You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.27 | হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড,২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, বাংলাদেশ এখন একটি আন্তর্জাতিক প্রশ্ন - সংগ্রামের নোটবুক

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড,২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশ এখন একটি আন্তর্জাতিক প্রশ্ন
– নীতিশ চক্রবর্তী

বাংলাদেশ বিষয়ে নয়াদিল্লীতে সাম্প্রতিককালে হয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তেমন কোনো নাটকীয় ফলাফল আসেনি। এটা তাদের কোনো অর্জন কিংবা তাদের কোনো ঘাটতির পরিচায়ক নয়। বরং বাংলাদেশে সম্পর্কে সাধারনভাবে উদ্বিগ্ন কিছু মানুষের আলোচনায় বসা থেকে কোনো লক্ষণীয় ফলাফল আসবে তা আশা করাই বাতুলতা। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিবেককে নাড়া দেওয়া। পরবর্তীতে এর ফলাফলের উপর এটির সফলতা নির্ধারিত হবে।

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিভীষিকার ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে সব সরকারই শুধু একই রকম আচরন করছে তা নয়, ইসলামাবাদের শাসক জান্তাকে নিয়ন্ত্রন করতে অনানুষ্ঠানিক পর্যায় থেকেও তেমন কিছুই করা হয়নি। পাকিস্তানিদের এমন বর্বরতার বিরুদ্ধে নানা শ্রেণীর নারীপুরুষকে একই কাতারে নিয়ে আসার মাধ্যমে এই সম্মেলন খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি কাজ করেছে। এটি প্রমান করেছে যে বিভিন্ন সরকারের একই আচরন সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ বাংলাদেশের হয়ে যাওয়া ঘটনায় গভীরভাবে ব্যথিত।

আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সংলাপের মাধ্যমে এই সম্মেলন থেকে হয়ত এমন ফলাফল আসবে যা কার্যকরী পদক্ষেপে রূপ নেবে এমন আশার উদ্রেক হয়েছে। বন্ধুর কাছে লেখা ফরাসি লেখক জনাব আন্দ্রে মালরাউক্স এর একটি চিঠি প্রকাশ পেয়েছে যার ফলে এমন সম্ভবনার সৃষ্টি হয়েছে। জনাব মালরাউক্স , যিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শোষকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন, মনে করেন বিভিন্ন প্রস্তাবনার মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদলকে প্রত্যাহত করার চেষ্টাই ফলপ্রসু হবে।

এমন কি জনাব জয়প্রকাশ নারায়ণ এর মত শান্তিবাদী মানুষও বিশ্বাস করেন যে শুধুমাত্র মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করলেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সাহায্য করতে পারে। সম্মেলনে দেওয়া রাষ্ট্রপতির ভাষণে তিনি ১৯৩০ সালে স্প্যানিশ ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো এমন একটি শক্তির ব্যাপারে পরামর্শ দেন। এই পরামর্শ জনাব বিপি কৈরালা তাৎক্ষনিকভাবে সমর্থন দেন যিনি নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং নিজদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য আজীবন যুদ্ধ করে গিয়েছেন ।

এটা খুব অবাক হবার মতো বিষয় নয় যে এই ধারনার খুব বেশী সাড়া পাওয়া যায়নি। এটার একটা কারন এই সম্মেলনের প্রস্তুতিকালিন সময়ে কোনো সশস্ত্র আন্তর্জাতিক যুদ্ধের সম্ভবনার ব্যাপারে সাবধানতার সাথে কোনো নিরীক্ষণ করা হয়নি। এটা সম্ভবত আশা করা উচিত নয় যে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে আসা মানুষেরা এমন আলোচনার মাত্র ৭২ ঘন্টার ব্যবধানে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন।

