দি স্টেটসম্যান
১৯ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশ মিশনের ব্যাক্তিবর্গের যাওয়ার অনিচ্ছা
(সুইস প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার)
বাংলাদেশ মিশন প্রধান মি হোসেন আলি সহ ৬৪ জন প্রতিনিধি পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেন। সুইস সরকারের প্রতিনিধি ড বোনার্ড এর কলকাতায় তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তারা পাকিস্তানে ফেরত যেতে চান না।
ডঃ বোনার্ড ছিলেন দিল্লিতে নিযুক্ত সুইস রাষ্ট্রদূতের একজন সদস্য যিনি ৬৫ জন বাঙালি মিশন স্টাফ যারা ইতোপূর্বে কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানী ডেপুটি হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন যাদেরকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছিল কারণ ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার মি কে সি সেন গুপ্ত ও হাই কমিশনের ১৩০ জন সদস্য এবং তাঁদের পরিবার বর্গ গৃহবন্দি অবস্থায় ছিল। মি মেহেদী মাসুদকে পাকিস্তানের নতুন ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবে কলকাতায় নিযুক্ত করা হয় এবং তার স্টাফরা তার সাথে একই রকম আচরণ করেন। অচলাবস্থা কাটানোর জন্য সুইস মধ্যস্থতায় ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ঢাকা ও কলকাতায় নিযুক্ত মিশনের সদস্যের পারস্পরিক বিনিময়ের চুক্তি করা হয়।
চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ মিশনের স্টাফ মেম্বারদের মতামত পরীক্ষার জন্য ড বোনার্ড নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে কমকাতার হিন্দি হাই স্কুলকে বেছে নেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মি এ কে রায় ও মি মাসুদ এর উপস্থিতিতে সুইস কূটনৈতিক ড বোনার্ড মিশনের প্রত্যেক সদস্যকে আলাদাভাবে প্রশ্ন করেন। পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক স্টাফ মেম্বারকে ড বোনার্ড শুধু একটি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটি ছিল ‘আপনি কি পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান নাকি চাননা?যদি আপনি ফিরে যেতে চান তাহলে ভারত সরকার আপনাকে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে সমস্ত নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করবে। দোয়া করে আপনার ইচ্ছার কথা জানান।’
বাংলাদেশ মিশনের ৬২ জন সদস্য তাঁদের সিদ্ধান্ত ড বোনার্ডকে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জানিয়ে ছিল ‘তারা যেতে চান না।’ পাকিস্তানে ফিরে ড বোনার্ড যে পরীক্ষার ব্যাবস্থা করেছিলেন তা মি হোসাইন আলি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে ড বোনার্ড মি মাসুদ এবং মি রায়ের উপস্থিতিতে তার নির্বাচিত স্থানে স্বাক্ষাতকার দিতে রাজি আছেন। বাংলাদেশ মিশন অফিসে আসলে তিনি তাদেরকে আনন্দের সাথে স্বাগত জানাবেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশ মিশন অফিসে মি মাসুদের উপস্থিতি পছন্দ করবেন না।
আচরণবিধি মানাঃ
মি হোসাইন আলি তখন তার দখলে থাকা একটা খালি আবাসিক ফ্ল্যাট এর প্রস্তাব করেছিলেন যেখানে উল্লেখিত টিম তার স্বাক্ষাতকার নিতে পারে; যদিও এটা ছিল মি হোসাইন আলির জন্য নিয়ম রক্ষার বিষয় কারণ তিনি ইতোমধ্যে স্পষ্টভাবে পত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ মিশনের প্রেস সচিব মি ম্যাকসুদ আলি সে সময়ে জলবসন্তে আক্রান্ত ছিলেন এবং তিনি স্বাক্ষাতকার দেবার উপযুক্ত ছিলেন না। ড বোনার্ড এবং তার লোকজন মি ম্যাকসুদের কাছ থেকে ‘নিরাপদ দূরত্ব বজায়’ রেখে তার স্বাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। মি আলি যে উত্তর দিয়েছিলেন তা অন্যদের থেকে আলাদা ছিলোনা। শুধু একজন মিশনের সদস্য কলকাতার বাইরে ছিলেন যিনি যে কোন সময় ফিরে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছিল।
