You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.05 | আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১, পূর্ববঙ্গে পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা আমার লক্ষ্য- লেঃ জেঃ অরোরা - সংগ্রামের নোটবুক

আনন্দবাজার পত্রিকা
৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পূর্ববঙ্গে পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা
আমার লক্ষ্য- লেঃ জেঃ অরোরা
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ৪ঠা ডিসেম্বর- বাংলাদেশের ব্যপারে ভারতীয় বাহিনীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আজ সাংবাদিকদের বলেছেন, পূর্ববঙ্গ দখল করা ভারতীয় বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। এ সম্পর্কে আমার সরকারের নীতি খুবই পরিষ্কার। আমার সরকার চান, বাংলাদেশে যথার্থ জনপ্রতিনিধিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক।

পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণার অব্যবহিত পরেই পূর্ব খণ্ডে ভারতীয় জোওয়ানরা দুর্বারগতিতে পাকিস্তানী সেনাদের আঘাত দিয়ে চলেছে। আজ সকাল থেকে সন্ধ্যের মধ্যে ভারতীয় জোওয়ানরা স্থলে, জলে ও অন্তরীক্ষে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে চলেছে বলে প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন জানান।
ইস্টার্ন কম্যান্ডের জি ও সি লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আজ কলকাতায় ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের এক সম্মেলনে বলেন যে, ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধানতঃ সামরিক ঘাঁটি, লক্ষবস্তু এবং বিশেষ করে বিমানঘাঁটির উপর আক্রমণ চালিয়েছে।

ভারতের সামরিক অভিপ্রায় সম্পর্কে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশে মোতায়েন পাক সৈন্য বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করাই আমার লক্ষ্য। বাংলাদেশে সংগ্রামরত পাকবাহিনী যুদ্ধ থেকে বিরত এবং আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত আমাদের সামরিক অভিযান চলবে।

বাংলাদেশে ৮০ হাজার পাকসৈন্য
লেঃ জেঃ অরোরার অনুমান বাংলাদেশে চার ডিভিশন অর্থাৎ ৭০ থেকে ৮০ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য আছে। এর মধ্যে দুই ডিভিশন যশোর থেকে বাংলাদেশের পশ্চিম খণ্ডে এবং নাটোর অথবা বগুড়ায় আক্রমণ চালাচ্ছে আর তৃতীয় ডিভিশনটি রয়েছে ঢাকার সামরিক সদরঘাঁটিতে।

তিনটা দিন সময় দিন
যশোরে আক্রমণাত্মক অভিযান সম্পর্কে তাঁর পরিকল্পনা সম্বন্ধে বিদেশী সাংবাদিকরা বার বার প্রশ্ন করতে থাকলে তিনি বলে, আমাকে দয়া করে তিনটা দিন সময় দিন।

লেঃ জেনারেল অরোরা বলেন যে, বয়রার অদূরে ভারতীয় ঘাঁটিগুলির সৈন্যশক্তি গতকাল রাত্রে বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বাংলাদেশে পাক বিমান বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, গত মাসে বয়রায় সংঘর্ষের সময় পাকিস্তানের তিনখানি স্যাবর জেট খতম হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস ভারতীয় বিমানবাহিনী আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশে জঙ্গীশাহীর আর যে কয়খানি বিমান আছে তা খতমের কাজ শেষ করতে পারবে। বাংলাদেশে পাক বিমানবহরকে নির্মূল করতে পারলে আমাদের স্থলসৈন্যদের কাজে খুবই সুবিধা হবে।

তিনি বলেন, কিছুদিন যাবৎই বাংলাদেশের অবস্থা উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে আছে। আমরা কোনো কোনো অঞ্চলে আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক তৎপরতার জন্য সৈন্য পাঠিয়েছে।

লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, তাঁর কিছু আক্রমণাত্মক পরিকল্পনাও আছে। তবে তিনি এখন ফাঁস করবেন না। তবে আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে আক্রমণ করেই পূর্ববঙ্গ রণাঙ্গনের সমস্যার মোকাবিলা করা এবং যত শিঘ্রই সম্ভব পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীকে ‘টিট’ করার চেষ্টা করবেন। এর অর্থ হলো পাক-বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্যে ভারতীয় জোওয়ানরা বাংলাদেশে ঢুকবে।

প্রতিরোধ অতীতের বস্তু
পাকিস্তানী বাহিনীর প্রতিরোধ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, বাংলাদেশে মোতায়েন পাক বাহিনীর প্রতিরোধ এখন অতীতের বস্তু। তিনি বলেন, আগরতলা এলাকায় সব চেয়ে জোর লড়াই চলছে। অন্যান্য এলাকাতেও মোটের ওপর তাই। পূর্ব রণাঙ্গনে কোথাও পাকিস্তানী বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করেছে কিনা- এই প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন, এই ধরনের কোন খবর আমার জানা নেই। তবে পশ্চিম রণাঙ্গনে কোথাও কোথাও তারা সীমান্ত অতিক্রম করেছে।

তিনি বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভার মুজিবর রহমান ও তাঁর দলকে বিপুল ভোটাধিক্যে জিতিয়ে বাংলাদেশের জনগণ চেয়েছিলেন মুজিবরের নেত্রিত্বে গঠিত সরকার। ভারত সরকারও চান বাংলাদেশে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
মূলত মার্কিন ও চীনা অস্ত্র

পূর্ববঙ্গে অবস্থিত পাক বাহিনীর অস্ত্রসম্ভার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, পাক বাহিনী মূলত মার্কিন ও চীনা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লড়ছে। এছাড়া তাদের কাছে কিছু ১০৫ মিলিমিটারের ইতালীয় কামানও পাওয়া গেছে।

তেজগাঁ কুর্মিটোলায় আক্রমণ

ভারতীয় বিমান বাহিনী আজ সকালে যে আক্রমণ চালায় তার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে লেঃ জেঃ অরোরা বলেন যে, ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ একান্তভাবেই সামরিক লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতীয় বাহিনী আজ ঢাকার তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি এবং অন্যান্য স্থানের বিমানঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের উদ্দেশ্যে হচ্ছে পূর্ব রণাঙ্গনে পাক বিমান বাহিনীকে খতম করা। তিনি বলেন যে, আমরা রানওয়ে নষ্ট করছি না এবং পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক কাঠামো বজায় রাখার দিক থেকে প্রয়োজনীয় অসামরিক লক্ষ্যবস্তুও আমরা নষ্ট করছি না।
হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি

তিনি বলেন যে, ভারতীয় বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা এখনও জানা যায় নি। তবে কোন কোন অঞ্চলে ভাল যুদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ভালই লড়েছে। তবে আমি আমার জওয়ানদের কৃতিত্বে গর্বিত।

মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করে অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, গত দু’মাসে তারা যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে তা তারিফ করার মতো।

ভারতীয় বাহিনী মুক্তি ফৌজকে কোন রকম সাহায্য দিয়েছে কিনা এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা তাদের কোন সাহায্যই দিইনি। তবে আমি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে আমার সরকার শীঘ্রই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিশে একই কম্যান্ডের অধীনে থেকে কাজ করা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবেন।