You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: বৃহস্পতিবার ২৫শে মাঘ, ১৩৭৯ ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

রক্ত ঝরেছে ঘামঝরা মেহেনতি মানুষের

হিংসার অপদেবতা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী শিল্পাঞ্চলবারো কুন্ড সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীদের হামলার কতজন শ্রমিক শ্রমজীবী মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তার সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। জন্য কয়নি ঘাম এই ছোট্ট এলাকায় ঘর বেঁধেছিল তাদের কজনের দেহ থেকে রক্ত ঝরেছে। কিন্তু ঘটনার ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা সম্বন্ধে আলোচনা টুকুর খবর রাজধানী ঢাকা শহরে এসে পৌঁছেছে তা থেকে অনুমান করা শক্ত নয় যে, জীবনহানি সংখ্যা নিতান্ত গল্প নয়। কিন্তু এই ব্যাপক জীবনহানি জন্য দায়ী কে। কোন সে বিষয়ে থেকে বেরিয়ে এসেছে এই সরীসৃপের দল যাদের দংশনে মুহূর্তে বিপর্যস্ত হলো এতগুলোর সংসার। ন’মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্ত ঝরানো মেহনতী মানুষের দল যখন নবলব্ধ স্বাধীনতাকে ফলপ্রসূ করে তোলার জন্য সমৃদ্ধতর জীবনের কামনায় সদস্য পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, প্রাণ প্রতীম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে তোলার মহান ব্রত গ্রহণ করেছিলেন তখন কোন সে মহাশক্তি ধর গোত্রী যারা। কাপুরুষ তাকে আশ্রয় করে আশঙ্কিত হামলায় তাদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল।
আমরা এর আলামত লক্ষ্য করছিলাম সেই স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে। জনগণকে তাই বিভিন্ন সময়ে এই বিবরাশ্রয়ী স্বাপদদের সম্বন্ধে সজাগ করে দিয়েছি। কারণ এটা বিশ্বাস করবার মতো আদৌ কোনো কারণ ঘটেনি যে, যারা বিগত স্বাধীনতা সংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল অত্যাচার-নির্যাতন আর নিচ থেকে ইতিহাসে একটা নজির সৃষ্টি করেছিল তাদের মানসিকতা কোন পরিবর্তন রাতারাতি ঘটে যাবে। পাকিস্তানের উপনিবেশিক সমাজবাদী সেনাবাহিনীর ময়দান এই গণবিরোধী চক্র স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে একজোট হয়ে আমাদের এই নবলব্ধ স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সেই হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য অন্যান্য অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে তারা অনুসরণ করে চলেছে গণ সরকারের প্রগতিশীল কর্মসূচিসমূহ বানচাল করার জন্য শিল্পাঞ্চলে অশান্তি সৃষ্টি এবং অঞ্চলে অঞ্চলে বিভেদ কায়েম করে একে বিরুদ্ধে অন্যকে লেলিয়ে দেয়ার জঘন্যতম পন্থা। এই ক’মাসে আগেই তারা সে প্রচেষ্টা চালিয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম চটকল আদমজী জুটমিলে। সেখানে দেশ প্রেমিক প্রগতিশীল মেহনতী মানুষের সঙ্গ বদ্ধ প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু টান দিতে বাধ্য হয়। আত্ম পর তাদের এই দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার অপচেষ্টা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সঙ্ঘবদ্ধ দুষ্কৃতিকারীদের হামলায় বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ঘটনার অনুসন্ধানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সুস্পষ্ট এবং স্বার্থহীন ভাষায় তিনি এ ঘোষণা করেছেন অমূল্য এতগুলো জীবনহানির জন্য তারাই দায়ী হোক না কেন তাদের কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হবে। ঘটনার পরদিন তিনি সারাক্ষণ ঘটনাস্থলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। এবং পরিস্থিতি সামগ্রিক অবস্থা সম্বন্ধে নিজেকে ওয়াকেবহাল রাখেন। তার নির্দেশে মন্ত্রিসভার দুজন সদস্য ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলে বিভিন্ন স্তরে লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের প্রতি আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করছি। সেইসঙ্গে সরকারকে শুধু এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চরম শাস্তি দাবি নয় বরং এই সঙ্ঘবদ্ধ দলটির প্রতিটি সভা কে খুঁজে বের করে” বাংলার মাটি থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করার আবেদন জানাচ্ছি। কারণ কোন অবস্থায়ই আমরা এই ঘটনাকে বিচ্চির করে দেখতে পারি না। গুপ্তহত্যা এবং ব্যাপক অরাজকতা সৃষ্টি করে যে সংঘবদ্ধ দলটি দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম নেতারা একটা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আর এই ষড়যন্ত্রের হোতা শুধু দেশী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নয় বরং বিদেশি সমাজবাদী ও হঠকারী মহলও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

