You dont have javascript enabled! Please enable it!

যুগান্তর
৯ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের হৃদয় হতে

রবীন্দ্র-সদনের মঞ্চে পাশাপাশি দুই কন্ঠশিল্প- মাহমুদুর রহমান, শাহীন আখতার। দু’জনেই বাংলাদেশ থেকে সদ্য আগত; সদ্য বিবাহিত। গাইছেন অতুল প্রসাদের একটি রাগপ্রধান গান-‘এসো হে সজল শ্যাম ঘন দোয়া’। ছোট ছোট ক্ষিপ্রতান ও সরগম-সহ, অনবদ্য সুরেলা, দরাজ গলায়। বাইরে তখন অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।

বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি আয়োজিত অনুষ্ঠানের (৩ ও ৪ জুলাই) বিবরণ দিতে গিয়ে প্রথমেই মনে এল ঐ দৃশ্যটি যা আমাদের স্মৃতিতে পাকা রঙের ছবি হয়ে গিয়েছে। সেদিন ওদের গান শুনাতে শুনাতে সমিতির অন্যতম সম্পাদক শ্রী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ণিত বাংলাদেশের তরুণ প্রাণের প্রতীক নবদম্পতিকে সনাক্ত করে নিতেও আমাদের ভুল হয়নি। আমরা জেনে গিয়েছি : এই সেই প্রণয়ীযুগল, মুক্তিযুদ্ধ যাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। আবার যুদ্ধের আগুনের মধ্যেই অকুতোভয়, যারা মিলিত; পরিণীত। আজ ঘটনার আবর্তে দু’জনেই কলকাতায়। একজন পুনর্বার রণাঙ্গনে যাবার জন্য প্রস্তুত। তিনি সেখানে গেলে অপরজন কি করবেন? শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘গান গাইবেন, এবং গান গাইবেন, এবং গান গাইবেন’।– স্বামীর মঙ্গল-আকাঙ্খায়, দেসের মুক্তির কামনায়।

সমিতির দুই দিনব্যাপী ঐ অনুষ্ঠানের দু’টি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এক, বাংলাদেশের নানা শহর থেকে যেসব গায়ক-গায়িকা, যন্ত্রশিল্পী কলকাতায় এসেছেন অথবা আসতে বাধ্য হয়েছেন, সমিতির উদ্যোগে যাঁরা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, তাঁদের একটি শিল্পীদল হিসাবে কলকাতার দর্শক-শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত করা। দুই, ওই বাংলার শিল্পীদের সঙ্গে এই বাংলার শিল্পীদের অন্তরঙ্গ, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূচনা করা। অনুষ্ঠানসূচী সেইভাবে গঠিত। দুই আসরের সভানেত্রী রূপে আমরা পেলাম শ্রীমতি সুচিত্রা মিত্রকে। দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথির আসনে ছিলেন বাংলাদেশের কূটনৈতিক দূতাবাসের শ্রী হোসেন আলী।

ভিন্নধর্মী এই অনুষ্ঠানে সভানেত্রী শ্রীমতি মিত্র বক্তৃতা দিতে চাননি, দেননি। তিনি আসরে প্রাণ সঞ্চারিত করে দিলেন গান গেয়ে- রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। শুভারন্ত।

প্রথম দিন অর্থাৎ শনিবারের অধিবেশনটি প্রধানত বাংলাদেশের শিল্পীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। একে একে তাঁরা আত্মপ্রকাশ করলেন। প্রথমে শ্রীমতি সানজিদা খাতুন। তাঁর ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’ রবীন্দ্র সংগীতে হামবীর রাগের আকুতি-একটি প্রার্থনার দ্যোতনা। সম্মেলক কন্ঠে (প্রবাল চৌধুরী, তপন বৈদ্য, আবু নওসেদ, অনিল বডুয়া) আনন্দেরই বার্তা ঘোষিত হল: ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি এই অপরূপ রুপে বাহির হলে জননী’ ক্রমে ফ্রোরা আহম্মদ শোনালেন, ‘না গো এই যে ধুলা আমার না এ’ (রবীন্দ্র সংগীত); ডালিয়া নৌশিন ‘ঝরা ফুলদলে’ (নজরুল); কল্যাণী ঘোষ ‘গানে গানে ঢাকা আমার গভীর অভিমান’ (নজরূল); রফিকুল আলম ‘তুমি গাও ওগো গাও মম জীবনে’ (অতুলপ্রসাদ); মাহমুদুর রহমান, শাহীন ‘এসো হে সজল শ্যামঘন’(অতুলপ্রযাদ)।শেষোক্ত দ্বৈত-সঙ্গীতটি অপূর্ব, যার উল্লেখ আগেই করেছি।
লোকসঙ্গীতের আসরে গান গাইলেন মন্মথ বিশ্বাস, মাধবী আচার্য, রথীন রায়।শ্রী রায়ের ভাওউয়াইয়া গান দু’টি এক কথায় অসাধারণ। কলকাতায় এমন লোকগীতি শোনবার অবকাশ বহুকাল আমাদের হয়নি। দোতরা (মন্মথ বিশ্বাস) আর বাঁশির (স্বপন দাস) দ্বৈত-যন্ত্রসংগীতের অনুষ্ঠানটিও আকর্ষক।

