দ্যা স্টেটসম্যান
১৯ জুন, ১৯৭১
ফুলবাড়ি সীমান্তে পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণঃ ৩ জন ভারতীয় আহত
কৃষ্ণনগর, ১৮ই জুনঃ
উক্ত বার্তা অফিস থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরের ফুলবাড়িতে অবস্থিত ভারতীয় সীমান্ত ঘাটিতে আজ পাকিস্তানি বাহিনী লম্বা সময় ধরে শেলিং আক্রমন চালিয়েছে, যা এযাবতকালে তাদের চালানো সবচাইতে বড় হামলা ছিল এবং এ হামলায় তিনজন ভারতীয় গ্রামবাসী ও একজন বাঙালি পলাতক শরণার্থী আহত হন।
আজ ভোর ৪টা থেকে পাকিস্তানিরা আক্রমন শুরু করে এবং প্রায় ৭ ঘণ্টা যাবত তারা গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। তারা আক্রমনে হালকা মেশিনগান, মরটার ও ২৫ পাউন্ডার ব্যবহার করে। যদিও ভারতীয় সীমান্তে এর ফলে কোন ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গেদে, দাহকুলা ও শিকারপুর অঞ্চলেও পাকিস্তানিদের নিক্ষেপ করা শেল পতিত হয়। প্রতিটি স্থানেই ভারতীয় সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনী এই গোলাবর্ষণের উপর্যুপরি জবাব দিয়েছে, এবং এই গুলি বিনিময় আজ রাত পর্যন্ত চলছে।
কুষ্টিয়া অঞ্চলে একটি পাকিস্তানি বিমান সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলো ঘুরে পরিদর্শন করতে দেখা গেলেও, তারা ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি।
এর মধ্যে, আজ বাংলাদেশের দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত কুষ্টিয়া জেলার করাইপারা সীমান্তের দখলে থাকা বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী তাদের ঘাতি ত্যাগ করে তেতুলবাড়িয়াতে অবস্থান নিয়েছে। উক্ত সীমান্ত ঘাটিটি গত ১৬ই জুন তারা দখল করলেও আজ এ অঞ্চলে পাকিস্তানিরা তাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য নতুন অস্ত্র ও লোকবল আমদানি করাতে তারা হঠে যেতে বাধ্য হল। তেতুলবাড়িয়াতে এখন তারা নতুন করে প্রতিরক্ষা ঘাটি গড়ে তুলেছে।
ফুলবাড়ি সীমান্তের ঠিক এপাশের অঞ্চলের নাম কাদিপারা (যা পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলায় অবস্থিত)। আমাদের করিমগঞ্জের বার্তাবাহক বলেনঃ করিমগঞ্জের সীমান্ত থেকে বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধারা ওপাড়ে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে আগাচ্ছে এবং করিমগঞ্জের মানুষ গত বুধবার সকালেও মর্টার ও লাইট মেশিনগানের শব্দ পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
লাটু ও বড়লেখা এলাকার মধ্যবর্তী যে দোলনী ব্রিজ, তা মুক্তিবাহিনীরা উরিয়ে দিয়েছে। শিলুয়া চা বাগানের লোকেরা পাকিস্তানিদের চর হিসেবে কাজ করছিল বলে, মুক্তিযোদ্ধারা বাগানে অবস্থিত চা ফ্যাক্টরিটি উরিয়ে দিয়েছে। এই তথ্যটি পৌছে দিতে দুইজন মুসলিম লীগ নেতা একটি গাড়িতে করে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্পের দিকে যেতে থাকলে, মুক্তিযোদ্ধারা সেই গাড়িটিও উড়িয়ে দেয়ে এবং এই দুই নেতাকে হত্যা করে। করিমগঞ্জ সীমান্তের অপারে সুতারকান্দি এলাকা থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের খবর আসছে। গত ১৫ জুন পাকিস্তানি আর্মিরা করিমগঞ্জ শহরের কাছেই বাংলাদেশে অবস্থিত বালট অঞ্চলে তিনজন হিন্দুকে হত্যা করে ও দুইজন নারীকে ধর্ষণ করে।
