You dont have javascript enabled! Please enable it! আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ জুন, ১৯৭১, অনাহারে পথশ্রমে অবসন্ন মৃতপ্রায় শরণার্থী দল - সংগ্রামের নোটবুক

আনন্দবাজার পত্রিকা
৮ জুন, ১৯৭১
অনাহারে পথশ্রমে অবসন্ন মৃতপ্রায় শরণার্থী দল
বিশেষ প্রতিনিধি

– স্যার, একবার বলে দিন, এই স্লিপ কোথায় গেলে রেশন পাব?

কলকাতা থেকে টাকি, টাকি থেকে হাসনাবাদ, হাসনাবাদ থেকে বসিরহাট, বসিরহাট থেকে বারাসাত, বারাসাত থেকে দমদম, তারপর লবণ হ্রদ, তারপর-? শত শত লোক, বৃদ্ধ বৃদ্ধা, যুবক যুবতী, কিশোর কিশোরী এবং শিশু এই একটি প্রশ্ন মুখে নিয়ে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন শিবিরে এরা যাচ্ছে, প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, আবার হাঁটছে, হাঁটছে মাইলের পর মাইল, হাঁটছে দিন রাত। তারপর অনাহারে পথশ্রম, যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, অবসন্ন তারা বসে পড়ছে পথের ধারে। মরছে।

কলকাতার প্রবেশদ্বারেই, সাহারা আশ্রয় শিবিরের সামনে অস্থিচর্মসার এক বৃদ্ধ একটি ভাঙ্গা বাড়ির হাড় পাঁজর বের করা দেওয়ালে হেলান দিয়ে নিষ্পলক চেয়ে আছেন আশ্রয় শিবিরের দিকে। না, এখন তার কোনও চাহিদা নেই, কারণ তিনি মৃত।

রবিবার কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের কয়েকজন চিকিৎসক ডেকে আমাকে দৃশ্যটা দেখালেন। জানা গেল, ওই বৃদ্ধার পদযাত্রা শুরু হয়েছিল খুলনার এক গ্রাম থেকে, আর যাত্রা শেষ হল এই সাহারায়, কলকাতার দ্বারপ্রান্তে।

এ দৃশ্য আজ পশ্চিমবঙ্গের কোথায় নয়? এর, এই আর্ত, ক্ষুদিত, সাজানো সংসার উন্মুলিত লোকগুলো এইরকম দিশাহীন ঘুরছে কেন? মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটির একজন মুখপাত্র বললেন, কী করব? আমাদের শিবিরগুলোর আর কাউকে আশ্রয় দেবার সামর্থ্য নেই। আমরা তাই নতুন লোককে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। আবার ঠিক কোথায় পাঠালে যে ওরা আশ্রয় পাবে, তাও জানিনে। তাই আমরা কোথাও পাঠাতেও পারছিনে।

মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটি বসিরহাট মহকুমার দশটা আশ্রয় শিবির পরিচালনা করেছেন। রবিবার এই দশটা শিবিরে আশ্রয়প্রার্থীর মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৮৮ হাজার ৭৩ জন।

ওঁরা যা হিসেব দিলেন তাতে জানা গেল, হাসনাবাদ শিবিরে ৩৫ হাজার, টাকু সৈন্যের বাগানে ৩০ হাজার, গোলপুকুরে ২৫ হাজার, বসিরহাট মেলাখোলায় ১৫ হাজার, মৈত্র বাগানে ৩৫ হাজার, মোগলপাড়ায় ১৫ হাজার, স্বরূপ নগরে ৫০ হাজার, নির্মানে ১৬ হাজার, তেঁতুলিয়া ১০ হাজার, কাটিয়াহাটে ১৫ হাজার। একুনে আড়াই লক্ষ। এর উপর আরও ৩৮ হাজার আশ্রয়প্রার্থীর ভার এদের নিতে হয়েছে সরকারের অনুরোধে।
ওঁরা জানালেন, ওঁদের উপর এত চাপ পড়েছে যে, ওদের ব্যবস্থা চাপের চোটে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ওরা বেশ চিন্তিত। মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটি কয়েকটা নির্ধারিত কেন্দ্র থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে সরকারী বরাদ্ধ অনুসারে রেশন বিলি করেন। সরকারের বরাদ্দ দৈনিক মাথাপিছু ৪০০ গ্রাম চাল, ১০০ গ্রাম ডাল, ১৫০ গ্রাম আলু, ১৫০ গ্রাম পিয়াজ, ১৫০ গ্রাম লবণ। আশ্রয়প্রার্থীদের সপ্তাহে ছয়দিনের রেশন দেওয়া হয়। বিতরণের সুবিধার জন্য সোসাইটি নিয়ম করেছেন সপ্তাহে একদিন নির্দিষ্ট এলাকার আশ্রয়প্রার্থীর মধ্যে রেশন দেওয়া হবে। এতে বিশৃঙখলা কমেছে কিন্তু মানুষের দুর্দশা কমানো যায়নি। টাকির এক রেশন বিতরণ কেন্দ্রে বিকালের মুখে গিয়ে দেখি হাজার হাজার লোক রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছেন।

মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার পরিবারকে বাসনপত্র দেওয়া হয়েছে এবং এছাড়া অনেককে কাপড় জামা ইত্যাদি। এছাড়া ওরা সীমান্ত অঞ্চলে ৫০ বেডের একটা হাসপাতালও খুলবেন।

বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি সমস্যা প্রকট হয়েছে। যথাঃ (১) জ্বালানী, (২) শৌচাগার এবং (৩) পানীয় জল।

