You dont have javascript enabled! Please enable it! অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ জুন ১৯৭১, বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বের হস্তক্ষেপ চাই দিনেশ সিং - এম পি - সংগ্রামের নোটবুক

অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ জুন ১৯৭১
বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বের হস্তক্ষেপ চাই
দিনেশ সিং – এম পি
(সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী)

ভারতীয় উপমহাদেশের উন্নয়ন প্রসংগে বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিলক্ষিত হয়েছে। ভারত,পাকিস্তান এবং সিলনের নির্বাচনের পরেও জনগণের নির্বাচিত নেতৃত্ব সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র,বদলানোর চেষ্টা এবং স্থায়ীত্বকে সমর্থন করে কিনা এই ব্যাপারে সন্দেহ থেকে গিয়েছে। তাদের নেতা এবং দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশের মানুষ অবিভ্রান্তচিত্তে সেনাশাসনের সামনেও জনগণের দ্বারা শাসন পরিচালনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। একইভাবে তারা দ্রুত সমাজের সঠিক পরিবর্তন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সহায়তা দিয়েছে যারা জনগণের চেতনাকে উপলব্ধি করতে পারে। এটা এই অতীতের সাক্ষী ছিল যে, ভারত সিলন সরকারের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য নিয়েছিল যা তখনকার সময় মানুষের বিভিন্ন ইচ্ছার কিছুটা বিরুদ্ধে ছিল।তখনকার প্রেক্ষাপটে একই ঘটনা যখন পাকিস্তানেও হলো তখন ভারতকেও একই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এই বিবেচনার উপরই ভিত্তি করে তখন আমাদের পার্লামেন্ট বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। যেটা সকল জনগণকে মানতে হত। কারণ একটি গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে তাদের কাছে আর কোনো পছন্দ ছিল নাহ। ১৯৭১ সালের ২৪শে মে লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশের প্রতি সাহায্য করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্যকে সকলের স্বাগত জানানো উচিত ছিল। বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নতা কোনো চর্চার বিষয় ছিল নাহ কিন্তু পৃথিবীর এই অংশের মানুষের শ্বাসমূলে যেন তা উদ্ভাসিত হচ্ছিল। এখানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের চেষ্টা প্রতিফলিত হচ্ছিল। এটি ছিল গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতকরণের আন্দোলন। এটা খুব সহজেই প্রতীয়মান হচ্ছিল যে পাকিস্তানে নির্বাচনের ফলাফল আর বেশিদিন সেনা শাসনের অধীনে থাকবে নাহ। জাতীয় সংসদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামীলীগ এবং এর অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হয়ায় ৭০২ জন সদস্য মিলিত হয়ে দেশের শাসনকর্তা নির্বাচিত হবেন এমনটায় আশানুরূপ ছিল। এখানে ৬ দফা দাবি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কেনই বাঁ সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের আনুগত্য স্বীকার করবে? এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবর রহমানই পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। এছাড়াও শেখ মুজিবর রহমানের ৬ দফা ছিল বাংলাদেশিদের মুক্তির দলিল।তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের হঠাতই সশস্ত্র আক্রমন একদমই সংকেতবিহীন এবং হঠাতই হয়েছিল যা পরবর্তীতে পাকিস্তানকে বিভক্ত করেছে। তথাপি

