You dont have javascript enabled! Please enable it!

আনন্দবাজার পত্রিকা
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
চাঁদপুর মুক্ত, চুয়াডাঙ্গা মুক্ত, জওয়ানরা কুষ্টিয়ার উপকণ্ঠে
সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত

মুক্তির নিশান উড়ছে চুয়াডাঙ্গায়। উড়ছে চাঁদপুরে। এদিকে ঝিনাইদহ থেকে এড়িয়ে একটি ভারতীয় বাহিনী কুষ্টিয়ার উপকণ্ঠেও পৌঁছে গিয়েছে।

বৃহস্পতিবার সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম বলেন, রংপুর আর দিনাজপুরের পতন আসন্ন।

এই অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী নতুন করে ঝড় হয়ে নতুন উদ্যমে রংপুরের দিকে এগিয়ে চলছে। আর দিনাজপুর শহরে দশ মাইল ভিতরে কাউঠানগর সেতুর ওপর তীব্র লড়াই চলছে।

কুমিল্লার সন্নিহিত ময়নামতি এখন খান সেনার হাতে। তবে তাদের পালাবার সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ময়নামতি ছাউনির আশেপাশের পাহাড়ে আর শত্রু সৈন্য নেই। ঢাকার ২২ মাইল উত্তর-পূর্বে আশুগঞ্জ ফেরীঘাট মিত্রসেনার দখলে।

যশোহর এলাকায় ভারতীয় সেনা এক হাজার টন গোলাগুলি ফোকটে পেয়ে যায়। পালানোর তাড়ায়, দখলদারেরা এসব ফেলে গিয়েছে। যশোহরের দক্ষিণে রূপদিয়ায় একজন মেজর এবং ৪০ জন সৈন্য নিহত।

ভারতীয় বাহিনী ক্রমে ক্রমে খুলনার দিকে এগোচ্ছে।

ময়মনসিংহ অঞ্চলে মিত্র সেনা জামালপুর সম্পূর্ণভাবে ঘিরে ফেলেছে। যে কোন মুহূর্তে এর পতন হতে পারে।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক প্রেসনোটে বলা হয় : কোন শত্রু যাতে জল পথে পালাতে না পারে সেজন্য নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে নজর রেখেছে।

ভারতীয় বাহিনী এখন মেঘনার তীরে, চাঁদপুরের পূর্বদিকে। সেখান থেকে নদীর উপর নজর রেখে চলেছে। প্রায় ৫০০ পাক সেনাসহ একটি বড় জাহাজকে প্রথমে ট্যাংক থেকে তারপর বিমান থেকে বোমা ফেলে আক্রমণ করা হয়। জাহাজটিতে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে শত্রু সৈন্য নিশ্চিহ্ন করার জন্য রাত্রে আমাদের জওয়ানেরা বিমান পথে আঘাত হানছে।
পাক বাহিনী নদী পথে পলায়নের জন্য বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামের আশেপাশের নদী হয়ে সমুদ্র পথে বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটছে। ভারতীয় বাহিনী এদিন সন্ধ্যার মধ্যে অন্তত সৈন্য বোঝাই তিনটি জাহাজ আটক করে। একটি জাহাজের সৈন্যরা সাদা পতাকা উড়িয়ে ভারতীয় জওয়ানদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

ভারতীয় বাহিনী উত্তরে পলাশবাড়ি, দক্ষিণে চাঁদপুর এবং পশ্চিমে আশুগঞ্জ দিয়ে ঢাকা এলাকায় পাক বাহিনীকে ঘিরে রেখেছে।

পূর্বাঞ্চলের জিওসি লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরোরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জানান, বাংলাদেশের ভিতরে এবং যশোহর ও খুলনার মধ্যে আটকে পড়া পাক বাহিনী মেঘনা ও পদ্মা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। তাদের উপর ভারতীয় বিমান বাহিনী ক্রমাগত বিমান থেকে বোমা ফেলেছে।

জেনারেল বলেন, এখন পাকিস্তানী বাহিনী দু’দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। একটি অংশ রয়েছে হিলির উত্তরে আর অন্যটি বাংলাদেশের দক্ষিণ দিকে। উত্তরে যে বাহিনী আছে তার সংখ্যা এক ব্রিগেড। তিনি বলেন, ভারতীয় বাহিনী পাক বাহিনীকে যশোহর থেকে দক্ষিণ দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে।

