You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.15 | বাংলাদেশ পত্রিকা, ১৫ অক্টোবর ১৯৭১, স্বীকৃতির দাবীতে চাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ পত্রিকা
১৫ অক্টোবর ১৯৭১
স্বীকৃতির দাবীতে চাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের স্বীকৃতির পরিবর্তে শাসক কংগ্রেসের নেতারা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের দিকে ঝুঁকিতেছে, এ সংবাদ আমরাই বাংলাদেশে প্রথম করিয়াছিলাম। কিন্তু এক্ষণে সিমলায় নব কংগ্রেসের সদ্য অনুষ্ঠিত অধিবেশনে বহিবিষকমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং যে বিবৃতি দিয়াছেন তাকে এককথায় বলা যায় বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের প্রতি বেঈমানী। আজকের পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার মীমাংসার কথা উচ্চারণ করাটাই অন্যায় এবং পাপ। যে পাকিস্তান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী মানুষের বিরুদ্ধে ইতিহাসের জঘণ্যতম গণহত্যার অভিযান শুরু করিয়াছে এবং এক্ষণে যে পাকিস্তানী শাসকচক্র সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ও সীমান্ত আক্রমণের প্ররোচনার দ্বারা ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুংকার দিতেছে, সেই বর্বর পাকিস্তানের হিংস্র নেকড়েদের হাতে বাংলাদেশের ভাগ্যকে সাঁপিয়া দেওয়ার কথা আজ চিন্তাও করা যায় না। তাই আজ ইয়াহিয়ার ফ্যাসিষ্ট শাসন ও শোষোণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামকে সব রকমের সাহায্য এবং সহযোগিতার দ্বারা সফল করিয়া তোলাই প্রতিটি ভারতবাসীর একমাত্র পবিত্র কর্তব্য। বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামে ভারতীয় জনগণের এই ইচ্ছা এবং আকাঙ্খাকে ভারত সরকার বাস্তবক্ষেত্রে কার্যকরী রূপদান করিবেন, এইটাই সকলে প্রত্যাশা করে। তাছাড়াও লোকসভা থেকে শুরু করিয়া পশ্চিমবঙ্গের ভেঙ্গে দেওয়া বিধানসভাতেও বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সাহায্যদানের জন্য দলমত নির্বিশেষে যে কনসেনসাস বা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, ভারত সরকার এখনও জনমতের সেই ঐতিহাসিক অভিব্যক্তিকে কেন এবং কার স্বার্থে রূপায়িত করিতেছেন না, চারিদিকে আজ এই প্রশ্নই আলোচিত এবং আলোড়িত হইতেছে। দেখিয়া শুনিয়া অনেকের মনে হইবে, ভারত সরকার যেন তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটা পিছাইয়া আসিয়াছে এবং বাংলাদেশ সমস্যা মানেই হইতেছে উদ্বাস্তু সমস্যা এবং এই উদ্বাস্তুর বোঝা ভারতবর্ষের ঘাড় থেকে নামিয়া গেলেই নাকি ল্যাঠা চুকিয়া যাইবে, প্রধানমন্ত্রী তো এমন কথা খোলাখুলিই বলিতেছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিগুলির মনোভাবও অত্যন্ত সুবিধাবাদী এবং তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই যে যারা নিজের স্বার্থকেই বড় করিয়া দেখিতেছেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক এবং মানবিক অধিকারের প্রশ্নটা তাঁদের কাছে গৌণ।

তাছাড়া যেসব দেশ বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখিতেছেন তাঁরাও অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতবর্ষ কি করে তাই লক্ষ্য করিতেছেন। কারণ ভারত যেখানে এই ব্যাপারে প্রত্যক্ষ শিকার, অর্থাৎ যখন ভারতে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তুর বোঝা আসিয়া পড়িয়াছে তখন ভারতই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিবে ইহাই তো স্বাভাবিক।। তাই ভারতকে স্বীকৃতি দিতে ইতস্তত করিতে দেখিয়া অন্যান্য সহানুভূতিশীল দেশগুলিও একটু থমকাইয়া দাঁড়াইয়াছেন এবং হয়ত ভাবিতেছেন, তা হইলে ব্যাপারটা কি? ভারত নিজেই গড়িমসি করিতেছেন কেন?