এটি পাকিস্তানী সেনা উপনিবেশের অভ্যুত্থান ছিল। আমাদের সাহায্য আসুক বাঁ না আসুক পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে সেদেশের মানুষের অভ্যুত্থান হয় যেন তারা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এটি পররাষ্ট্র বিষয়ক নিষ্পত্তিতে আমাদের স্বাভাবিক এবং নিত্য সাহায্যের মতই ছিল।তারা আমাদের পাশের অঞ্চলেই এভাবে সীমান্ত নিয়ে লড়াই করবে এবং আমরা যেহেতু বৈশ্বিক শান্তি চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেছি তাই তাদের সাহায্য করা কি আমাদের উচিত ছিল না? যেখানে আমরা দক্ষিন আফ্রিকার জন্যও আমাদের হাত উঁচু করেছিলাম। যেখানে আমরা দক্ষিণ রোডেশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হস্পক্ষেপ করেছিলাম। যেখানে আমরা পর্তুগীজদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও হস্তক্ষেপ করেছি সেখানে আমরা কি করে আমাদের সীমান্তে দুটি দেশের যুদ্ধে চুপ থাকি? আমরা কি বাংলাদেশের মানুষের উপর নির্মম অত্যাচার এবং গণহত্যা দেখেও চোখ বুজে থাকব? নিজেদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে তাদের এই আকাঙ্ক্ষা কি ভুল ছিল? বাংলাদেশে যদি এই যুদ্ধ দ্রুত রোখা না যেত তাহলে আরো হাজারো রিফিউজি কি ভারতে আশ্রয় নিতে আসত না? আমাদের কি তাদের সাহায্য করা উচিত ছিল না? আমাদের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপত , আমাদের জাতীয় চাহিদা এবং আমাদের নীতি যেন তাদের সাথে একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল। আমাদের এখন অনেক রিফিউজি রয়েছে। আজকে প্রায় চল্লিশ লক্ষ। সাত লক্ষ আগামীকাল এবং আরো দশ লক্ষ আসবেন তার পরের দিন। কেও জানেনা আরো কতজন আসবে, আমরা তাদের কতটুকু দিব এবং কতদিন দিতে থাকব। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার কিভাবে হতে পারে। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের দেশের সীমান্ত পেরিয়ে অন্যদেশের সীমান্তে এসে পরছে সুতরাং এটি আর শুধু অভ্যন্তরীন ব্যাপার নেই। এটি সেদেশের মানুষের উপর হয়া অত্যাচারের প্রতিফলন মাত্র। যখন একটি দেশের মানুষকে জোরপূর্বক সেদেশ থেকে বের করে দিয়ে আরেকটি দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা দেশের অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ব্যাপারে প্রভাব ফেলছে তবে আমরা যুদ্ধে কেন যাবো না? পাকিস্থান এই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে কখনোই পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্থানের ভেতর সামঞ্জস্যতা আনতে পারে নাহ। বাংলাদেশ এখন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এটি ছিল একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গণহত্যা , অধীকার এবং সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা। কিন্তু আমি সময় হারাচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যে দুর্যোগপূর্ণ সময়ের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছি। নতুবা খুব শীঘ্রই পাকিস্তানি নিপীড়িত রিফিউজিদের বন্যা বয়ে যাবে। আমরা যদি শিঘ্রই মুক্তিফৌজ প্রেরণ করি তাহলে বিভিন্ন এলাকা স্বাধীন হতে থাকবে এবং সেখান থেকে রিফিউজিদের আগমন আসা কমতে থাকবে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইতে পারত যেন চাপের মুখে পরে পাকিস্তান বিষয়টার দফারফা করতে উন্মুখ হয়। এখন সেই চাপ আমাদের উপর রয়েছে কেননা পশ্চিম পাকিস্তান বাঁ মূল পাকিস্তানে তো কোনো রিফিউজি নেই। স্বীকারোক্তি বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকারোক্তির ব্যাপারে কখন তা তারা সম্পন্ন করবে সে প্রশ্নটা সেখানকার সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়া হোক। অবশ্যই একটা স্বীকারোক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যোগাবে এবং তখন আর কোনো রকম বাধ্যবাধকতা থাকবে নাহ। এই প্রশ্নটাই এখন আগামীর কর্মপন্থা নিশ্চিত করবে। যদি মুক্তিফৌজ পাকিস্তানি বাহিণীদের কাছ থেকে দখলকৃত এলাকা সমূহয় মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে তাহলে ভারত থেকে রিফিউজিদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রিফিউজিদের তাদের এলাকায় ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের খুব সাবধানে ভেবে চিন্তে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারা ততক্ষণ পর্যন্ত যাবে না যতক্ষণ আমরা পাকিস্তানি বাহিণীর কাছ থেকে তাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চয়তা না দেই। আমরা এখন সাহায্যের খাতিরে আরো বিভিন্নভাবে তহবিলের আবেদন করতে পারি কিন্তু এই ব্যাপারে জাতিসংঘের উত্তর খুবই নিরাশাজনক ছিল। হয়তবা আমরা আরো কিছু অর্থায়ন পেতে পারি। কিন্তা সেটা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে নাহ। পকিস্তানকে অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সেই অর্থ পরিশোধন করতে হবে যা আমরা এখানে রিফিউজিদের পেছনে ব্যয় করেছি এবং তাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রিফিউজি ক্যাম্প তৈরি করা উচিত যারা এখন ভারতে রয়েছে।পাকিস্তানি বাহিণী এসব কিছুই রাখঢাক করার ষড়যন্ত্র করছে। যা আমরা হতে দিতে পারি না। তাই এই সমস্যার নিষ্পত্তি আন্তর্জাতিক কর্মকর্তাদের দ্বারা পাকিস্তান সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যবর্তী চুক্তির মাধ্যমে হতে হবে। আমাদেরকে এই ব্যপারে বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করতে হবে। এখানে এই ধরনের বিচ্ছেদের রিফিউজিদের অবস্থান নিশ্চিত করতে খুবই সমস্যা হবে যা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ আর তাই যত দ্রুত সম্ভব জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রিফিউজিদের পূর্ব পাকিস্তানে রিফিউজি ক্যাম্পে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা কোনো ব্যাপার না যে তাদের কতদিন লাগছে কত সপ্তাহ লাগছে বাঁ কত বছর লাগছে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে এবং স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেতে কিন্তু আমরা সর্বদা সকল ক্ষেত্রে সকল সিদ্ধান্তে তাদের পাশে রয়েছি। আমরা অবশ্যই সকল ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য কামনা করি ।