অংশগ্রহণকারীরা শুধু মাত্র সশস্ত্র যুদ্ধ শুরুর সিদ্ধান্তের প্রজ্ঞার ব্যাপারেই ভিন্নমত পোষন করেননি, এমনও কিছু মানুষ ছিলেন যাদের মতে যে কোনো কারনে অস্ত্রের ব্যবহার সম্পূর্ণ অগ্রহনযোগ্য। আরও সমস্যাজনক ব্যাপার হলো যে, অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের বাইরে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের ধারনার বিরুদ্ধে রয়েছেন। যদি ব্যক্তিগতভাবে না হয়ে থাকে তাহলেও জাতিগতভাবে প্রতিটি গোষ্ঠীই বাংলাদেশের সঙ্কটসমাধানে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করছেন।

এমন একটি সম্মেলনে এরকম ত্রুটি সম্ভবত স্বাভাবিক যা খুব সংক্ষিপ্ততম সময়ের মাঝে আয়োজন করা হয়েছিলো একটি অলাভজনক প্রস্তুতি কমিটির মাধ্যমে যার আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গদের বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের সহানুভূতি ব্যতিত আর কিছুই ছিলো না। বহু দেশেই জাতীয়গোষ্ঠী বাংলাদেশের সমর্থনে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি, তাই প্রস্তুতি কমিটিকে আমন্ত্রনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় শস্য থেকে খড়কুটো সর্বক্ষেত্রে পৃথক করা যায় না।

ভারত সরকারের নিরুত্তাপ আচরন সম্ভবত বহির্বিশ্বে এই সম্মেলনের ব্যাপারে ভুল ধারনা দিয়েছে। তাদের সাথে কনগ্রেস(ডান) এর বাহ্যত অসহযোগিতার কারনে সেই ভুল ধারনা আরও জোরালো হচ্ছে। তারা যদি সন্দেহ করে থাকে এই সম্মেলন সরকারবিরোধী ফোরামে রূপ নিতে পারে, তাহলে এটাই সেই কারন যার জন্য আলোচনার মাধ্যমে সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমন কি বাংলা দেশইস্যুতেও কনগ্রেস (ডান) এবং সিপিআই এর জনসংঘের সাথে একই কাতারে না আসবার ব্যাপারে উদ্বেগ সম্ভবত ভারতের শত্রু পক্ষের এই দ্বিধাকে আরও জোরালো করবে। তা সত্ত্বেও, আয়োজকদের কাজ কঠিন করে তুলতে পারে এমন কিছুই ভারত সরকার করেনি এবং বস্তুত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব শাহ নেওয়াজ খান প্রথম সারিতেই বসে ছিলেন।

অংশগ্রহনকারীদের সংখ্যার ভিত্তিতে এই সম্মেলন কিছুটা পার্থক্যের দাবী করতে পারে। প্রায় ৬০শতাংশ মানুষ ২৩ টি দেশ থেকে নয়া দিল্লীতে এসেছেন এই সম্মেলনে অংশগ্রহন করার জন্য। সংখ্যগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও কিছু উচ্চ পর্যায়ের অংশগ্রহনকারীদের জন্য সে ই ক্ষতি পুষিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন থেকে আসা লক্ষনীয় মাত্রার অংশগ্রহনকারী এটাই প্রমান করে যে নিক্সন প্রশাসন কিংবা টরি সরকারের প্রতি সমগ্র জনগনের সমর্থন নেই।

প্রায় দ্বিতীয় ভিয়েতনামের মত অবস্থায় তৈরী হতে যাওয়া পরিস্থিতির সাথে নিজেদের জড়াতে তাদের দ্বিধা থাকলেও বাংলাদেশ সহিংসতায় বহু সংখ্যক আমেরিকান গভীরভাবে নাড়া খেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন, দুই দেশেরই প্রতিনিধিদল চাচ্ছেন তাদের সরকার ইতিবাচক মনোভাব ধারন করুক যার ফলে ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল শুধরে নিতে পারে। যদিও ফরাসি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সর্বাত্মক সহায়তার আবেদনের জন্য খুব উদারতার পরিচয় দেয়নি।

সম্মেলনের ছয়টি মহাদেশের প্রতিনিধিই ছিলেন কিন্তু তুলনামূলকভাবে এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব ছিলো খুবই করুন। ভারত এবং বাংলাদেশ বাদে মাত্র ৭টি এশীয় দেশের প্রতিনিধি এসেছিলেন। অনেক এশীয় প্রতিনিধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় এটাই ছিলো যে বাংলাদেশের জন্য তাদের অকুন্ঠ সমর্থন রয়েছে। প্রত্যাশিতভাবে নেপালের উচ্চপর্যায়ের একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। সিলনের প্রতিনিধিদলও সমান ভাবেই পাকিস্তানের শাসনের নিন্দা করেছেন।

এমন কি মালয়শিয়ায় প্রতিনিধিও স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পক্ষে মতো দেন। ইন্দোনেশিয়ার দুজন মানুষের দলতির মতামত কিছুটা ভিন্ন ছিলো। একজন সাবেক ইন্দোনেশীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ মোহম্মদ রোয়েম এবং জাতিসংঘে ইন্দোনেশীয় প্রতিনিধিদলের একজন পূর্ববর্তী নেতা ডঃ আবু হানিফার মতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের জন্য বাংলাদেশ যথেষ্ট উপযুক্ত। কিন্তু একটি সার্বভৌম জাতির হিসাবে এর অস্তিত্বের অধিকার প্রশ্নে তারা সমর্থন করবে না।

সম্ভবত সবচেয়ে হতাশাজনক হলেও অপ্রত্যাশিত ছিলো না আরব বিশ্ব থেকে অংশগ্রহনকারীদের অবস্থান। সংখ্যাগত এবং অবস্থানের ভিত্তিতে কম সংখ্যক আরব অংশগ্রহনকারীরা নিজেদের পর্যবেক্ষক হিশেবে উপস্থাপন করেছে , প্রতিনিধি নয়। তাদের মুখপাত্র ডঃ ক্লভিস মাকসুদ খুব গুরুত্ত্বের সাথে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মানুষের মর্যাদার বিষয়ে কথা বললেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে এমন কোনো কিছু বলা থেকে কৌশলে বিরত থেকেছেন। আরবদের পরামর্শমতে যে কোনো সমাধানই অখন্ড পাকিস্তান কাঠামোর ভেতর রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ইস্যুতে ঐক্যমত্যের অভাব হওয়া সত্ত্বেও, এই নিদারুন বিপর্যয়ের উপর বিশ্বের মনযোগ নিয়ে আসতে সম্মেলনটি সফল হয়েছে। বাংলাদেশের গনহত্যার ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের নিন্দাজ্ঞাপন সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দেবে। এটা নিঃস্পৃহ থাকা সরকারগুলোকে কোনো উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত করবে কি না তা ভিন্ন ব্যাপার।

পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী এই ব্যাপারটিতে স্বস্তিতে থাকবে না যে ২৪টি দেশের নাগরিকেরা কোনো বিরোধীতা ছাড়াই শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবী জানিয়েছে যাকে তারা (পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী) দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছে। এর অসাড়তা প্রমাণিত হয় নয়া দিল্লীর সম্মেলনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে জনগণকে চাপ দেয়ার জন্য বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানি কূটনৈতিকদের চেষ্টার মাধ্যমে। বাংলাদেশের মিত্রদের দ্বারা একটি আন্তর্জাতিক পরিষদ এর গোড়াপত্তন স্বাধীনতার আশার আলোকে আরও উজ্জ্বল করবে। যদিও প্রক্রিয়াটি শ্লথগতির এবং আন্তর্জাতিক জনমত তৈরীতে জোরপ্রচেস্টা বাংলাদেশ এর উদ্দেশ্যকে সহায়তা করবে।