কম্পাস পত্রিকা
২৯ মে, ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা
সুদিন ভট্টাচার্য
আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হয় ইয়াহিয়া খাঁ বোধ হয় যা চেয়েছিলেন তাই হতে চলেছে। পূর্ব বাংলার প্রায় এক কোটি হিন্দু এবং কয়েক লক্ষ শিক্ষিত সংস্কৃবান মুসলমান সে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতের আশ্রয় নেওয়ার পথে। এর দলে সুচতুর রাজনীতিবিদ ভূট্টোর আশা পূর্ণ হবে- বাঙ্গালীরা পাকিস্তানে সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হবে। তার প্রতিক্রিয়া হবে সুদূরপ্রসারী। পূর্ব বাংলায় গণবিপ্লবের সময় পাকিস্তান সরকার যেমন মাসাধিককাল ধরে গড়ে দৈনিক ১ কোটি টাকা সামরিক ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছেন এবং প্রায় ৭০ কোটি টাকার মত বৈদেশিক মুদ্রা রোজগার করতে অক্ষম হয়েছেন তেমনি ভারতকেও প্রতিদিন আশ্রয়প্রার্থীদের ভরণপোষনের জন্য একই প্রকার অর্থ ব্যয় করতে হবে তা ছাড়া সামাজিক এবং রাজনৈতিক কুফল তো আছেই।
কিন্তু কেন এমন হতে চলেছে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ব্যর্থতা? পাকিস্তানী সৈন্যদের অসাধারণ উন্নতমানের অস্ত্রাদি এবং দক্ষতা? না ভারতের ব্যর্থতা? এই তিনটি বিষয় একে একে আলোচনা করা যাক-
(১) আওয়ামীলীগ খুব বেশী দিনের দল নয়। নেতৃত্বও তরুণ। এর সুবিধা অসুবিধা দুইই আছে। অহিংস সংগ্রামের অভ্যস্ত নেতৃত্ব হিংস সংগ্রামের প্রস্তুতি চালাতে স্বভাবতঃই অক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ এঁদের সমর্থকদের একাংশ, ছাত্ররা আদর্শনিষ্ঠ এবং সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে থাকলেও দূর গ্রামাঞ্চলে তাদের প্রভাবটা ততটা কার্যকর হয় নি। সেখানে এখনও লীগ যুগের ধর্মান্ধতার রেশ কম বেশি রয়ে গিয়েছে। ইয়াহিয়া চক্র এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। তৃতীয়তঃ শেখ মুজিবের ব্যক্তিত এবং নেতৃত্ব ছিল এই দলের সবচেয়ে বড় ভরসা। ২৫শে মার্চ রাত্রে মুজিবর রহমান পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ায় তার দল অনেক পরিমাণে দিশাহারা হয়ে পড়ে। সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে লীগের নেতৃবৃন্দের বিন্দুমাত্র ধারণা থাকলে তারা বিদ্রোহ করার জন্য ২৫ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন না এবং সৈন্যদের হতো পুলিশ ও ইপিআরকে নিরস্ত্র এবং প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে দিতেন না এবং প্রথম দিনেই তারা ঢাকা বিমানঘাঁটি দখল করবার চেষ্টা করতেন।
(২) পাকিস্তান মোটামুটি শক্তিশালী দেশ। ‘টাইম’ পত্রিকার তথ্য যদি ঠিক হয় তাহকে বুঝতে হবে যে দেশের ঐ সৈন্যদলে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে মাত্র একজন পূর্ববাংলার মানুষ। মাত্র ৫/৬ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য পূর্ব বাংলার তার মধ্যেও বহু অবাঙ্গালী সৈন্য ও অফিসার ছিল। এর মধ্যেও অর্ধেক ছিল পশ্চিম অংসে। সুতরাং বিদ্রোহের দিনে মাত্র হাজারখানেক সামরিক শিক্ষিত বাঙ্গালী পূর্ব বাংলায় উপস্থিত ছিলেন ইপিআর প্রকৃতপক্ষে সীমান্ত পুলিশ। এদের অল্প সংখ্যক স্টেন, এলএমজি ২” ও ৩” মর্টার ছিল। কিন্তু সামরিক শিক্ষার মানের দিক দিয়ে এরা খুব পশ্চাৎপদ। আনসারদের অস্ত্রশস্ত্র খুব কমই ছিল, সামরিক শিক্ষার মানও ছিল শোচনীয়। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য ও স্বদেশ প্রেমের দ্বারাতো যুদ্ধ করা যায় না- বিশেষতঃ পূর্ব বাংলার খোলামাঠে এবং গ্রীষ্মকালের ফসলহীন ক্ষেতের উপর যুদ্ধ হলে জিতবার কোন আশাই থাকে না আধুনিক সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে।