পরে সন্ধ্যায় মি হোসাইন আলি তার অফিসে একটা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন এবং ঘোষণা দেন যে তিনি এবং তার মিশন সদস্যরা মি মাসুদ এর উপস্থিতিতে স্বাক্ষাতকার দিতে সম্মত আছেন; কারণ ঢাকাতে ভারতীয় মিশন অফিসে গৃহবন্দির কারণে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তারা সবাই তার দ্রুত অবসান চান।
মি আলি বলেছিলেন যে কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানী হাই কমিশন অফিসের বাঙালি সদস্যদের বল প্রয়োগ করে পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে যে অভিযোগ সত্য নয়। প্রত্যেক সদস্য বাংলায় লিখিতভাবে উত্তর দিয়েছিলেন তারা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান না। মি হোসাইন আলি বলেছিলেন এটা এখন স্পষ্ট যে পূর্ব পাকিস্তান হাই কমিশনের বাঙালি সদস্যরা স্বেচ্ছায়, আনন্দের সাথে ও মনেপ্রাণে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।
এখানে পাকিস্তান সরকারের দাবি তারা তাঁদের প্রতি বল প্রয়োগের কোন বিষয় নেই। মি আলি বলেছিলেন যে বাঙালিরা যে কারণে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল তা হল পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশ দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি। তিনি বলেছিলেন, আমরা সবাই পাকিস্তান সরকারের প্রতি বাধ্য ও বিশ্বাসী ছিলাম, কিন্তু যদি আমাদের বিশ্বস্ততা পরিবর্তন হয়ে থাকে তবে তা বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের কার্যক্রমের কারণেই হয়েছে।
মি আলি বলেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশ মিশন প্রধান ও তার পদবী রাষ্ট্রদূত বা হাই কমিশনার পদমর্যাদার সমান। এমতাবস্থায়, তার চেয়ে নিচের পদমর্যাদা সম্পন্ন একজন বিদেশী প্রতিনিধি এবং পাকিস্তানী ডেপুটি হাই কমিশনার পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যাক্তির সামনে পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক নন। তাই তিনি তার নিজের পছন্দমত একটি স্থানের প্রস্তাব করেছেন যেখানে তারা আসতে পারেন। তখন তারা আসতে রাজি হন। যেখানে মি আলি তার আনুগত্যের বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করেন।
মাথা নেড়ে আভিবাদনঃ
মি মাসুদ পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে মি আলি এর কনিষ্ঠ সহকর্মি ছিলেন। তিনি মি আলিকে বন্ধুভাবাপন্ন মাথা নেড়ে তাকে অভিবাদন জানান। মি আলি বলেছিলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে নারকীয় ধ্বংস চালানোর কারণে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিকে অভিবাদন জানানোর মত মানসিকতা তার ছিলোনা। তিনি শুধু মৃদু হেসেছিলেন। মি আলি বলেন, ড বোনার্ড যে পরীক্ষা নিয়েছেন তা তিনটি স্থানে সম্পন্ন হয়েছিল।
১। কলকাতার হিন্দি হাই স্কুল ভবন
২। মি আলির প্রস্তাবিত আবাসিক ভবন এবং
৩। মি ম্যাকসুদের বাসভবন।
সকাল ১০-১৫ থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত এই স্বাক্ষাতকারপর্ব স্থায়ী হয়।
বাংলাদেশ মিশনের যে সদস্য আগরতলাতে অবস্থান করছিলেন তার ফিরে এসে স্বাক্ষাতকার দেয়া পর্যন্ত ড বোনার্ড কলকাতায় অবস্থান করেন। মি আলি আশা করছিলেন যেকোন সময় তিনি ফিরে আসবেন।
প্রাথমিকভাবে স্বাক্ষাতকারটি সুইস রাষ্ট্রদূত মি ফিতজ রিয়েল এর তত্ত্বাবধানে হবার কথা ছিল। তিনি অসুস্থ থাকায় ড বোনার্ড সব বাঙালির অনুগত্যের বিষয়ে লিখিত উত্তর সংযুক্ত করে প্রতিবেদন প্রদান করবেন বলে আশা করা যায়। যেহেতু, চুক্তির বিষয়ে আগে থেকেই সবাই অবগত ছিলেন সেজন্য ঢাকায় ভারতীয় মিশনের সদস্যদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে বিলম্বের কোন সুযোগ ছিলোনা।