পণ্যমূল্য স্থিতিশীলতা

বাংলাদেশ সরকার একটি মূল্য স্থিতিশীল কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটির সদস্য সংখ্যা ছয়। কমিটির চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারী হচ্ছেন যথাক্রমে পরিকল্পনা কমিশনের ডঃ এম, এ, হোসেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডঃ এম, এ, রহিম।
চলতি বছরের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ শেষে এই কমিটি তাঁদের রিপোর্ট দাখিল করবেন। এই রিপোর্টে কোন কোন পণ্যের মূল্য রাশ অথবা স্থিতিশীল করা প্রয়োজন সে সম্পর্কে সরকারকে নির্দেশ দেবে।
পণ্যমূল্য নামক যে ঘোড়াটি বর্তমানে বাজারে দ্রুতগতিতে দৌড়াচ্ছে তার গতিরোধ করা প্রয়োজন। জনসাধারণের জীবনে স্বস্তি ও শান্তি আনার জন্যই তা করা উচিত। একথা আমার আপনার নয় সকলের।
দু’দিন আগে যার দাম থাকে এক টাকা দু’দিন পরে তার দাম বেড়ে হয় চার টাকা। কৃত্রিম পণ্য সংকট, সরবরাহের অভাব ও অন্যান্য কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটে থাকে। পণ্য মূল্য বৃদ্ধির আরও একটি কারণ হলো একশ্রেণীর নয়া টাউট ব্যবসা-বাণিজ্যে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর।
এহেন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যাটির সুষ্ঠু সমাধান অবশ্যই কাম্য। আর এই কারনেই দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হল সর্ব অঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কিসের মত একটা মারাত্মক অবস্থা যেখানে বিদ্যমান সেখানে কোনো ‘মলমে’ কোন কাজ হবে কি? অস্ত্রোপচারের কাজতো মলম দিয়ে চলে না। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুবার বলেছেন যে বাংলাদেশকে লুটেপুটে খাচ্ছে একদল ‘চাটার’ দল। সুতরাং এ চাটার দলকে সমূলে উচ্ছেদ করতে না পারলে কোন কোন পণ্যের মূল্য হ্রাস অথবা স্থিতিশীল করার’ প্রয়োজনে হাজারটি বৈঠক হলেও সমস্যার কোনো সমাধান হবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যে বিষয়ে প্রবণতাটি পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হলো যখনই কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় তখন সমস্যা গভীরে না নিয়ে পাকিস্তানি আমলে মন মানসিকতা নিয়ে ‘একটা কিছু করলাম’ এই মানসিকতা এই জাতীয় বক্তৃতা বিরতি দেয়া। পাট ঠিকমতো রপ্তানি হচ্ছে না তবুও সরকারি সূত্র থেকে খবর বেরুচ্ছে পাট রপ্তানি অবস্থা সন্তোষজনক। শীতের কাপড় গরমকালে কেন আসে তার লম্বা ফিরিস্তি। ন্যায্য মূল্যের দোকানে মাল সমান না থাকা সত্ত্বেও খবর বেরুয় সবই ঠিকমত চলছে। ইত্যাকার এ জাতীয় বক্তৃতা-বিরতি দিয়ে সমস্যাটিকে ধামাচাপা দেয়ার প্রয়াস। আর এটা যে কোন অবস্থাতেই মঙ্গলজনক নয় তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
চন্দননগরে আগুন লাগার কাহিনী কারো অজানা নয়। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য আর তথাকথিত আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো চন্দননগরের আগুন লাগার কেচ্ছা। বর্তমানে ঠিক এমন একটি অবস্থায় চলছে।
দিস্তায় দিস্তায় কাগজ খরচ করে আর যাই হোক পণ্য মূল্য হ্রাস অথবা স্থিতিশীল করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও সুনিশ্চিত করা আর প্রয়োজন হল মন-মানসিকতা ও চরিত্রের পরিবর্তন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!