পাকিস্তানের সামরিক শক্তি “স্টেটসম্যান” এর হিরন্ময় কার্লেকার মহাশয় যা দিয়েছেন ততটা নয়- ” ইনষ্টিটিউট অব ষ্ট্রাটেজিক স্টাডিজ”- এর মতে তার চেয়ে অনেক কম। নিয়মিত সৈন্য প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার,
কাশ্মীরের আধাসৈন্য প্রায় ৩০ হাজার। এছাড়া আছে স্কাউট, রেঞ্জার ইত্যাদি অনিয়মিত কিন্তু মোটামুটি দক্ষ সৈন্য আর ৪০/৫০ হাজারের মত। অস্ত্রশস্ত্রে ঐ ২৭০০০০ সৈন্য বেশ আধুনিক, বাকীরা সেকেলে। মার্কিন বদান্যতায় পাওয়া এবং ১৯৬৫’র ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া ৪০৯ মাঝারি ট্যাঙ্ক এবং রাশিয়া ও চীন থেকে পাওয়া ৩০০- এর মত মাঝারি ট্যাঙ্ক আছে। হাল্কা ট্যাংক (মার্কিন ও চীনা) এবং উভচর ট্যাঙ্ক (রাশিয়ান পিটি ৭৬) মিলেও আরও ২০০ এর মত হতে পারে। কামান বেশির ভাগই পুরানো ২৫ পাউন্ডের হলেও অল্পসংখ্যক মার্কিন ও রুশ খুব ভারী কামান ও ভালোজাতের চীনা মর্টার ও রকেটও আছে। পূর্ব বাংলায় কিন্তু এই বাহিনীর সাত ভাগের এক ভাগও ছিলনা ২৫শে মার্চ। এবং তার পরের এক মাসে- বিদেশীদের মতে স্যাবর জেট বিমান। অল্প সংখ্যক হেলিকপ্টার, ‘গানশিপ’ ও ছিল পূর্ব বাংলায়।
আওয়ামীলীগের “রেগ-টেগ সার্কাস”- এর তুলনায় ৩০/৪০ হাজার নিয়মিত সৈন্য এবং তাছাড়া ৪০ শতাংশ লেজুড় যথেষ্ট শক্তিশালী এক কথা বলাই বাহুল্য ইপিআর-এর কোন রণসম্ভাই এই বাহিনীর বা স্যাবর জেটগুলির মোকাবিলা করবার পক্ষে উপযুক্ত নয়। সুতরাং ফল যা হওয়ার হয়েছে।
(৩) ভারতের শোচনীয় ব্যর্থতার ইতিহাস বড়ই করুণ। এমন সূবর্ণ সুযোগ যে দেশ গ্রহণ করতে না পারে সে দেশের নেতৃত্ব ক্ষমার অযোগ্য। পাকিস্তান ভারতের শত্রুদেশ। ১৯৬৫ সালের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ, কোন প্রকার কূটনৈতিক সৌজন্য প্রদর্শনও হয় না। পাকিস্তানের এক মাত্র কাম্য হল ভারতের সর্বনাশ হোক। যেন তেন প্রকারে ভারত সামরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল হোক। নাগা মিজো তামিলরা বলুক যে আমরা ভারতের মধ্যে থাকবো না। চীন ও ভারত এশিয়ার এই দুইটি প্রধান শক্তি পরস্পর শত্রুতার মধ্যে কালযাপন করুক- পাকিস্তান এই চায়। তার বিনিময়ে ভারত ক্রমাগত চাইছে যে, পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে ব্যবসা বানিজ্য করুক। ভদ্র আচরণ করুক ইত্যাদি। এর চেয়ে হাস্যকর মূর্খ্যতা আর কি হতে পারে। জার্মানীর মদগর্বী পার্শিয়ান জাঙ্কারদের মত সৌর্যবীর্যগর্বী পাঞ্জাবী আফ্রিদি বেলুচরাও ভাবে যে ভারত আমাদের কি ক্ষতি করবে? আমাদের সহায় চীন, তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব এবং লিবিয়া- এই শেষোক্ত দেশ দু’টি তেল বিক্রির টাকার একটা বড় অংশ যেমন ইসরাইলীদের বিরোধী আরবরা পাচ্ছে তেমন একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পাচ্ছে হিন্দু বিরোধীর ভূমিকায় পাকিস্তান। সামরিক