You dont have javascript enabled! Please enable it!

যুগান্তর
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

স্বাগত বাংলাদেশ

সোমবার, ৬ ই ডিসেম্বর, ইতিহাসের এক যুগান্তকারী দিন। অধীর আগ্রহের বাঞ্ছিত অবসান। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে নয়াদিল্লী। প্রায় ৮ মাস আগে স্বার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে যার প্রথম আবির্ভাব, আজ তার পূর্ন অভিষেক সমাপ্ত। নবজাতকের মাথায় কল্যাণ বারি বর্ষন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি। ভারতের ৫৫ কোটী নর নারীর অন্তরের শুভেচ্ছা মেশান রয়েছে তার সঙ্গে। লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী যখন ঘোষণা করছিলেন ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত তখন আনন্দমুখর হয়ে উঠেছিল পরিষদ কক্ষ। দল মত নির্বিশেষে সবার কণ্ঠ গিয়েছিল মিশে। স্বাগ জানাচ্ছেন তারা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রটিকে। উচ্ছল হৃদয়ের এই সাদর অভিবাদন গোটা ভারতের তৃপ্ত বাসনার প্রতিধ্বনি। হয়ত চমক লেগেছে ইসলামাবাদের জঙ্গি শাহির। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে ধ্বংস করার জন্য তারা ছুড়েছিলেন কামানের গোলা। তাদের সি নিক্ষিপ্ত গোলা থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন রাষ্ট্র। ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির সম্ভবনায় সে প্রাণবন্ত। তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনা দুনিয়ার কোন স্বৈরাচারী শক্তি।

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা আপোষে পায়নি, লড়াই করে ছিনিয়ে নিয়েছে। দিতে হয়েছে তাকে রক্তমূল্য। যা সে পেয়েছে তা রাখার জন্য দরকার আরও রক্তের। পূর্বের বাঙ্গালি তার জন্য তৈরি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত। গত ৮ মাস ধরে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছে সে। সীমান্তের ওপার থেকে প্রতিদিন ভেসে আস্তও আর্ত মানুষের বুক ফাটা কান্না, ধর্ষীতা নারীর রক্ষার মিনতি এবং মায়ের কোল জড়িয়ে ধরা অসহায় শিশুর ভয়ার্ত চিৎকার। আবার পরক্ষণেই পাক পশুদের উন্মুক্ত উল্লাসের মধ্যেই মিলিয়ে যেত সব। সীমান্তের বাধ ভেঙ্গে ঘাতকের খাঁড়া কেড়ে নিতে পারেনি ভারত। তাঁদের চোখের জল মুছতে ত্রুটি করেনি এদেশের ৫০ কোটী নর নারী। সাময়িক সান্ত্বনায় ভরেছে ওদের মন। কিন্তু প্রাণে আসেনি শান্তি। স্বদেশ যাদের শত্রু কবলিত তারা কি করে পাথর চাপা দিতে পারেন জীবনের সমস্ত অনুভূতি? আহত সিংহের মত গর্জে উঠেছিল বাঙ্গালি। করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। মুক্তিবাহিনী ধরেছিল অস্ত্র। আঘাতে আঘতে জরজর করে তুলেছিল দখলদার পাক বাহিনীকে। ইয়াহিয়ার অত্যাচারে নিরিস্ত্র জনতার রূপান্তর ঘটেছে জাতীয় সেনাবাহিনীতে। তাঁদের ভরসাস্থল ভারত, ৫৫ কোটি নর নারীর আশির্বাদ তাঁদের পাথেয় এবং স্বাধীনতার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা তাঁদের প্রেরণা। আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত একটি দস্যু দলের সঙ্গে ক্ষীণকায় বাঙ্গালির দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। ওরা গোটা দুনিয়ার বিস্ময় এবং ভবিষ্যৎ মুক্তি সেনাদের স্বার্থ পথিকৃৎ। এদের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্য মিশিয়ে দিয়েছে ভারত। ইয়াহিয়া দিয়েছে তার জঙ্গি উত্তর। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তিনি। জলে, স্থলে এবং অন্তরিক্ষে চলেছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। পশ্চিম রনাজ্ঞন জ্বলছে। জঙ্গি শাহির শোষণ দুর্গ পুড়ে একেবারে ছাই হবার আগে তা নিভবে না। কোনমতেই ভারত এ আগুণ নিভাবে দেবেনা। গত ২৩ বছরের পাক আবর্জনার সে রাখবে না – বর্ত্মান সংগ্রাম – সামন্ততন্ত্রী পাক দস্যুদের নিঃশেষ করার শেষ সংগ্রাম।

