You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.03 | যুগান্তর, ৩ জুলাই ১৯৭১, পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া না দেওয়া - সংগ্রামের নোটবুক

যুগান্তর
৩ জুলাই ১৯৭১
পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া না দেওয়া

সম্পাদকীয়

আমেরিকা আরও অস্ত্র পাঠাচ্ছে পাকিস্তানে। এগুলো ব্যবহৃত হবে বাংলাদেশের মরনযজ্ঞে। বিবেক বলে কোন যন্ত্র নেই মার্কিন কর্তাদের। মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে ঢাকতে চেয়েছিলেন তারা নিজেদের অপরাধ। গত কদিন ধরে প্রচার চলছিল যত নষ্টের গোরা আমলাতন্ত্র। ওরাই অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর ওপর। তার ফাঁক ফোকর দিয়ে অস্ত্র যাচ্ছে পাকিস্তানে। এই ছেঁদা প্রলেপ একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আসল রহস্য বেরিয়ে পড়েছে। খোদ আসামি আমলাতন্ত্র নন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজে। তিনিই খারিজ করেছেন আমালতন্ত্রের পরামর্শ। ব্যাক্তিগত দায়িত্বে অস্ত্র যোগাচ্ছেন ইয়াহিয়া খানকে। অজুহাত পুরনো, পাকিস্তানকে অস্ত্র না দিলে দেশটা চলে যাবে চিনের খপ্পরে। চিনের খপ্পর থেকে পাক জঙ্গিশাহিকে বাঁচানোর জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন ডেকে আনছেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী মানুষের সর্বনাশ। হাতে হাঁড়ি ভাঙছেন শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ। ওয়াশিংটনে তিনি দেখা করেছিলেন মার্কিন কররাদের সাথে। তারা বলেছিলেন বাংলাদেশের সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসলামাবাদের একটা বোঝাপড়া দরকার। কাজের বেলায় দেখা যাচ্ছে অন্যরকম। বোঝাপড়ার বদলে বাংলাদেশকে সাবাড় করার মদদ দিচ্ছে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট আইনেজ হাওয়ারের আমলে নিক্সন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি তখন রিপোর্ট দিয়েছিলেন, জোট নিরপেক্ষ ভারতকে বিশ্বাস নেই। পাকিস্তানই সত্যিকারের বন্ধু। তাকেই দেওয়া উচিত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সাহায্য। তারপর দুনিয়া চেহারা অনেক বদলিয়েছে। পদে পদে ধরা পড়েছে মার্কিন মূল্যায়নের ভুল ভ্রান্তি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন শিখেন নি কিছু। সাবেকি মন দিয়ে তিনি ধরে আছেন মার্কিন প্রশাসন তরীর হাল।

নয়াদিল্লী রাগে ফেটে পড়েছে। ভারতীয় জনমত উত্তাল। কিসিঞ্জারের স্বস্তিবচনে জনতার উষ্মা বাড়ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং দিশেহারা। বড় আশা নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকায়। অগাধ বিশ্বাস ছিল তার মার্কিন রাষ্ট্রনায়কদের উপর। শেষ পর্যন্ত তার কপালে জুটল বিশ্বাসঘাতকটা। যা বলছিল তা করল না আমেরিকা। ভারতে আগত শরনার্থিদের জন্য ওয়াশিংটন দেবেন টাকা। আর ইয়াহিয়ার শরনার্থি তৈরির যন্ত্রে তারা ঢালবেন অঢেল তেল। এই মার্কিন দ্বৈত নীতি বর্তমান দুনিয়ার নিদারুণ অভিশাপ। ইসলামাবাদে নরপশুদের অকৃত্রিম দোস্ত প্রেসিডেন্ট নিক্সনই নাকি স্বাধীন বিশ্বের জিম্মাদার এবং গণতন্ত্রর অতন্দ্র প্রহরী। দক্ষিণ ভিয়েতনামের জন্য তিনি চান স্বায়ত্তশাসন এবং বাচার অধিকার। আর বাংলাদেশের সম্পর্কে তার বিধান – ইসলামাবাদের জঙ্গি শাহীর ক্রীতদাসত্ব কিংবা সর্বাত্তক সংহার। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধি হৈ চৈ করে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে ওয়াশিংটনের উপর কড়া বাক্যবাণ ছাড়ছেন। তাতে লাভ নেই কিছু। পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন কর্তাদের গোপন আঁতাত দীর্ঘ দিনের। ওঁরা কিছুদেই ছাড়বেন না আশ্রিত খুনিদের। এমন আশ্রিত বাৎসল্যের কাছে বিবেকের বিলাস প্রত্যাশা অর্থহীণ।

এখন কী করবেন নয়াদিল্লী? ইয়াহিয়ার উপর ছাড়বেন না সত্যিকারের কোন আন্তর্জাতিক চাপ। বেঁকে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। মার্কিন জনমত তাকে সিধা করতে পারবে কিনা সন্দেহ। সোভিয়েত রাশিয়ার অবস্থা ধরি মাছ না ছুঁই পানি। অন্য যারা চেঁচামেচি করছেন তাদের প্রভাব সীমিত। আরব দুনিয়ার ধর্মবোধ বড় বেশি জাগ্রত। তাদের দৃষ্টিতে ইসলামিক ঐক্যের ধ্বজাধারী। বাংলাদেশের হিন্দুরা কাফের এবং মুসলমানেরা ধর্মচ্যুত। পাইকারি হারে তাদের নিধন কিংবা বিতাড়নে কোন দোষ নেই। ইয়াহিয়া যদি মুসলমান না হয়ে ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা হিন্দু হতেন তবে হয় আরব নেতাদের টনক নড়ত। আগুনে তাতান বালির উপর ধান দিলে এগুলো যেমন ফট ফট করে ফুটে তেমনি তারা ফুটতেন। নাসেরের মিশর ছিল প্রগতিবাদী বলে পরিচিত। এখন সেখানে কায়েম হয়েছেন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত। তিনি দোস্তি করেছেন পাক সুহৃদ সৌদি আরবের সঙ্গে। ১৯৬৭ সালে খার্তুম চুক্তি অনুযায়ী মিশর পাচ্ছে সৌদির খয়রাতি টাকা। এখন আরও এগিয়ে গিয়েছে প্রেসিডেন্ট সাদত। নাসের বলতেন, আরব দুনিয়ার ঐক্যের ভিত্তি সাধারণতন্ত্র ও সমাজবাদ। আর সাদতের মতে আরবের শক্তির উৎস ধর্ম। সৌদি আরবের বাদশা ফয়সল মহা খুশি। তিনি মিশরকে দেবেন ইজরাইল বিরোধী মদদ। বিনিমিয়ে সাদত জোরদার করবেন ফয়সালের ঐস্লামিকঐক্য অভিযান। কিসের আশায় সময় কাটাচ্ছে নয়াদিল্লী? দুনিয়ায় বিবেক বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। যা আছে তা শুধু সংকীর্ণ আত্মস্বার্থ। ভালো কথার যুগ শেষ হয়েছে। বর্তমান যুগটা শক্তির যুগ। যার বাহুতে আছে বল এবং মনে আছে সংকল্পের দৃঢ়তা তাকেই সেলাম জানাবে দুনিয়া। নিজের পায়ে দাঁড়ান নয়াদিল্লী। স্বীকৃতি দিন স্বাধীন বাংলাদেশকে। দুর্বার করে তুলুন মুক্তিফৌজের সংগ্রাম। এপথেই আসবে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান। এবং শরনার্থিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

সম্পাদকীয়, যুগান্তর, ৩ জুলাই ১৯৭১।