আনন্দবাজার পত্রিকা
১৩ অক্টোবর ১৯৭১
রাশিয়া-আলজিরিয়া ও বাংলাদেশ
সম্পাদকীয়
প্রচলিত প্রবাদ-যখন রোমে থাকিবে তখন রোমদের মত আচরণ করিবে। সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী শ্রী কোসিগিনও কি অবশেষে সেই পরামর্শ গ্রহন করিলেন? আলজিরিয়া সফরের পর প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের সঙ্গে তাঁহার যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হইয়াছে তাহা পড়িয়া সকলে হতবাক। এমন কি মস্কোর বেসরকারী মুখেও নাকি বিস্ময়ের চিহ্ন। যুক্তবিবৃতিতে বিশ্বরূপ দর্শন উপলক্ষে বাংলাদেশও উল্লিখিত। তবে “বাংলাদেশ” হিসাবে নয়। সেখানকার সাড়ে সাত কোটী মানুষেড় ন্যায্য লড়াই কিংবা ভারতে আগত নব্বই লক্ষ শরণার্থীর কথাও অনুল্লিখিত। বিবৃতি বয়ান অনুযায়ী বাংলাদেশ কার্যত ভারত আর পাকিস্তানের ব্যাপার! দুই রাষ্ট্রনেতার পরামর্শ- ভারত পাকিস্তানের উচিত তাসখন্দ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া সমস্যার ফয়সালা করিয়া লওয়া। স্বাক্ষরকারীরা এমন কি “রাজনৈতিক সমাধানের” প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা দরকার মনে করেন নাই। মাত্র কয় সপ্তাহ আগে প্রচারিত শ্রীমতি গান্ধী ও কোসিগিনের যুক্তবিবৃতি “প্রাভদার” ক্রুদ্ধ লেখালেখি, সমগ্র রাশিয়া-ব্যাপী গণ-আন্দোলন-এ সবের তবে অর্থ কি? সবই কি মায়া? কয় দিন আগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তসংসদীয় সম্মেলনে রূশপ্রতিনিধি নাকি অপ্রত্যাশিতভাবে সম্পূর্ণ বেসুরো গাহিয়াছিলেন। সিমলায় শ্রীচ্যবন ঘোষণা করিয়াছেন-এসব অপপ্রচার। রুশ-ভারত যুক্ত বিবৃতির পর অবান্তর কথায় কান না দেওয়াই ভাল। আলজিয়ার্স হইতে প্রচারিত বিবৃতিতে যিনি সহি করিয়াছেন তিনি কোনও সাধারণ রুশ-প্রতিনিধি নহে স্বয়ং কোসিগিন। এক দলিলে স্বাক্ষরের কালি শুকাইতে না-শুকাইতে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ঘোষণাপত্রে একই হাতে আবার স্বাক্ষর, ব্যাপারটা একটু বেসদৃশ বইকি। মস্কোস্থ ভারতীয় দূত নাকি রহস্যর কিনারা করার কাজে লাগিয়েছেন।
আলজিরিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে উদাসীন হইলে আমাদের কিছু বলার নাই। এমনকি বুমেদিনের সমাজতন্ত্রী সরকার পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর প্রতি দূর্বলতে দেখাইলেও সেটা আজ আর কাহারও কাছে বিস্ময়কর ঠেকে না। সত্য, আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে, এবং একথাও সর্বজনবিদিত সেই লড়াইয়ে ভারত ছিল আগাগোড়া আন্তরিক সমর্থক। কিন্তু তাহাতে বিশেষ কিছু আসে যায় না আলজিরিয়া সমেত অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের মতিগতি ইতিমধ্যেই বোধ হয় তাহা জানাইয়া দিয়াছে। সনাতনপন্থী গোঁড়া ঐশ্লোমিক ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলির কথা বাদই দেওয়া যাক। রাষ্ট্রপুঞ্জে পাকিস্তানের পক্ষে সওয়ালকারী যদি মরক্কো, প্যারিস সম্মেলনে তবে-টিউনিসিয়। পাকিস্তানের প্রতি সৌদি আরব বা ইরানের ভালবাসা আরও গভীর। কিন্তু অন্যদিকে তথাকথিত প্রগতিশিল আরব রাষ্ট্রগুলিই বা কোন ভূমিকায়? উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পর্কে তাঁহারা ওয়াকিবহাল, প্যালেস্টাইনের শরণার্থীরা এখনও নানা দেশের শিরঃপীড়া। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল বলিয়া বর্ণিত রাষ্ট্রগুলিও যে এখনও মৌন অথবা নিস্পৃহ তাহার পিছনে একাধিক কারণ থাকা সম্ভব। সমাজতন্ত্রী অথবা রাজতন্ত্রী, কোন মুসলিম রাষ্ট্রই নাকি চায় না বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হোক, এবং তাহার ফলে একটি “অমুসলিম রাষ্ট্র” ভারতের কোনও রাজনৈতিক সুবিধা হোক। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদির মধ্যে যে বিপুল ফারাক বর্তমান, আরব দুনিয়ার রাজনৈতিক ঐতিহ্যের পটভূমিতে সেটা এখনও সকলের কাছে যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। তৃতীয়ত, অনেকেরই চোখের সামনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমস্যা রহিয়াছে, ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁদের কাহারও কাহারও চোখে সে চেহারা লইয়াই ফুটিয়া উঠিয়াছে। চতুর্থত, বাংলাদেশ বহু দূর! সুতরাং বুমেদিন বা কোনও আরব নেতা যদি একটি ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামকে অন্যভাবে গ্রহণ করতে চাহেন তবে আমাদের বলার কিছু নাই। কিন্তু রাশীয়ার পক্ষে, তাঁহার অভিমতে সায় দেওয়া সম্ভব হইল কী করিয়া? বিশেষত, শ্রীমতী গান্ধীর মস্কো সফরের পরে। মস্কো দলিল কিন্তু “রাজনৈতিক মীমাংসা”, শরণার্থী সমস্যা সবই উল্লিখিত আলোচিত।
হইতে পারে রুশ প্রধানমন্ত্রী আলজিরিয়ার চাপে এই বিবৃতিতে সম্মত হইয়াছেন। হইতে পারে আফ্রিকার ঐ খন্ডে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে অন্য স্বার্থ তাঁহারর কাছে মূল্যবান ঠেকিয়াছে। কিন্তু এ ধরনের কুটনীতি নীতি হিসাবে কি শ্রেয়? এখন টীকাভাষ্যযোগে হয়তো প্রমাণ করা হইবে-ভারত-রুশ চুক্তি বা ইন্দিরা-কোসিগিন যুক্তবিবৃতির ধারাবাহিকতা ইহাতে ক্ষুন্ন হয় নাই, এই উপমহাদেশকে যুদ্ধের বিপদ হইতে মুক্ত রাখিবার জন্যই দুই বন্ধু রাষ্ট্র কোদালকে কোদাল না বলিয়া অন্য কথা পাড়িয়াছেন। তাহাতে রুশ-ভারত বন্ধুত্বে প্রশ্নবোধক চিহ্নটি হয়তো লুপ্ত হইবে, কিন্তু ইত্যবসরে ইয়াহিয়া খানের যে বিস্তার সুবিধা হইয়া গেল তাহাতে সন্দেহ না-রাখাই ভাল। শোনা যাইতেছে, তিনি মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন মিটাইয়া আনিয়াছেন। তিনিই আইন প্রণেতা, তিনিই বিচারক। তা ছাড়া আগেভাগেই তিনি জানাইয়া রাখিয়াছেন-মুজিবুর দেশদ্রোহী এবং মৃত্যুদন্ডই তাঁহার প্রাপ্য। ইয়াহিয়া হয়তো এই মুহূর্তে সে দন্ড মিটাইয়া দিবেন না, আপাতত করুণাময়ের ভূমিকা গ্রহণ করিবেন। তাঁহার এবং জনাব ভুট্টোর চালচলন ইঙ্গিতে বলিতেছে পাকিস্তান বাংলাদেশকে হাতে রাখিবার জন্য চূড়ান্ত চেষ্টা চালাইবে। সে-কাজে তাঁহাদের সমর্থক প্রয়োজন। খানসাহেব নাকি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে গোপনে চিঠি লিখিয়াছেন। আলজিয়ার্স বিবৃতির পর এবার তিনি ইচ্ছা করিলে প্রকাশ্যেই রুশ প্রধানমন্ত্রীকেও চিঠি লিখিতে পারেন। কেননা, বিবৃতিতে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্যও উদ্বেগ প্রকাশ করা হইয়াছে।