যুগান্তর
১১ ও ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
দুর্বার গতিতে ঢাকার পথে
হেলিকপ্টার ও স্টিমারে মেঘনা অতিক্রমঃ নোয়াখালী মুক্ত
চালনা ও মঙ্গলা বন্দরে ভারতীয় নৌ-বহর
(সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত)
কলকাতা, ১০ই ডিসেম্বর-ঢাকার পথে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী আজ দুরন্ত মেঘনা অতিক্রম করেছে। মেঘনার পূর্ব পাড়ে আশুগঞ্জ থেকে বিদ্যুৎগতিতে স্টিমার ও হেলিকপ্টারে ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম পাড়ে ভৈরব বাজারে অবতরন করেছে।
এখানে মেঘনা উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত এবং নদীর প্রস্থ দু’মাইলেরও বেশী। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখানে ভৈরববাজারের গুরুত্বপূর্ণ সেতু ভেঙ্গে দিয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর কলাম ভারতীয় সাহায্যে আজ নোয়াখালী মুক্ত করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের উত্তরে নোয়াখালীর মুক্তি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। নোয়াখালীর মুক্তির বিশাদ বিবরণ জানা যায়নি।
চালনা-মঙ্গলা দখল
খুলনার কাছে চালনা ও মঙ্গলা বন্দর আজ মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী মুক্ত করেছে। ভারতীয় নৌবাহিনী এদের সাহায্য করেছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলি আজ সকাল সাতটায় বন্দরে প্রবেশ করে।
ইস্টার্ন কম্যান্ডের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান যে, চাঁদপুর থেকে পলায়নের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর প্রায় ৯০ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে আটক করা হয়েছে।
যশোর সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী খুলনার পথে রূপদিয়া, চেঙ্গুটিয়া, হরিশংকরা, ডাঙ্গামারা দখল করে ফুলতলার কাছাকাছি পৌঁছেছে। ভারতীয় বাহিনী সড়কের উপর একটি অতিকায় ব্যারিকেড বানিয়ে খুলনার উত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের একটি কলামকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই অভিযানে ৩০টি গাড়ী, ৬টি রিকয়েললেস গান ও ৪টি ভারী মর্টার দখল করা হয়েছে।
দিনহাটা থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, রংপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ শহর লালমনিরহাট এবং একটি থানা সদর দপ্তরও পাকিস্তানীদের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই অঞ্চল থেকে পাক সেনাদের এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হয়েছে যে, পাক চমুদের অর্ধভুক্ত পাত্র এবং কাগজের ওপর খাপ খোলা ফাউন্টেনপেনও সেখানে পাওয়া গিয়েছে।
রংপুর সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী দুরা, বরচাংগ্রাম মুক্ত করে বীরগঞ্জকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। রংপুর এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি ব্রিগেড রয়েছে এবং এই ব্রিগেডের সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতিকে কোন কোন জায়গায় অল্প বাধা দিচ্ছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী রংপুর, বিসপাড়া গাইবান্ধা ও সৈয়দপুরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।
ময়মনসিংহ সেক্টরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সৈন্য ছাউনিগুলিকে ভারতীয় বাহিনী সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করেছে এবং শত্রুদের পলায়নের কোন পথ নেই।
ইস্টার্ন কম্যান্ডের মুখপাত্র বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশের তেরশ মাইল সীমান্ত সৈন্য সমাবেশ করেছিল। এখন বিভিন্ন দিক তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় কোন স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিশেষ কোন জমায়েত নেই।
যশোর সেক্টরে কুষ্টিয়া, ভেরামারা ও নবাবপাড়ায় ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের তুমুল লড়াই চলছে।
বাংলাদেশের পূর্বাংশে লাকসামে পশ্চিম পাকিস্তানীরা তুমুল লড়াইর পর পরাস্ত হয়েছে। ২৩ নম্বর পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ানের দু’জন অফিসার ও ৪১৫ জন সৈন্যকে বন্দী করা হয়েছে।
কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের অবরুদ্ধ পাকিস্তানী সৈন্যরা গতকাল সম্ভবত পালিয়ে যাবার পথ খুঁজবার জন্য ভারতীয় বাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ করে। ভারতীয় সৈন্যদের পাল্টা গুলিবর্ষণে ৩০ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে। ভারতের দু’জন মারা গেছে। এখানে পাকিস্তানীরা ট্যাংক ব্যবহার করেছিল।
ময়মনসিংহ, হিলি, কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত
(সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত)
কলকাতা, ১১ই ডিসেম্বর-ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীর সম্মিলিত সেনাদলের অভিযানের মুখে আজ কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর, হিলির পতন হয়েছে।
মেঘনার পশ্চিম পাড়ে ভৈরব বাজার থেকে ভারতীয় বাহিনীর যথেষ্ট অগ্রগমন হয়েছে। কিন্তু এখানে ভারতীয় বাহিনী ঢাকার পথে কতটা এগিয়েছে তা নির্দিষ্টভাবে বলতে ইস্টার্ন কম্যান্ডের মুখপাত্র অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন যে, ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী মেঘনার পূর্বপাড়ে বিভিন্ন দিক থেকে ঢাকার পথে অগ্রসরমান।
খুলনার পথে ভারতীয় বাহিনী নোয়াপাড়া দখল করার পর এখন দৌলতপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে।
ভারতীয় বাহিনী আজকের অভিযানে ছোট বড় ১২টি শহর দখল করেছে এবং ১ জন ব্যাটেলিয়ন কম্যান্ডার, ১৬ জন জেসিও সহ ২ হাজারের বেশী পাকিস্তানী সৈন্যকে বন্দী করেছে।
হিলি শহর মুক্ত
সামরিক বাহিনীর ঐ মুখপাত্র আরও জানান যে, দিনাজপুর-রংপুর খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী পাক-বাহিনীকে ঘেরাও করে রেখেছে। ওখানে আনুমানিক চার হাজার পাকসেনা আছে। তাদের আর বেরিয়ে যাবার কোন পথ নেই।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পাক-বাহিনীর বড় ঘাঁটি বগুড়ায় প্রায় ২০ মাইলের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী আজ দুপুরে পৌঁছে গেছে।
দিনাজপুর ও রংপুর শহর দু’টির যে কোন সময়ে পতন ঘটতে পারে
পাক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি হিলি থেকে স্টাফ রিপোর্টার শ্রীকল্যাণ বসু আরও জানিয়েছেনঃ হিলির নিকটবর্তী বাহাদুনিয়া ও গোবিন্দগঞ্জে যুদ্ধে ১২০ জন পাক সেনা ও একজন অফিসার নিহত হয়েছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় ৪টি পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক কামানসহ দখল করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধের পরিণতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে হিলি, গোবিন্দগঞ্জ, বাহাদুরিয়া, ফুলঝুরি সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হয়েছে।
হতাবশিষ্ট পাকসেনারা সিরাজগঞ্জ হয়ে ঢাকায় পালাবার জন্য মরিয়া হয়ে পথ খুঁজছে।