প্রথম দিনের শেষ অনুষ্ঠান; রূপান্তরের গান। ১৯৪৭ সন থেকে দেশপ্রেমের যে গানগুলি পূর্ব পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে এই’৭১ সনে বাংলাদেশে পরিণত করল, সেই সব উদ্দীপক গানেরই একটি অলেখ্য ঐ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত। এর মধ্যে আছে কিছু পরিচিত সংগীত, নজরুল সংগীত। অন্যান্য গীত-রচয়িতার মধ্যে আছেন : গুরুসদয় দত্ত, সলিল চৌধরী, সিকান্দার আবু জাফর, নাজিম মাহমুদ, সারওয়ার জাহান। গানগুলি শৃংখলার সঙ্গে উপস্থাপিত; কখনও একক কন্ঠে; কখনও সম্মেলকভাবে। সম্মেলক গীতাংশই বেশি। বত্রিশ জন কন্ঠশিল্পী এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন; যন্ত্রসংগীতে ছিলেন দশজন।এই বাংলাদেশের ঐ শিল্পীরা যে একটি দলে পরিনত, তার নির্ভুল প্রমান পাওয়া গেল এই ‘রুপান্তরের গান’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সানজিদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হক।

শ্রী দেবব্রত বিশ্বাস এই দিন আমাদের তিনটি রবীন্দ্র-সংগীত শুনিয়েছিলেন : ‘কে এসে যায়’, ‘রুদ্রবেশে কেমন খেলা’, ‘কে দিল আমায় আঘাত’। দরদ দিয়ে গাওয়া তিনটি গানই চমৎকার। কিন্তু মনে হয়, তাঁর গান রবিবারের আসরের জন্য রাখলেই ভাল হত, কারণ ঐ আসরটি ছিল এই বাংলার শিল্পীদের জন্য চিহ্নিত।

রবিবার সকাল ন’টায় দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু। আগের দিন রাত্রে সাড়ে ন’টায় প্রথম অধিবেশন সমাপ্ত হয়। ইতিমধ্যে, বলা বাহুল্য, রবীন্দ্র সদন আর কোনও গোষ্ঠীর দখলে আসেনি। উদ্যোক্তাদের কারও কারও বেশবাসে সামান্য কিছু পরিবর্তন চোখে পড়লেও মনে হল, সমিতির অনুষ্ঠান একটানা চলছে। বিচিত্রানুষ্ঠানের এই আসরের শিল্পীরা সকলেই সুখ্যাত এবং জনপ্রিয়, আবহাওয়াও ছিল অনুকূল, প্রেক্ষাগৃহ তাই ভরে উঠতে দেরী হয়নি।

রবীন্দ্র-সংগীত আর মঝে মাঝে আবৃত্তির বৈচিত্র-এইভাবে পরো তিন ঘন্টা কেমন করে কেটে গেল আমরা জানতেও পারলাম না। শ্রীমতি তৃপ্তি মিত্র ও শ্রী শান্তিদেব ঘোষ রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করলেন; শ্রী শম্ভু মিত্র শোনালেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘মধুবংশীর গলি’; শ্রীমতি অপর্ণা সেন ইরানের কবি নাজিম হিকমতের একটি কবিতার বাংলা রূপান্তর (সুভাষ মুখোপাধ্যায়-কৃত), শ্রীদেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের কবিদের রচনা। ‘ব্লাড ব্যাংক’ কবিতার (এটি আগেও একবার শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় শুনিয়েছিলেন) ‘মাটি অভিমুখে রক্তের চিত্রকল্পটি কি আমাদের রক্ত মুহূর্তের জন্য হিম করে দিয়েছিল, মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশের কোনও ডকুমেন্টারি ছবির কথা’।

রবীন্দ্র-সংগীত শুনলাম প্রায় কুড়িখানি। পূজা, দেশপ্রেম, প্রেম, আত্মনিবেদন এবং একান্ত কিছু অনুভূতির গান। মনে হয়, বেশির ভাগ শিল্পীদের স্বনির্বাচিত। বিচিত্র অনুষ্ঠান যখন, তখন বিষয় বৈচিত্র্যই কাম্য। শুরু করলেন সুচিত্রা মিত্র, শেষ একক শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। মাঝে ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ, নীলিমা সেন, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাগর সেন। প্রত্যেকেই তিনটি করে গান গেয়েছিলেন, পরম আন্তরিকতার সঙ্গে। বিশেষ করে ভাল লাগল : ‘না বাঁচবে আমায় যদি’(সূচিত্রা মিত্র), ‘মম মন-উপবনে’(শান্তিদেব ঘোষ), ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ’ (নীলিমা সেন), ‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক’(অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘তোমারি তরে মা সঁপিনু এ দেহ’ (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)।

দুই বাংলার অর্ধশতাধিক শিল্পীর গান আমরা শুনলাম দুই আসরে। গানের সংকখ্যাও অর্ধশতাধিক। তার মধ্যে রবীন্দ্রস্নাথের গান অন্তত ত্রিশ। তিনিই যে নব বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ।
-সংগীতপ্রিয়।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!