You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.09 | হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, ইউরোপে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি - সংগ্রামের নোটবুক

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ইউরোপে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি

আগামী মাসে মিসেস গান্ধীর, উল্লেখ্যযোগ্য পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা পরিদর্শন হবে, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভুমিকার যথাযথ প্রেক্ষাপট। জনগনকে দমন করতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পুর্ব বাংলায় যাওয়ার ৫ মাসেরও বেশি সময় পরে কূটনৈতিক কার্যক্রমের এক অদ্ভুত চিত্র উপস্থাপন করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল থেকে দূরে নির্বাসিত হওয়া, জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার বিজয়ী হবার পথে গ্রহনযোগ্যতা বেশ ভালোই।

সামান্য কৌশল
বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমা মনোভাব বোঝার জন্য, এ কথা অনস্বীকার্য যে, পাকিস্তান বহুলাংশে ইন্দো-পাকিস্তান সমস্যাকে কে একটা বড় ইস্যু করে উপস্থাপন করার ব্যাপারে সক্ষম হয়েছিলো। আর এটা সম্ভব হয়েছে খুব সামান্য কৌশলের মাধ্যমে, এই দুই দেশের মধ্যকার অস্থিরতা চরম মাত্রায় বৃদ্ধির মাধ্যমে, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ট্রাজেডি খুব দ্রুতই নিমজ্জিত হয়ে যায় ইন্দো-পাকিস্তান সমস্যার পিছনে যার ফলে পশ্চিমাদের কাছে বাংলাদেশের সংগ্রাম এর তুলনায় ইন্দো পাকিস্তান সমস্যা আরো প্রকট ভাবে প্রতীয়মান হয়।

পুর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মীদের বর্বরতা ও দমনের মাত্রা সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্ব জানতে পারে সপ্তাহ খানেক , মাস খানেক পর কিন্ত যখন সংঠিত হচ্ছিল তখন নয়। এটা তখনই জানতে পারে যখন লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর ঢল নামে ইন্ডিয়াতে, ভয়াবহ একটা সম্ভাবনা দেখা দেয় মহামারী আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার, এবং এসব কিছুর পরেই পশ্চিমা বিশ্বের দুয়ারে পাকিস্তানী আর্মির ভয়াবহ আগ্রাসনের খবর গিয়ে পৌছায়। শরনার্থীদের নিয়ে কিছু সময় পর্যন্ত সংবাদ শিরোনাম হলেও পরে এই ব্যাপারে আগ্রহ কমে যেতে থাকে, একে পূনর্জ্জীবিত করতে পশ্চিম পাকিস্তানের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ববাংলার জনগন বিদ্রোহ করে। পূর্ব বাংলার মানুষদের এই দূর্ভোগের জন্য অনেক সহানুভুতি, উদ্বাস্তুদের এই অব্যাহত প্রবাহের সাথে মোকাবেলা করতে ভারতের বারতি চাপের জন্য কিছু সহানুভুতি। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের মাত্র অর্ধেক লোকই বিশ্বাস করে যে পাকিস্তানের ভাংগন অপরিহার্য, এমনকি যারা মনে করে যে, পুর্ব বাংলা একদিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব লাভ করবে, কিন্তু তা কত সময়ের মধ্যে সে সম্পর্কেও তারা পরিষ্কার নয়। এদিকে এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানের ২ অংশেরই রাস্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া এবং তাদেরকে এর সাথে ব্যাবসা করতে হবে।
যাইহোক, হোয়াইট হলের বাংলাদেশের সমস্যার ব্যাপারে মনোভাবে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এক ধরনের পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে, যা বলা হয়েছে ঠিক তার মাধ্যমে নয় বরং যা বলা হয়নি তার মাধ্যমে। নতুন কাজের ধরনে, এই পরিবর্তন গুলো প্রতিফলিত হচ্ছে, ইসলামাবাদ কে নিন্দা করার চাইতে বরং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কে তার সীমানা রক্ষা করার ব্যাপারে তারা অনেক বেশি এগিয়ে। অপ্রিয় সত্য কথা বলতে এবং পুর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের দরুন সৃষ্ট নতুন বিপদকে ব্রিটিশ জনগনের সামনে নিয়ে আসতে, এসব রেখে দেয়া হয়েছিল পিটার শো –এর মত শ্রম মন্ত্রী এবং গীর্জার নেতাদের উপর এবং উত্তেজিত সম্পাদকীয় লেখকদের উপর।
পশ্চিমাদের এই নিষেধ, এবং এই নিষেধের মূল বিষয় হচ্ছে যে, ইন্দো-সোভিয়েত সম্পর্কের কারনে কখনোই তারা পাকিস্তানের ভাঙ্গন চায় না।
এমনকি যখন চুক্তি সম্পাদিত হয় বিশ্বের সামনে, বেশির ভাগ পশ্চিমা ইউরোপীয়ানদের ধারনা হয়েছিলো যে, ভারত সোভিয়েত শিবিরে পরিনত হচ্ছে। কিন্তু এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তাদের মন থেকে লম্বা সময় ধরে থাকা সন্দেহ মুছে দিতে যে ভারত অশ্রেনীভুক্ত একটি কাঠামো। সেই সাথে চায়না এবং মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র উভয়েই আছে ইসলামাবাদের পাশে। পশ্চিমা ইউরোপের চ্যান্সেলর রা ক্রমাগত এর মডেল হয়ে উঠেছিলেন।

এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, পশ্চিম পরিদর্শন কালে মিসেস গান্ধী কে তারা, শরনার্থী ইস্যুতে সামান্য সাহায্য করার বদলে তাশুধু চা আর সহমর্মিতা দিবে। পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সেনাদের হস্তক্ষেপ এর প্রলোভনের মুখে, ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ কর্মকর্তারা একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রশংসা করছিলেন মিসেস গান্ধীর সংযত রুপকে, কিন্তু এই প্রশংসা শুধুই ছিল তার জন্য স্বান্তনা। পশ্চিমা ইউরোপের রাজধানী গুলোতে তার এই সফর কেবল একটি বিষয় নিশ্চিত করে যে ভারত কে এই শরনার্থী সমস্যা একাই বহন করতে হবে এবং নয়া দিল্লী সমস্যা উত্তরনের জন্য বহির বিশ্ব থেকে খুব সামান্যই সাহায্য পাবে।

কুটনৈতিক ভাবে মিসেস গান্ধীর এই উদ্দেশ্যপূর্ন সফর সফল হতে ও পারে আবার না ও হতে পারে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী মিলিটারীদের শাষকদের কার্যকলাপ সত্ত্বেও বিশ্বের রাষ্ট্র তাদের নৈতিকতার মানদন্ডে তাদের বিচার করবে বরং করবে তাদের জাতীয় স্বার্থ দ্বারা। এবং পাকিস্তান এই কূটনৈতিক বিজয় কে একটি অসমর্থিত অবস্থানে পরিনত করতে প্রায় সক্ষম হয়েছে।
উদ্বেগের ভান করা

পূর্ব বাংলার সীমান্তের উভয় পাশে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক স্টেশনের ব্যাপারে প্রস্তাবিত পাকিস্তান সরকারের উত্সাহী সমর্থন, ভারত থেকে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ইসলামাবাদের উদ্বেগজনক অবস্থানের কথা প্রকাশ করেছে। পূর্ব বাংলায় ইচ্ছাকৃত ভাবে যে রক্তপাত হয়েছে তার জন্য ইয়াহিয়া খান চালাকী করে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান কে বলির পাঠা করেছেন। এমনেস্টির ঘোষনার সাথে তিনি এখন একজন প্রতীকী বেসামরিক গভর্নর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন।

এ সমস্ত কাজ ছিল একটি কূটনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধনে। জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের উদ্বোধনের পূর্বেই তারা দুই ধরনের উদ্দেশ্য অর্জন করতে চেয়েছিলো, একবার পুনরায় কল ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তান কনসোর্টিয়ামকে সাহায্য করা এবং পুর্ব বাংলার সকল পাপ ধুয়ে পরিষ্কার করা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে পশ্চিম পাকিস্তানের এই লক্ষ অর্জনের জন্য আরেকটি সুযোগ তৈরী হয়েছে।