ইচ্ছা করে নয়াদিল্লী নেননি এ রক্ত পিছল বন্ধুর পথ। ইসলামাবাদের উন্মাদের দল তাঁদের ঠেলে দিয়েছে এই পথে। আজ ভারত এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সহযাত্রী। মুক্তিযোদ্ধাদের খুন মিশে যাচ্ছে ভারতীয় জওয়ানদের রক্তের সঙ্গে। ওদের সম্মিলিত আঘাত পড়ছে নরপশুদের ওপর। কিসের বন্ধনে বাধা পরেছে অসম সাহসী ভারতীয় জওয়ান এবং দুর্বার মুক্তিসেনা। কোথায় পেয়েছে তারা উল্কার গতি। কেন একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে তাঁদের প্রানেত স্পন্দন? ধর্ম নিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্রী ভারত আদর্শের মূল্য দিতে যানে। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক বদ্ধ জলার মধ্যে বাংলাদেশ ফুটন্ত পদ্ম। তার সারা অঙ্গে রয়েছে গণতন্ত্র। এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার ছাপ। আদর্শের এই ঐক্য চেতনা ভারত এবং বাংলাদেশকে টেনে এনেছে কাছাকাছি। তাই নবীন মাথায় প্রবীণ ঢেলেছে প্রথম অভিষেকের কল্যাণ বারি। তার হাতে পুঁছে দিয়েছে সৌভ্রাতৃত্বের রাখি। আন্তর্জাতিক সমাজের পাদপ্রদীপের সামনে আসার আগেই নব জাতককে গলা টিপে মারতে চেয়েছিল কায়েমি স্বার্থবাদীর দল। দুহাতে তাকে আড়াল করে রেখেছে ভারত। ইয়াহিয়ার অস্ত্র পরেছে তার পিঠে। ভ্রুক্ষেপ করেনি সে। জমির লোভ তার নেই। আদর্শের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সে প্রস্তুত। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানে সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে পশ্চিম পাকিস্তান। এটা প্রত্যাশিত নয়। একসঙ্গে থাকতে পারেন কল্যাণব্রতী ও মানবদ্রোহী দুটি রাষ্ট্র। বাংলাদেশে যারা গণহত্যার নায়ক, যারা লক্ষ লক্ষ নর নারীকে ভিটে ছাড়া করার নিপীড়ক যন্ত্র এবং যারা নারীর ইজ্জত অপহারক তারা নিঃসন্দেহে সভ্য সমাজের অপাংতেয়। পূর্বের নতুন সূর্যকে অভিনন্দন জানাতে ভারত যখন ব্যাস্ত তখন অন্ধকারের জিব গুলি খুঁজে বেড়াচ্ছে বিবরাশ্রয়। রেহাই পাবেনা ওরা। ভারতের স্বার্বভৌম মর্যাদার উপরে আঘাত হেনেছে বর্বরের দল। চরম শাস্তি ওদের পাওনা। কোথায় আছে পাক দোস্তদের শয়তানি চক্র? একসঙ্গে গাঁট ছাড়া বেধে তারা করেছে উন্মত্ত নর্তন। ঠেকাতে পেরেছে কি স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতি? থামাতে পেরেছে কি তারা জওয়ানদের প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত। নির্বোধ ইয়াহিয়া এবং নির্বোধ তার পরিষদ দল। ওদের ধ্বংস অনিবার্য। বাংলাদেশে খুঁড়েছে অত্যাচারী স্বৈরতন্ত্রীর কবর। তাতে ইসলামাবাদের সব নামাবে ভারত। আর এই কবরে মাটি দেবে ভারত এবং বাংলাদেশের সাড়ে ৬২ কোটী নর নারী। এই দুটি রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের বুনিয়াদ পরস্পরের বুকের পাঁজরে গড়া এবং শহিদের তাজা রক্তে সিঞ্চিত। এ বন্ধন অক্ষয় এবং ভবিষ্যতের অপরূপ আলোকে ভাস্মর। স্বাগত সার্বভৌম বাংলাদেশ, স্বাগত তার রাহুমুক্ত জনতা, এবং স্বাগত তার সরকার। জয় বাংলা।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!