দি স্টেটসম্যান, ১৯ জুলাই ১৯৭১
পূর্বাঞ্চলে পাক বাহিনীর আত্ম রক্ষামূলক তৎপরতা
– এস চক্রবর্তি
আগরতলা, জুলাই ১৭ – সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে পাকসেনারা সম্ভ্যাব্য গেরিলা আক্রমণ থেকে রাজধানী ঢাকা, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ও চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এসমস্ত সূত্র মোতাবেক, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেনা পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে এবং শুধুমাত্র চট্টগ্রাম – সিলেট সেক্টরে এ সংখ্যা ৭০ হাজারের মত। পশ্চিমাঞ্চলে নিয়োজিত সেনাশক্তি এর চাইতে কম বলে মনে করা হয়।
পাকবাহিনীর, ঢাকা ময়নামতি ও চট্টগ্রামের মধ্যে স্থল গমন পথ সচল রাখার প্রচেষ্টা এপর্যন্ত ব্যার্থ হয়েছে। তিন মাস চেষ্টার পরেও তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সীমান্ত এলাকার সেনাবাহিনীর জন্য জরুরী ও কৌশলগত কেন্দ্রগুলির মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি।
গত মাসে মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৯০ টি সফল গেরিলা ও কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করে। যাতে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। বিশ্বাসযোগ্য হিসাব মতে এসব অপারেশনে ১৭০০ জন পাকসেনা নিহত বা গুরুতর আহত হয় যেখানে মুক্তিবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক কম।
ঢাকায় গেরিলা বাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রায়ই খণ্ডযুদ্ধ হয়। এসময়ে আতংকিত ও ব্যহত নীরব শহর উত্তাল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ২৮ জুন ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর পরই ঢাকা শহরের অনেক গুরুত্তপূর্ন স্থানেই ধারাবাহিক ভাবে গেরিলা আক্রমণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ৩ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ‘পাক বে কোম্পানি’ গেরিলা আক্রমণে ধ্বংস হয়। এখান থেকে অনেক দূরে বসবাসকারী মানুষেরা সারা রাত এখানকার জ্বলন্ত আগুণ দেখতে পেয়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধারা এখন কৌশলগত সেনা অবস্থান গুরুত্তপূর্ন শহর, শিল্পাঞ্চল ও যোগাযোগ ব্যাবস্থার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে করা হয়।
ইতিমধ্যে পূর্বাঞ্চলে পাকসেনাদের কৌশলগত পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। পাকসেনারা এখন তাদের গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি এবং স্থল ও জলপথের যোগাযোগ রক্ষায় বেশি তৎপর। এর ফলে সিলেট ও চট্টগ্রামের মধ্যে কয়েকশত মাইল সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। অসংখ্য ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহত এড়ানোর জন্য কিছু কিছু সুরক্ষিত এলাকার দিকে তারা মনোযোগ দিচ্ছে। আভ্যন্তরীণ এলাকায় শক্তিশালী দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরক্ষাব্যাবস্থা গড়ে তুলছে। সীমান্ত এলাকায় নিয়জিত ছোট ছোট ঘাঁটিতে অবস্থানরত সেনাদের প্রত্যাহার করে তাদের ভেতরের দিকের সুরক্ষিত ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সীমান্তবর্তি যেসব এলাকা থেকে পাকসেনা সরিয়ে নেয়া হয়েছে তার কিছু এলাকায় রাজাকার নামের এক নতুন বেসামরিক বাহিনী নিয়োগ করা হয়। তারা ছিল অবাঙ্গালি ও স্থানীয় চিনহিত সমাজবিরোধী লোকজন। এসব রাজাকাররা মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও তাদের ভয়ে থাকে। এরা মূলত শরনার্থিদের জিনিসপত্র হরণ ও তাদের মেরে ফেলার সাথে জড়িত। তাদের হাতে এপর্যন্ত ৩০০ জন শরনার্থির মৃত্যু হয়েছে।
পূর্বাঞ্চলের মুক্তিসেনারা এখন পাকসেনাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়া উন্নতমানের চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করছে। সুসজ্জিত পাকসেনারা যারা একমাস আগেও গ্রামাঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে ভীতির সঞ্চার করত এখন তারা গেরিলা আক্রমণ ও তাদের সম্ভ্যাব্য ক্ষয়ক্ষতির ভয়ে আতংকিত।
সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া এক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭ জন পাকসেনা কুমিল্লার নবীনগর গ্রামের এক মুসলিম লিগ নেতাকে গেরিলা বাহিনীর হাত থেকে জীবন রক্ষার জন্য এক মাস আগে নিয়জিত ছিল। গভীর রাতে গেরিলারা এখানে আসে এবং তাদের সবাইকে বাইরে আসতে বলে; এর পর বিনা বাঁধায় তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। আমি যখন এখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দেবীপুর সীমান্ত এলাকায় ছিলাম তখন আমাকে আরেকটি কাহিনী বলা হয়। গত শনিবার বিকেল ৩ টায়গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা সিমান্তবর্তি সালদা নদীতে একটি সেনা স্পিড বোটে অকস্ম্যাত হামলা চালায় যেখানে দুইজন মেজর , দুইজন ক্যাপ্টেন ও ৪ জন সেনা সহ মোট ৮ জন নিহত হয়। এরা সবাই সালদা নদীর ঘাঁটি পরিদর্শনে এসেছিল। এলাকা ত্যাগ করার জন্য তাড়াহুড়ায় ছিল ও অকস্ম্যাত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা। অভিযানের সময় গেরিলারা কিছু চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র, ওয়ারলেস সেট ও স্পিড বোট দখল করে। একই সাথে আরেকটি স্পিড বোট ধ্বংস হয়ে যায়।