যুগান্তর
১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ভারতীয় গোলার আওতায় ঢাকা
জওয়ানেরা শহরের উপকণ্ঠে
পরিমল ভট্টাচার্য
যুদ্ধ এখন ঢাকা, দখলদারেরা ভারতীয় কামানের পাল্লার আওতায়। খানসেনা তিনদিক থেকে বেষ্টিত হয় পড়ছে। তাদের স্বরচিত এবং স্বনির্ভাচিত মৃত্যুফাঁদ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।
ভারতের ছত্রী বাহিনী সংগটিত, মুক্তিবাহিনী সক্রিয়। ভৈরববাজার থেকে আগুয়ান একদল জওয়ান নরসিংদী পেরিয়ে রাজধানীর উপকণ্ঠে। আর একদল ধেয়ে আসছে। জেলাসদর টাঙ্গাইল, মির্জাপুর সোমবারই মুক্ত করে জয়দেবপুর।
এটি একটি বিখ্যাত অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির আস্তানা। শীতলক্ষ্যা নদী পাড় হওয়ারও চেষ্টা চলছে। যমুনার বাধাও অতিক্রান্ত। চাঁদপুর বিজয়ী বাহিনী মেঘনা পাড় হয়েছেন দাউদকান্দিতে। মুক্তিবাহিনীরা আছে মিত্রবাহিনীর পাশে।
তিন দিক থেকে তিনটি ইউনিট ঢাকার গায়ে গায়ে।
অবরুদ্ধ ঢাকা শহর থেকে ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদদাতা জানিয়েছেন, ভারতীয় সৈন্য ঢাকার কেন্দ্র থেকে মাত্র ১১/১২ মাইল দূরে। লড়াই এখন প্রায় শহর এলাকাতেই।
দিল্লীতে একজন সরকারি মুখপাত্র বলেছেন, আর একটি দিন কি দুটি দিন মাত্র, তার মধ্যেই ঢাকা এলাকায় আমরা বেশ জোরালো হয়ে এঁটে বসবো।
কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং এখানেই জওয়ানদের দ্রুত অগ্রগতির খবরে দখলদার বাহিনী দিশেহারা। ফিল্ড কম্যান্ডাররা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে পারছেন না। বিমান নেই। গোলন্দাজরাও প্রায় সাবাড়। ট্যাঙ্কই বা কোথায়? সেনাপতিদের মধ্যে আছেন ছয়জন মেজর জেনারেল। বারো তের দিনের লড়াইয়ে বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী ছন্নছাড়া। অথচ যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন দখলদারদের কম করেও ষাট হাজার সেনা ছিল।
পাকিস্তানী দখলদাররা একদিকে ঢাকা মুক্তির লড়াইয়ের বাধা দেওয়ার জন্য ফন্দি আঁটছে। শহরে কারফিউ সমানে চলছে, রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বেসরকারি বাড়িতেও দখলদার সেনারা ঢুকে পড়েছে। ঘন ঘন গোলা ফাটিয়ে তাদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা হচ্ছে। নির্দেশ জারি হয়েছে, এই সেনাদের কেউ বিন্দুমাত্র এদিক ওদিক করলে তাকে গুলি করা হবে। অন্যদিকে ভারতীয় জওয়ানদের কাছে পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পালা সমানে চলছে। সোমবার লাকসাম ও কুমিল্লায় আরও এক হাজার একশ’ চৌত্রিশজন আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের মধ্যে চৌদ্দজন অফিসার ও পঁচিশজন জেসিও আছেন তারা ৫৩ ব্রিগেড, ২৩ পাঞ্জাব, ১৫ বালুচ, ৫২ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ৪৭ ফিল্ড কোম্পানী ইঞ্জিনিয়ার ও ২১ আজাদ কাশ্মীরি রেজিমেন্টের।
ঢাকা ছাড়া খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রাম সেক্টরে তুমুল লড়াই হচ্ছে। খুলনার কাছে তিন দিন ধরে লড়াই চলছে। এখানে ওরা মরিয়া, কারণ শত্রুবাহিনীর পালাবার পথ নেই। ভারতের জওয়ানরা তাদের চেপে ধরেছেন। শত্রু সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। খুলনা যাওয়ার পথ জলাভূমি। এই সুযোগে তারা ভারতের জওয়ানদের বাধা দিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। আর ভারতের জওয়ানরা যতটা সম্ভব কম প্রাণনাশ করে তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিচ্ছেন।
হিলির দিক থেকে ভারতের জওয়ানরা পাঁচবিবি মুক্ত করেছেন। তাদের আর একদল লক্ষ্মীপুর মুক্ত করার পর বগুড়ার শহরতলিতে পৌঁছে গিয়েছেন। বগুড়ায় উত্তরাঞ্চলে পাক বাহিনীর সদর দফতর। লক্ষ্মীপুরে ৩২ বালুচ রেজিমেন্টের চারজন অফিসারকে বন্দী করা হয়েছে।
ভারতীয় জওয়ানরা চট্টগ্রামের পথে সীতাকুণ্ডুর চট্টগ্রামের উত্তর-পশ্চিমে ছত্রিশ কিলোমিটার। চালনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কোন চিহ্ন নেই।
ভারতের জওয়ান ও মুক্তিবাহিনীর লোকজন ঈশ্বরদীর কাছে পদ্মা নদীর উপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বা সারা সেতুর দখল নিয়েছেন। পূর্বে পাবনার দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পাক সেনারা ব্রিজটির তিনটি খিলান ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। পালাবার সময় তারা কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গাড়িও ফেলে যায়।
সোমবার ভারতের বিমান সেনারা ভেড়ামারা, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, রংপুর, ময়নামতি, নরসিংদী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কাছে শত্রু ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালান। গোয়ালন্দঘাটেও শত্রুদের কিছু মোটরবোট ও সেনাবাহিনী বহনের যান ধ্বংস করে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এখনও শত্রুদের দখলে। লড়াই চলছে।
সোমবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লীতে প্রতিরক্ষা দফতরের এক মুখপাত্র বলেন, পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকা মুক্তির লড়াই ঠিকঠিক চলছে। এদিন কলকাতায় পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমাদের বাহিনী ভালভাবে এগোচ্ছেন।’ তিনি ঢাকা অপারেশন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানাতে চান না। প্রতিরক্ষা দফতরের মুখপাত্রও নয়। একজন আমেরিকান সাংবাদিক পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করেন-তা হলে কি ঢাকার খবর ব্ল্যাকআউট করা হচ্ছে?
মুখপাত্র কর্নেল হেসে জবাব দেন, না মশায়। পরিকল্পনা অনুসারে লড়াই হচ্ছে। আগে থেকে সবকিছু বলা সম্ভব নয়।