আংশিক ভাবে, পাকিস্তানের এই কৌশল সম্ভবত পশ্চিমাদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হবে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেষ পর্যন্ত সঠিক পথ বেছে নিয়েছে। পশ্চিমাদের অনেকেই তখন প্রশ্ন করা থামিয়ে দিবে, বেসামরিকের পার্থক্য কি? গভর্নর পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির সাথে সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে মিলিত করে তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখবে। অনেকেই এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না, যে পুর্ব বাংলায় থাকা অবস্থায় শরনার্থীরা শুধু মাত্র শর্ত প্রযোজ্য অঙীকার নামার জোড়ে বাড়ি ফিরে যাবে না। ভারতের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক থাকার দরুন পশ্চিমা স্বার্থে প্রাথমিক ভাবে ভারতকে বাংলাদেশী গেরিলা দের সাহায্য করার ব্যাপারে নিরুৎসাহী করা হয়। এই সাহায্য গেরিলাদের ভারসাম্যের জন্য যথেষ্ট ছিল না, কিন্তু সব শেষে ভারত কে দোষারোপ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
আরো বিশ্বাসযোগ্যতা
মিসেস গান্ধী ইউরোপে তাঁর সাময়িক বসবাসের সময় আবিষ্কার করবেন যে, যদিও ভারত পরিস্থিতির স্বীকার তবুও তাকে পুনয়ায় যুদ্ধের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের কারনে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে কোন সুসংহত পন্থা অবলম্বন না করার জন্য নয়াদিল্লির অ্যাড-হক নীতিকে আংশিকভাবে দোষারোপ করা যায়।

মিসেস গান্ধী সেজন্য তাঁর উপর আরোপিত কাজের চাপ কমিয়েছেন। তিনি শুধুমাত্র তখনই প্রভাব ফেলতে পারবেন যদি তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেখাতে পারেন। সীমান্তবর্তী বিষয় যেগুলো মূল বিষয়টিকে ঘোলাটে করতে পারে সেগুলোর উপর নয় বরং অপরিহার্য বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। এটা ভারতের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল করতে সাহায্য করবে যদি নয়াদিল্লি তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত কি হবে সেটা বুঝতে পারে। ভারত-সোভিয়েত চুক্তি ভারতের জোট নিরপেক্ষতাকে পরিবর্তন করেনি এই ঘোষণায় খুব কম উদ্দেশ্যই সফল হবে। পশ্চিম পাকিস্তান তার নিজের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কথার জোরে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। অবশ্যই ভারতের অবস্থান পশ্চিমের কাছে আরো বিশ্বাসযোগ্য হবে যদি মিসেস গান্ধী বলতেন যে, একটা বিশেষ সময়ে ভারতের জনগণের মনে একটা মনস্তাত্বিক উন্নতিসাধনের জন্য বাধ্যতামূলক অভ্যন্তরীন কারনে তাকে রাশিয়ার সাথে একটি শান্তিচুক্তি করতে হয়েছে।

দ্বিতীয়ত আইনি যুক্তিতর্ক ভারতকে সাহায্য করতে পারবে না। বাংলাদেশ সংকটের অপরিহার্য বিষয়গুলো সকল নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকগণ দেখতে পাচ্ছেন এবং সেগুলোর ওপর জোর দাওয়াই উপযুক্ত হবে। সেগুলো হলো, ভারতের পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানী সামরিক শাসকগনের কর্মকান্ডে একটি ব্যাপক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে এবং একটি সংকট যার সাথে ভারতের কোন সম্পর্ক নেই, লক্ষ্য লক্ষ্য উদ্বাস্তুর রূপে দেশটির উপরে বর্তেছে।

যদি পশ্চিম আশা করে যে এই পরিস্থিতিতে ভারত কিছুই করবে না, তাহলে তারা খুবই অদূরদর্শি। পশ্চিমের মত ভারত সমস্যা থেকে তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না। এটা খুবই কাছে এবং ভীষনভাবে অনুভূত। যদি মিসেস গান্ধী পশ্চিমের নেতাদের সাথে কথা বলেন তো তিনি এমন শর্তে দেখা করবেন যাতে তিনি তাদের সম্মতি না পেলেও শ্রদ্ধা পান। আসুন আমরা এটা মেনে নেই যে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান একই অবস্থান থেকে বাংলাদেশকে দেখে না এবং দেখবেও না।