আমাদের রাজগঞ্জ এলাকার বারতাবাহক বলেন, তেতুলিয়া এখন সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এবং দিনাজপুরের পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এলাকাতেও তারা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর কঠিন হামলা চালাচ্ছে এবং এর ফলে প্রচুর পাকসেনা হতাহত হচ্ছে। পশ্চিম দিনাজপুর অঞ্চলের টাঙ্গন থেকে বংশিহারি পর্যন্ত নদীতে গুলিবিদ্ধ পাকসেনাদের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যাচ্ছে।
আমাদের আগরতলা অফিস বলছেঃ সীমান্তের ওপার থেকে কিছুটা বিলম্বে হলেও খবর এসেছে যে রামগর এলাকার কেরেরহাটে গত ৯ জুন থেকে প্রায় ৩ দিন ধরে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এতে প্রায় ২০০ পাকসেনা হতাহত হয়। ১১ জুন কেরেরহাটে প্রায় ১৫০ জন পাকসেনার মৃতদেহ প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়। যদিও, ১২ই জুন পাকিস্তানি সেনারা নয়া শক্তিবলে বলীয়ান হয়ে পুনরায় হামলা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে সরে যায়।
মোহনপুর সীমান্ত এলাকার ওপাড়ে অবস্থিত সিলেট অঞ্চলের দক্ষিনাংশে অবস্থিত সিধন এলাকায় প্রায় ২০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে গত মঙ্গলবার সারারাত ধরে পাকবাহিনী নির্বিচারে শেলিং করার গলে মোহনপুর সীমান্ত এলাকায় প্রায় ২০,০০০ শরণার্থী বুধবার প্রবেশ করে, যাদের মধ্যে নারী, পুরুষ শিশু সকলেই আছে, এবং তারা প্রায় সবাইই মুসলিম। সিধন থেকে মোহনপুর এলাকার মধ্যবর্তী পুরো ৮ মাইল রাস্তা জুরেই শরণার্থীদের প্রবাহ দেখা গেছে, এবং তারা পায়ে হেটে আগরতলার দিকে যাত্রা করছেন। শরণার্থীরা বলছেন যে পাকিস্তানিরা এতই বেশি শেলিং হামলা চালিয়েছে যে প্রায় ৩০টির বেশি গ্রাম আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গিয়েছে, প্রায় ৫০০০০ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন এবং হতাহত ও হয়েছেন প্রচুর সংখ্যক মানুষ।
গতকাল ত্রিপুরায় অবস্থিত বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য পাঠানো প্রথম বিদেশী ত্রাণ সরবরাহটি এসে পৌঁছেছে। আজ আগরতলায় কানাডিয়ান বিমান বাহিনীর মাধ্যমে প্রায় ৪৯০০০ পাউন্ড ত্রাণ সহযোগিতা আগরতলায় এসে পৌছায়। এই ত্রাণ সরবরাহে শরণার্থীদের ছাউনি তইরির জন্য পলিথিন শিট, তেরপল, এন্টিবায়োটিক ঔষধ এবং প্রায় ৮ লক্ষ টাকা সমমূল্যের খাদ্যসামগ্রী অন্তর্গত ছিল। ভারত ও নেপালে ত্রাণ পাঠানোর জন্য এই বিমানটি অস্ট্রেলিয়ান সরকার ভাড়া করেছে। অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি ও কনসাল, মিঃ গ্রায়েম কে ই নুনান, যিনি আজ ত্রিপুরা সরকারের কাছে এই ত্রাণ হস্তান্তর করেন, তিনি হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন যে ১৯ জুন থেকে আশ্রয়ী শরণার্থীদের ত্রাণ সরবরাহ করার জন্য পুরো এক সপ্তাহ জুড়ে প্রতিদিন একটি করে বিমান অস্ট্রেলিয়া থেকে আগরতলায় পাঠানো হবে।