ইয়াহিয়ার হাত থেকে মহামারীর কবলে
পাকিস্তানের মহামান্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খাঁ যুগান্তরের পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সেই মা ও শিশুর ছবিটি দেখেছেন কি? সেই ছবিটি, যাতে দেখান হয়েছে, বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে আগত একটি পরিবারের একমাত্র মেয়েটি কৃষ্ণনগর শহরের রস্তার উপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে এবং তার পাশে বসে কাঁদছে ছােট্ট মেয়েটির মা। অথবা সেই ছবিটি? যাতে আর একটি অবােধ শিশুকে দেখা যাচ্ছে, মরা মায়ের বুকের দুধ টানার চেষ্টা করছে? কলকাতায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর দূত মেহেদি মাসুদ সাহেব দয়া করে এই ছবিগুলি পিন্ডিকে পাঠিয়ে দেন তাহলে ইয়াহিয়া খাঁ সাহেব একবার খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন এই মানুষগুলি কারা—যেসব যথার্থ পাকিস্তানিকে তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে যাওয়ার দাওয়াত পাঠিয়েছেন এরা কি তাদের মধ্যে পড়ে? অথবা যেসব ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীকে পাকিস্তানি ফৌজ দিয়ে দিয়েছে বলে তিনি বড়াই করেছেন তাদের দলে পড়েন এইসব মৃত, মুমূর্ষ অথবা সন্তানহারা মায়ের দল? অথবা এমনও হতে পারে যে, এইসব ছবি দেখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর নয়াদিল্লীকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা হবে। এইসব মা ও শিশুর দিকে তাকিয়ে ভারতবর্ষের সরকার এখনই যে, তাদের সৈন্যবাহিনীকে পূর্ববঙ্গের ভিতর প্রবেশ করে অত্যাচারীদের শায়েস্তা করে আসার হুকুম দিচ্ছেন না সেজন্য হয়তাে পিন্ডির শাসকরা নয়াদিল্লীর ধৈর্যের প্রশংসা করতে পারেন।
কিন্তু ইয়াহিয়া খাঁ ও তার অনুচররা সেই সঙ্গে সঙ্গে কি খোঁজ নেবেন, যাদের তিনি নিজের দেশবাসী বলে মনে করেন তারা তার ফৌজের হাত এড়িয়ে এপারে এসে নিতান্ত নিরুপায়ভাবে ব্যাধির যন্ত্রণা সহ্য করা, এমনকি মরাও, শ্রেয় মনে করছেন কেন? নদীয়া জেলায় ঘুরে আমাদের রিপাের্টার সংবাদ দিয়েছেন যে, কৃষ্ণনগর সীমান্তে শিকারপুর পর্যন্ত ৭৫ মাইল পথ ধরে বাংলাদেশের ২৫ হাজার আশ্রয়প্রার্থী কলেরা রােগ আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। পথের ধারে, ষ্টেশনে, হাসপাতালে যেসব মৃতদেহ পড়ে রয়েছে সেগুলি সরাবার ও তাদের সৎকার করার ব্যবস্থা নেই। তবু ওপার থেকে মানুষ আসছেন, হাজারে হাজারে আসছেন। লুঠেরারা পথে তাদের সর্বান্ত করছেন, সব খুইয়েও তারা আসছেন। ওপারে পাক ফৌজের হাত থেকে যারা বেঁচে আসছেন তাদের অনেকে এপারে এসে মহামারীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারছেন না।
এ একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা। সীমান্তের দরজা আমরা খুলে দিয়েছি। রােগ-যন্ত্রণায় ভুগে মরার ঝুকি নিয়েও মানুষ মুক্তির আশায়, সহানুভূতির আশায়, সেই দরজা পার হয়ে চলে আসছেন। অথচ আমরা তাদের বাঁচাতে পারছি না, মৃত্যুর আগে তাঁদের অনেকের মুখে এক ফোটা জলও তুলে দিতে পারছি না। কোথায় আজ পৃথিবীর মানুষ? কোথায় আজ রাষ্ট্রসঙ্? সেক্রেটারী জেনারেল উ. থাল্ট যে আবেদন জানিয়েছিলেন। তার ফল কি হল? এই ভয়তাড়িত নিরীহ মানুষগুলিকে বাঁচাবার দায় কি একলা ভারতবর্ষের? হয় এরা ইয়াহিয়া খার সামরিক অথবা অসামরিক অনুচরদের হাতে মরবে অথবা রােগে মরবে, এই কি তাদের বিধিলিপি?
নয়াদিল্লীর উদ্দেশে আমাদের জিজ্ঞাসা, নদীয়া থেকে এই ভয়াবহ খবর পাওয়ার পরও তারা কি সীমান্ত রাজ্যগুলি থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের না সরাবার সিদ্ধান্ত আঁকড়ে ধরে থাকবেন? তারা কি এখনও বুঝতে চাইবেন না যে, তাদের এই নীতি আশ্রয়প্রার্থীদের পক্ষে ও সারা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে কি দারুণ বিপদ ডেকে আনছে? তারা কবে তাদের নীতির ভুল বুঝতে পারবেন তার অপেক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবশ্য বসে থাকতে পারেন না। নদীয়া জেলায় এই কলেরা মহামারীর প্রকোপের মােকাবেলা করার জন্য তাদের আপৎকালীন তৎপরতা নিয়ে কাজে নামতে হবে। আরও ডাক্তার চাই, আরও ওষুধ চাই, কলেরার প্রতিষেধক টিকা দেওয়ার ব্যাপক আয়ােজন চাই, পানীয় জলের ব্যবস্থা চাই। বিরাট কাজ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই করতেই হবে। বেসরকারি, স্বেচ্ছাব্রতী সংগঠনগুলিকেও এগিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে, চিকিৎসক ও মেডিক্যাল কলেজগুলির ছাত্রদের কর্তব্য রয়েছে। মানুষগুলিকে এভাবে মরতে দিলে আমাদের নিজেদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বলে দাবী করার অধিকার থাকবে না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ জুন ১৯৭১