পেট্রিয়ট, ৫ অক্টোবর ১৯৭১
ইয়াহিয়ার শিখণ্ডীরা পূর্ব বাঙলার নির্বাচন সম্পর্কে নিশ্চিত নয়
ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এখন তার উপর বসে আছেন। তিনি বলেছেন যে পূর্ববাংলার জাতীয় পরিষদের ৭৯ টি আসনের নির্বাচন ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে।
মনোনয়নপত্র দাখিল এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে এই ফাঁকির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে এটি নতুন নির্বাচনী আইন তৈরির জন্য প্রয়োজন। জনাব ভুট্টো ইতোমধ্যে অভিযোগ করেছেন যে নতুন ভোটার তালিকার প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে “প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে”। যে কোনো ক্ষেত্রে, তালিকা শুধুমাত্র একটি একাডেমিক আগ্রহের ব্যাআপ্র হতে পারে।
জান্তা শুধুমাত্র নিশ্চিত হতে চায় যে তার নিজের লোকেরা “নির্বাচিত” হয়েছে। নির্বাচনের বলবিজ্ঞানের বিষয়ে বা তাদের ন্যায্যতা বা স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বা এগুলোর উপর কোন আলোচনা বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুপস্থিত। জামাত-ই-ইসলামির মতো একটি স্টুডিও পার্টিও মনে করে না যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
অসম্ভব
পূর্ববাংলার জামাত-ই-ইসলামির প্রধান গোলাম আযম বলে যে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে কোন নির্বাচনী ইঞ্জিনিয়ারিং বা রাজনৈতিক কার্যক্রম করা অসম্ভব হতে পারে।
দৃশ্যত শাসকগোষ্ঠী এই অসুবিধা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন বলে মনে হয়। তাই পুতুল গভর্নর ড এ এম মালিকের কথা উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, “সময়সূচী অনুযায়ী নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারে না যে এটা সময়ের মধ্যেই হবে। “
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বারা লক্ষ্য করা যায় এমন আরেকটি সঙ্কটও এখানে রয়েছে। এই বক্তব্যের অর্থ এই যে, খুব শীঘ্রই বাংলাদেশে আরো অনেক বেশি উপনির্বাচন প্রয়োজন হতে পারে। পাকিস্তান টাইমস, লাহোর এবং পাকিস্তান অবজারভার, ঢাকার, মত কাগজপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৮৮ জন সদস্যের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোক সরকার কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে এবং তারা এই শাসকের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করতে ইচ্ছুক।
পাকিস্তান টাইমসের একজন কলামিস্টের মতে, “পূর্ববাংলার সমগ্র অঞ্চলে নতুন নির্বাচন” প্রয়োজন। তবে, সরকারী যন্ত্র শুধুমাত্র ৭৯ টি আসনের জন্য উপনির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করেছে, যা ইতিমধ্যেই খালি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ নির্বাচনের প্রক্রিয়া প্রসারিত করা হবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন যে, যদি নির্বাচন শেষ না হয় তবে জাতীয় পরিষদের আসন পূরণ হবে না এবং ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রশ্ন উঠবে না।
পাকিস্তানি পত্রিকা নওয়াবদ নাস্রুল্লাহ খানকে উদ্ধৃত করে বলেছে যে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন পূর্ববাংলাতে চলমান সংকটের প্রধান কারণ। তাঁর মতে পূর্ববাংলাতে সমস্যা ঠেকাতে যদি একটি যৌক্তিক প্রচেষ্ট করা হতো তাহলে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যেত।
অনুগত অভিযোগ
“কিন্তু জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রায়শই শক্তিশালী কিছু কাজ করে। বাংলাদেশে স্বাধীনতাকামী বাহিনীকে চূর্ণবিচূর্ণ করার চেষ্টা এখনও পর্যন্ত সফল হয়নি।”
পূর্ব বাংলার মৌলভি ফরিদ আহমেদ আরও একটি পদক্ষেপ এগিয়ে গেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন যে “পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তিশালী দলগুলো পূর্ববাংলার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহকে সহায়তা করছে।” মৌলভী ফরিদ আহমেদ যাকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক পাকিস্তান শান্তি ও কল্যাণ বিষয়ক কাউন্সিলের সভাপতি করেছে। এটি পাকিস্তানের প্রো-মিলিটারি পত্রিকা লাহোর ইমরোজ এবং জাং অব করাচির মত পত্রিকায় এসেছে। তিনি বলেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিতে পারে।
পূর্ববঙ্গে নিজাম-ই-ইসলাম পার্টির সভাপতিত্বকারী মৌলভি ফরিদ আহমেদ দাবি করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি শক্তি আওয়ামী লীগকে আর্থিকভাবে, বস্তুগতভাবে অ নৈতিকভাবে সাহায্য সহায়তা করছে – সরকারের কাছে সত্যিকারের তথ্য রয়েছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি কারণ সে মনে করে তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে মৌলভি ফরিদ আহমেদ বলেন যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের প্রভাবের অধীন মুক্তিবাহিনীর হামলা বেড়েছে – সৈন্যবাহিনী বীরত্বপূর্ণ কাজ করা সত্ত্বেও প্রতিটি পদক্ষেপে জীবন ও সম্পত্তি বিপদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
মৌলভি ফরিদ আহমেদ আরও বলেন যে গত কয়েক মাস ধরে শত শত প্রো-পাকিস্তানী “দেশপ্রেমিক “কে আওয়ামী লীগের গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।
মৌলভী ফরিদ আহমেদ এর বিবৃতি দুটি কারণে কারণে তাত্পর্য বলে অনুমান করা যায়। প্রথমত, এটি বাংলাদেশের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের মহান সহানুভূতি প্রকাশ করে। এটি সরকারের শাসনের দাবি মিথ্যা বলে দেয় যে বাংলাদেশের সমস্যাটি “দুষ্কৃতিকারীদের” দ্বারা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মৌলভি ফরিদ আহমেদ পরিষ্কারভাবে স্বীকার করেছেন যে পূর্ববাংলার প্রতিরোধ আন্দোলন অনেক বেশি শক্তিশালী হচ্ছে এবং মুক্তিযোদ্ধারা শত শত সহযোগীকে (রাজাকার) টার্গেট করে তাদের নিষ্ঠুরতার লক্ষ্যে পরিণত করছে।