সরকার রেশন দেবার মালিক, জ্বালানী দেবার কেউ নয়। ফলে এতদিন আশ্রয়প্রার্থীরা নিজেরাই এপাশ ওপাশ থেকে তা সংগ্রহ করে নিচ্ছিলেন। এদিকে জঙ্গল নেই। ফলে এতদিন স্থানীয় গৃহস্থদের জিনিসেই হাত পড়েছিল। এবং পশ্চিমবঙ্গের লোক শত অসুবিধা সহ্য করেও শরণার্থীদের সাহায্য করে অতিথিবৎসলতার প্রশংসনী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু এখন, এই বর্ষায় কি হবে? গৃহস্থরা নিজেরাই তো জ্বালানীর অভিযোগে ভুগবেন। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচিৎ অবিলম্বে শরণার্থীদের জন্য জ্বালানীর ব্যবস্থা করা। নাহলে ক্রমে জ্বালানীর অভাবে শরণার্থীদের হাঁড়িই যে চড়বে না, তাই নয়, আইন-শৃঙখলাগত শোচনীয় অবস্থার সৃষ্টি হবে।

রবিবার শিবিরের পর শিবিরে গিয়ে দেখেছি, নুন্যতম স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থাই নেই। একে এইসব শিবিরে লোক সংখ্যার তুলনায় পায়খানার সংখ্যা শোচনীয়ভাবে কম, (আব্রু রক্ষার প্রশ্ন তুলছিই না) তার উপর বৃষ্টির জলে সেগুলো এখন থৈ থৈ, একেবারে অব্যবহার্য হয়ে উঠেছে। মাঠগুলোও ভেসে উঠেছে, জেগে আছে শুধু পাকা সড়ক। অতএব কিছুদিন পরে কি অবস্থা দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। এরপরে দুর্গন্ধে ওদিকে তিষ্ঠানো যাবে না।

এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানীয় জল সরবারহের সংকট। এমন শিবিরও আছে যার লোক সংখ্যা ১৫ হাজারের উপর, কিন্তু মাত্র একটি টিউবওয়েল কাজ করছে। বাকিগুলো বিকল। পরিশ্রুত পানীয় জলের অভাব, শিবিরে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার অবস্থান মারাত্মক সব রোগের সৃষ্টি করতে এবং সকলের জীবন বিপন্ন করে তুলবে।

ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের কয়েকজন চিকিৎসক গত কয়েকদিন ধরে যাহারা শিবিরে দল। বেঁধে আসছেন এবং প্রাণপণে চেষ্টা করছেন। সেবা করতে দেখে ভাল লাগল। ওদের মধ্যে দু’জন, ডঃ বিমল বসু এবং ডঃ নন্দ সরকার জানালেন, সাহারা শিবিরে (কাশী বিশ্বনাথ সেবা সমিতি শিবির পরিচালনা করছেন) গত সপ্তাহ থেকে তারা মহামারীর আকারে যে উদরাময়, চোখের রোগ, ব্রংকাইটিস, বসন্ত, হাম, এমনকি যক্ষ্মা রোগ দেখা দিয়েছে তার চিকিৎসা করছেন। তারা রেডক্রস, ক্যালকাটা কেমিক্যালস, হাওড়া লায়ন্স ক্লাব, দেজ মেডিক্যাল, স্ট্যাডমেড, ইস্ট ইন্ডিয়া ফারমাসিউটিক্যালস প্রভৃতি সংস্থার কাছ থেকে কিছু ওষুধপত্র পেয়েছেন তাতে প্রয়োজন মিটছে না। সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করেও এ পর্যন্ত তারা কোনও সাহায্য পাননি। সময়মত সাহায্য পেলে তারা অনেক জীবন বাঁচাতে পারতেন।

বর্ষা শুরু হতে না হতেই সমস্যার তীব্রতা এবং ব্যাপকতা এইভাবে বেড়ে চলেছে। যার পরিণতি লক্ষ লক্ষ ঘরছাড়া শরণার্থীদের ঠেলে নিয়ে চলেছে একটি মার লক্ষে মৃত্যুর দুয়ারে।

এর বিকল্প কি? বিভিন্ন শরণার্থীকে সারাদিন ধরে জিজ্ঞাসা করেছি। ওরা বলেছে দেশে ফিরে যাওয়া। ওরা বলেছে আমরা ঘরে ফিরতে প্রস্তুত। আপনারা আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিন।

নিরাপত্তার ব্যবস্থা বলতে কি বোঝাতে চান? কী চান আপনারা? রামপালের ছাত্র কালিদাস রায়, শিক্ষক বিকাশ চন্দ্র সরদার, গ্রামের মাতব্বর বিজয়কৃষ্ণ মন্ডল- সারাদিন তারা রেশিন নেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, সারাদিন ধরে বৃষ্টিতে ভিজছেন, ক্লান্ত তারা, অবসন্ন একবাক্যে বললেন, মুজিবের সরকার, একমাত্র মুজিবের সরকার হলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হলেই আমরা নিরাপদ হব। ঘরে ফিরে যাব।”

এজন্য প্রয়োজনে তারা অস্ত্র ধরবেন। যদি তাদের এ কাজে লাগানো হয়, তবে এই দন্ডেই তারা রেশনের লাইন ছেড়ে চলে যাবেন। প্রাণ বলি দিতে তারা প্রস্তুত।

প্রশ্ন এই, এ ব্যবস্থা কে করবেন? আগে করা হবে কি? হলে এই তো সময়, কেননা জীবনীশক্তি কিছু এখনো অবশিষ্ট আছে। যত দেরি হবে, মৃতের স্তুপে ভারত ততই ভরে যাবে।