জেনারেল আরও বলেন, ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে উত্তর দিক থেকে যে ভারতীয় বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে-তারা ময়মনসিংহ সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে জামালপুর ঘিরে রেখেছে। মেঘালয় সীমান্তের হাদুয়াঘাটের দিক থেকে আর একটি সৈন্যদল ময়মনসিংহ এর দিকে এগোচ্ছে। শ্রীহট্ট এলাকায় লড়াই চলছে।

জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ময়নামতি দুর্গে পাকবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনী ঘিরে রেখেছে। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টেও লড়াই চলছে।

একজন বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জেনারেল দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, শরণার্থীদের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ যেসব যানবাহন দিয়েছিলেন, তার একটিকেও বাংলাদেশের এই অভিযানে নামানো হয়নি।
তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনী ভারত বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে। এছাড়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, আগে থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করা ইত্যাদি ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের কার্যকলাপ যুদ্ধরত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট সাহায্য করছে।

জেনারেল অরোরা আরো বলেন, মুক্তিবাহিনীর লোকজনেরা কয়েকটি থানার ভার হাতে নিয়েছেন এবং স্থানীয় লোকদের দেখাশোনা করছেন।

তিতাস নদী পেরিয়ে অমীয় দেবরায়

আগরতলা, ৯ ডিসেম্বর-তিতাস নদী সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে যেতে দেখলাম পথের দু’ধারে পাক সেনারা পরিত্যক্ত শত শত বাংকার পড়ে রয়েছে। সারা শহর আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। মাইকে মুজিবের গলা শুনে চমকে উঠলাম। মুজিব কি ফিরে এসেছে? না-মুজিব নয়, এ মুজিবের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করা। ঢাকার মাঠে তার ঐতিহাসিক বক্তৃতার রেকর্ডটি চালিয়ে লোকে বারবার তার কণ্ঠস্বর শুনছে।
এখান থেকে আখাউড়া প্রায় ১৩/১৪ মাইল। আখাউড়ার দিকে এগোচ্ছি। দেখি বহু লোক যারা বাড়িঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তারা ফিরে আসছেন। তারা বলেন, গত চার মাসের মধ্যে এই প্রথম গ্রামে ফেরার সুযোগ হচ্ছে। এর আগে পাক সেনাদের ভয়ে তারা আসতে পারেননি।

উত্তর খণ্ডে

শিলিগুড়ি থেকে দীনেন চক্রবর্তী জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনী আজ উত্তর রণাঙ্গণে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সড়কঘাঁটি রংপুর জেলার পলাশবাড়ি ও শাদুল্লাপুর দখল করে নিয়েছেন। সামরিক দিক থেকে এই দুইটি ঘাঁটি দখলের তাৎপর্য বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডে রংপুর-দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার পাকবাহিনী এখন সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ।

কোনদিক থেকে আর পালানোর রাস্তা নেই। যমুনা পেরিয়ে ঢাকা-তাও না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন পদস্থ অফিসার সাংবাদিকদের বলেন, রংপুর জেলার গাইবান্ধার উত্তরে রেলপথটিও তারা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন। ফলে রংপুর ও গাইবান্ধার মধ্যে রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন।

পীরগঞ্জের এগার মাইল দক্ষিণে পলাশবাড়ি এবং পলাশবাড়ির প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব শাদুল্লাপুর। ওই দুইটি ঘাঁটি দখল করার পর আজ মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় জওয়ানরা এখন রংপুর ও দিনাজপুর শহরের দিকে এগোচ্ছে।

অল্পের জন্য

পাকবাহিনীর মেজর জেনারেল নাজির হোসেন ও তার দু’জন বিগ্রেডিয়ার এবং একজন লেঃ কর্নেল গত মঙ্গলবার ভারতীয় জওয়ানদের তোপের মুখ থেকে বেঁচে গিয়েছেন। মেজর জেনারেল হোসেন বগুড়া থেকে রংপুর গিয়েছিলেন শলাপরামর্শের জন্য। পীরগঞ্জ যে ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে সে খবর তারা রাখতেন না। তাই পীরগঞ্জ দিয়ে যখন মেজর জেনারেল বগুড়ার দিকে যাচ্ছিলেন তখন ভারতীয় বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। নাজির হোসেনের গাড়িটি দ্রুতগতিতে বাঁদিকে ঘুরে চলে যায়। কিন্তু পাক বাহিনীর একজন লেঃ কর্নেল মারা যায়।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!