। এরপর সে কিছু কাজের জন্য মাহবুব ভাইকে সামরিক আইন সদর দপ্তরে নিয়ে যেতে চাইল। শান্তিপ্রিয়, আইন মান্যকারী নাগরিকদের ভয়ের কোনাে কারণ নেই মর্মে আশ্বস্ত করতে মেজর জেনারেল ফরমান পােস্টার ছাপিয়ে নগরীর সর্বত্র সেঁটে দিতে চাইছেন। অভিযান পরিচালিত হয়েছে মুষ্টিমেয় দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে, তাই কোনাে প্রকার ভয়ের কারণ নেই।
সান্ধ্য আইন চলাকালীন শহরের দেয়ালে পােস্টার? এটা রূঢ় রসিকতার মতাে মনে হলাে। পােস্টার দেখতে কে বাইরে বেরােবে? মাহবুবের নিজেরও খুঁটিনাটি সমস্যা ছিল। মুদ্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখা ছিল কর্মীশূন্য এবং পােস্টারের জন্য প্রয়ােজনীয় মাপের কাগজ মজুত ছিল না। আমি সালিককে বললাম যে পােস্টার ছেপে নগরীর দেয়ালে সাঁটালে তা সম্পূর্ণরূপে বােকামি হবে। সবচেয়ে উত্তম হবে শতসহস্র পরিমাণ ক্ষুদ্র প্রচার পুস্তিকা ছেপে বিমান থেকে বিতরণ করা। সুতরাং মাহবুবকে সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার কোনাে প্রয়ােজন নেই। সে গিয়ে আমার তরফ থেকে জেনারেলকে এটা বলতে পারে। সালিক ইতস্তত করল এবং অতি দ্রুত আমার মত গ্রহণ করল। মাহবুব স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। এমনটি এভাবে ঘটায় তিনি আক্ষেপ করলেন। তিনি আদৌ মুজিবের সমর্থক ছিলেন না, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়ে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। তিনি ট্রেড ইউনিয়নপন্থী এবং পূর্ব পাকিস্তান রেল কর্মচারী ইউনিয়নের প্রধান ছিলেন।
আমি চারদিক ঘুরে দেখলাম, তাতে গভীরভাবে বিষন্ন হলাম। অনতিদূরে রাস্তার নিকটে আরেকটি মৃতদেহ পড়ে আছে। বট এবং গুলমহর গাছের ওপর থেকে নেমে আসা শকুনগুলাে দলে ভারী হয়ে দ্রুত ভিড় করছে। তাদের কর্কশ ধ্বনি নিশ্চল বাতাসকে তীক্ষ ছুরিকাঘাতের মতাে ছিন্ন করছে। রাস্তার কুকুরগুলাে মৃতদেহে ভাগ বসানাের চেষ্টায় ঘােরাঘুরি করছে।
মাহবুব ভাইকে নামিয়ে দিতে ও সেখানে আটকে পড়া কর্মচারীদের সাহায্য করার জন্য আমি অবজারভার অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। গরম
পৃষ্ঠা: ৫৮
এবং গুমটে আমার উর্দির কলারের দিকটা ঘেমে যাচ্ছিল। পােশাক পরিহিত বাঙালি চালক আমার পাশে শক্তভাবে বসা। আমি সবিস্ময়ে ভাবলাম, তার অনুভূতি কী হতে পারে? সে যদি তার বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার মাথায়। আঘাত করে, তাহলে কী হবে? আমরা রাস্তায় আরও মৃতদেহ দেখলাম। মৃতদেহের মাংস ভক্ষণরত শকুনগুলাে বিশাল ডানা ঝাপটিয়ে আর্তরব করছিল।
অনুবাদ : মাহফুজুর রহমান সিদ্দিক
Photo: ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী
Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান