আনন্দবাজার পত্রিকা
৯ অক্টোবর ১৯৭১
ভারত-রুশ চুক্তির প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন
চ্যাবনের প্রস্তাবে সভায় ঐকমত্য
কৈলাশনগর, সিমলা, ৮ই অক্টোবর (পি টি আই)- আজ বিকেলে নিখিল ভারত কংগ্রেস (শো) কমিটির উদ্বোধনী অধিবেশনে ভারত-রুশ চুক্তির সমর্থনসূচক প্রস্তাবটি সর্বসম্মত ভোটে গৃহীত হয়েছে।
তিন ঘন্টাব্যাপী এই বিতর্কে প্রস্তাব উত্থাপক শ্রী যশোবন্তরাও চ্যাবনের ভাষণের পর সমস্ত সংশোধনী প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়। শ্রী চ্যাবন বলেন, সংশোধনী প্রস্তাবে বড় রকমের কোন হেরফেরের কথা ছিল না; সদস্যরা বিপুলভাবে মূল প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানান।
উদ্বোধনী অধীবেশনে ভারত-রুশ চুক্তির সমর্থনসূচক প্রস্তাব পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী শ্রী যশোবন্তরাও চ্যাবন বলেন, এই চুক্তি হল দুই সার্বভৌম, সমান ও বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তির দ্বারা বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের স্বাধীন নীতি অনুসরণের পথে কোন বাধার সৃষ্টি হবে না।
শ্রী চ্যাবন বলেন, এ চুক্তি কোন দেশের বিরুদ্ধে নয়; তবে ভারতের বিরুদ্ধে যে দেশ কোন অভিসন্ধি পোষণ করে তার এত ভয়ের কারণ আছে।
এই চুক্তি দ্বারা এও প্রমাণ হয়েছে যে, ভারত মিত্রবাহিনী নয়।
চুক্তির যে অনুচ্ছেদে আছে,-‘কোন তৃতীয় রাষ্ট্র দ্বারা চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয়ের একের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা দেখা দিলে উভয়েই তার মোকাবেলায় এগিয়ে যাবে,’শ্রী চ্যাবন সেইটি পাঠ করে শোনান। এই চুক্তিকে শ্রী চ্যাবন ভারত-রুশ সম্পর্কের ইতিহাসে ‘এক যুগান্তকারী’ ঘটনা বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, এটা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, পরন্ত দুই রাষ্ট্রের দীর্ঘ সম্পর্ক ও ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বেরই চূড়ান্ত ফল। রাষ্ট্রদ্বয় বিভিন্ন রাজনৈতিক পদ্ধতির অনুসারী হলেও বিশ্বশান্তি, স্বাধীনতা এবং নব জাগ্রত রাষ্ট্রগুলির আর্থিক প্রগতির প্রশ্নে ভারত ও রাশিয়ার লক্ষ্য এক এবং অভিন্ন।
শ্রী চ্যাবন বলেন, সমগ্র দেশ এই চুক্তিকে অভিনন্দন জানিয়েছে, সংসদে বিপুল সংখ্যক সদস্য সমর্থন জানিয়েছেন। কিছু লোক এই চুক্তির বিরূপ সমালোচনা ও করেছেন। তবে এসব ব্যক্তি সরকারের সমস্ত প্রচেষ্টারই সমালোচনা করতে অভ্যস্ত। বিদেশেও দু-একটি ছাড়া (এরা হয়ত ভারতের প্রতি বেরীভাবাপন্ন) প্রধান প্রধান রাষ্ট্র সমেত সবাই এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী চীন ও এই চুক্তি ‘কল্যাণকর’ দিক অনুধাবন করতে রাজি বলে শ্রী চ্যাবন উল্লেখ করেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, এ চুক্তি কেবল ভারতের সুবিধার জন্যই নয়, এতে অন্য দেশের অধিবাসীরাও উপকৃত হবেন। ভারতের মত রাশিয়ার জনগণও এই চুক্তিকে বিপুল ভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই চুক্তির ফলে ভারতের গোষ্ঠীনিরপেক্ষ নীতির কোনই তারতম্য হবে না। অথচ বিরূপ সমালোচকরা বলেছেন এই চুক্তি ভারতের গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির অবসান ঘটাবে।
ঐতিহ্য অনুসারে বন্দেমাতরম সঙ্গীত সহযোগে আজ বিকেলে নিখিল ভার কংগ্রেস (শো) কমিটির তিনদিনব্যাপী অধিবেশনের উদ্বোধ্ন হয়।
সুসজ্জিত মঞ্চের ওপর কংগ্রেস সভাপতি শ্রী ডি সঞ্জীবায়া, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রী জীবন রাম, উমাশঙ্কর দীক্ষিত, যশোবন্তরা ও চ্যাবন, ব্রক্ষ্মনান্দ রেডডি এবং মোহনলাল সুখাড়িয়া সমেত ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা উপবিষ্ট ছিলেন।
মঞ্চের পিছন দিকের প্রাচীরে পুষ্পশোভিত মহাত্মা গান্ধীর ছবির দুপাশে দুই প্রাক্তন নেতা পরলোকগত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ছবি রাখা হয়।
সাগরতল থেকে ছ হাজার ফুট উঁচুতে সবুজ বনানীতে ঘেরা এই পার্বত্য অধিত্যকায় প্রায় দু হাজার দর্শকের উপযোগী প্যান্ডাল অধিবেশনের উদ্বোধনকালে পরিপূর্ণ ছিল। বহু দর্শক বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে অধিবেশনের গতিপ্রগতি স্থির মনোযোগে লক্ষ্য করেন।
বালিকার দল জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য মাইকের সামনে আসার সময়ও একদল সাধারণ ও মুভিক্যামেরাম্যান মঞ্চে সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী প্রমুখের চাবি নিতে থাকেন।
উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর একটি দল চিরাচরিত পোষাক পরা হিমাচল প্রদেশের একদল যুবক ও যুবতী এই রাজ্যের সুখসৌন্দর্য বর্ণনাগীতি গেয়ে শোনান।
স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা,
ইউ এন আই জানাচ্ছেন, অধিবেশনের শুরুতে পরলোকগত স্বাধীনতা সংগ্রামী ডঃ সৈয়দ মাহমুদ ও বিনোদানন্দ ঝারের উদ্দেশ্যে শোক প্রকাশ করা হয়।
সাধারণ সচিব ডঃ শঙ্করদয়াল শর্মা শোক প্রস্তাব আনার পর প্রতিনিধিরা দু মিনিট শোকস্তবদ্ধতা পালন করেন।
পরলোকগত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিহারের কংগ্রেস নেতা এম পি সিংহের স্মৃতির প্রতিও শ্রদ্ধা জানান হয়।
সভাপতির ভাষণ,
অধিবেশনের উদ্বোধন করে সভাপতি শ্রী সঞ্জীবায়াও ভারত-রুশ চুক্তির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই চুক্তি সত্ত্বেও আমরা আমাদের গোষ্ঠী নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে যাব। আমরা অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও এই ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চাই শ্রীমতি গান্ধী যে গত মাসে নানা কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া সফর করতে পেরেছেন তাতে সুফল ফলেছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে রূশ প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রাজনৈতিক সমাধানের দাবী ঘোষণা করেছেন। বর্তমানে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দেশের সমস্যা সম্পর্কে শ্রী সঞ্জীবায়া বলেন, বন্যা নিরোধের জন্য সরকারকে স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। জনগণের সমস্যার প্রতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে সজাগ করার দায়িত্ব নেবার জন্য তিনি কংগ্রেস কর্মীদের প্রতি আহবান জানান।