স্বয়ং শ্রী শরণ সিং সর্বশেষ যে বক্তৃতা দিয়াছেন এবং নব কংগ্রেস নেতারা ক্রমেই বাংলাদেশ প্রশ্নে যেভাবে ডিগবাজী খাইতেছেন, তাতে আমাদেরও সন্দেহ হইতেছে যে, শেষ পর্যন্ত ভারত সরকারের ভূমিকা এ-ব্যাপারে হয়ত চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতায় পর্যবসিত হইবে। বিশেষত পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম যখন আগের চেয়েও আরও অনেক দানা বাঁধিয়া উঠিতেছে, তখন ভারত সরকারের স্বীকৃতিদানে ক্রমেই পশ্চাদপসরণ মুক্তি-যোদ্ধাদের মনোবলকে দুর্বল করিয়া দিতে উদ্যত হইয়াছে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে দলমত নির্বিশেষে ভারতের সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষের আশু কর্তব্য, ভারত সরকারের উপর জোরালো আন্দোলনের চাপ সৃষ্টি করিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করা। কারণ, নব কংগ্রেসের নেতাদের হাবভাব এবং কথাবার্তার ধরন-ধারণ দেখিয়া আমাদের আরও সন্দেহ হইতেছে যে,’বাংলাদেশ’ ইস্যুটাকে এখন তাঁরা ভারতবর্ষের অভ্যন্তরেই নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাইবার মতলবে আছেন। যেমন, একদিকে উদ্বাস্তুদের জন্য সারা বিশ্বের সম্মুখে কাসুনি গাহিয়া রিলিফ সংগ্রহ করা হইবে আর অন্যদিকে উদ্বাস্তুদের শিখন্ডী করিয়া পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে পন্ড করিয়া দেওয়া হইবে। শুধু তাই নয়, গরিবী হটাওর ব্যর্থতা, মূল্যবোধ বা অন্য যে-কোন অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য যখন বিরোধী দলগুলী, ইন্দীরা গান্ধীর সমালোচনা করিবেন তখনই ভারতবাসীর যা কিছু দুঃখ কষ্ট সব অনর্থের মূল হিসাবে উদ্বাস্তুদের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাইয়া দাওয়া হইবে। তা না হইলে শরণ সিংয়ের মুখে ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ গীত শোনা যায় কেন? কারন যে কোন মূর্খও জানে যে, বাংলাদেশের মুক্তি বা স্বাধিনতা না আসিলে একজন শরণার্থীরাও পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট খাঁচায় বা কাঠামোর মধ্যে ফিরিয়া যাইবে না। সুতরাং উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরৎ পাঠানোটাও যদি ভারত সরকারের গরজ হইত, তবে, তাঁরা সর্বাগ্রে সেই পরিবেশ সৃষ্টির দিকেই ঝুঁকিতেন অর্থাৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেন। কিন্তু এখনও তেমন কোন পদক্ষেপের নমুনাই তো আমরা দেখিতাছি না। অতএব উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরত যাওয়া সম্বন্ধে ভারত সরকারের উদ্বেগও যে কতখানি আন্তরিক, সে বিষয়ে গভীর সন্দেহ সৃষ্টি হইতেছে না কি? বিশেষত যখন শোনা যাইতেছে যে, বাংলাদেশে উদ্বাস্তুদের শিখন্ডী করিয়া ‘গরিবী হটাও’ এর প্রধানমন্ত্রী আগামী বাজেটে আরও ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ট্যাক্সের বোঝা চাপাইতে উদ্যত হইতেছেন তখন বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরাই শুধু নন, ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষেরও যে প্রাণান্তকর অবস্থা সৃষ্টি হইবে তাতে আর সন্দেহ কি?

সুতরাং এই পরিস্থিতিতে আমরা ভারতবর্ষের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশ্যে পুনরায় সনির্বন্ধভাবে এই অনুরোধ জানাইতেছি, যে অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতির সমর্থনে আপনারা ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়িয়া তুলুন, কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আমাদের স্বার্থও (যেখানে অধিকাংশ উদ্বাস্তুই পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ের উপর) আঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় যদি আজ কোনরকমে বিনষ্ট হয়, তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশরূপে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিও তার সমস্ত জনজীবনের ভবিষ্যতও বঙ্গোপসাগরের অতল জলে তলাইয়া যাইবে।