শক্তি এ দিক থেকে একমাত্র চীন শক্তিমান। তুরস্ক ও ইরানের কিছু আধুনিক রণসম্ভার আছে কিন্তু সাহায্য দেওয়ার মত কিছু না। স্টেইটম্যান (১২মে) এ কূলদীপ নায়ার লিখেছেন যে ইরান ও তুরস্ক পাকিস্তানকে এফ-৫ এবং এফ-৮২ বিমান দিয়েছে। অদ্ভুদ কথা। ঐ এফ-৫ মার্কিনরা ১৯৬২ সালে ভারতকে দিতে চেয়েছিল। ভারত নিতে রাজী হয়নি। মান্ধাতার আমলের এফ-৮২ (না ছাপার ভুল-এফ৮৬?) কি করবে। ভারতে প্রায় ৩/৪ শত মিগ-২১ ও এস-২২২ যাদের গতিবেগ উপরোক্ত বিমান্দ্বয়ের গতিবেগের দ্বিগুন- তাদের সামনে ২০/২৫ খান ঐ বিমান কি করবে? ইরানে খান কয়েক ফ্যান্টম (এফ-৪ এফ) আছে কিন্তু ঐ কখনোই বা কি হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে ভারতের এই বর্তমান সুবিধা নাও থাকতে পারে। সুতারাং এমন সুবর্ণ সুযোগ ভারতের হারানো উচিত নয় এবং শেষ পর্যন্ত কূলদীপ নায়ারও অবশ্য বলেছেন- “ইন্ডিয়া কেন স্টিল ইসু এন আলটিমেটম টু পাকিস্তান টু স্টপ দি ইনফ্লাক্স রিফিউজীস অব ফেচ দি কন্সকুইনসেস”।
নীচে এশিয়ার কয়েকটি দেশের সৈন্য ও বিমানের সংখ্যা দেওয়া গল- চীন (১) নিয়মিত সৈন্য ২৫ লক্ষ, ৬টি আর্মার্ড ডিভিশন, ৪০০০ ট্যাংক (২) ২৫০০ যুদ্ধবিমান- অধিকাংশ মীগ- ১৭ ও ১৯, সামান্য সংখ্যক ২১ এবং ৩০০ ইলিউসিন-২৮ (ক্যানবেরার চেয়ে মন্থরগতি এবং কম উচ্চে উড়তে পারে)।
ভারত (১) নিয়মিত সৈন্য ১০ লক্ষ, ৩ আর্মার্ড ডিভিশন, ৭০০ মাঝারি, ১০০ হালকা ট্যাঙ্ক (২) প্রায় ৩০০ যুদ্ধ বিমান- মাত্র ৩০ টি শব্দের দ্বিগুণ গতিবেগ সম্পন্ন (মিরাজ) ১০০০ কামান।
তুরস্কের শক্তি পাকিস্তানের চেয়ে একটু বেশি এবং ইরানের শক্তি বহুগুণ কম। সৌদি আরবের ২৫ খানা শব্দের দ্বিগুণ অধিক গতিবেগ সম্পন্ন লাইটনিং বিমান আছে। যেহেতু চীন সম্ভবত কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বার কোন সম্ভাবনাই নেই বলা চলে, কারণ তাকে রাশিয়া ও আমেরিকার মোকাবিলা করতে হয় এবং ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করা তার নীতিও নয়। তখন পাকিস্তানে কোন সাহসে ভারতের সঙ্গে লড়তে চায়? পাঞ্জাবী মিলিটারী আভিজাত্যের দর্প চূর্ণ করার এবং তথাকথিত আজাদ কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করবার, চিরকালের মত নাগা-মিজো সমস্যার সমাধান করবার মত এমন সুযোগ আর কখনো আসবে না। কারণ এখন পাকিস্তানের মাত্র ৮ ডিভিশন সৈন্য পশ্চিমে আর চার ডিভিশন পূর্ব দিকে। সুবর্ণ সুযোগ।
আর ভারত আজ যদি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়- বস্তুতঃ ভয় পেয়ে অকারণে ভারত পিছিয়েই গেছে- তবে ইতিহাস তার জন্য ক্ষমা করবে না। প্রায় এক কোটি নবাগতের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতে তাকে দেউলিয়া হতে হবে এবং কেউ তাকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে আসবে না। কারণ মার্কিনরা জানে রুশরাও জানে ভারতকে এখন সাহায্য করার অর্থ হক এশিয়াতে আর একটি “চীনের” সৃষ্টি করা। তার চেয়ে সামরিক ভারসাম্যের নিস্ফল ধোঁকাবাজী চলতে থাকুক। মরুক ভারত আশ্রয় প্রার্থী সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে।
বলতে বাধা নেই যে সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাদিক্যে জয়লাভ করায় ইন্দিরাজীর প্রতি অনেক বিরূপ জনেরও একটু শ্রদ্ধার ভাব উদয় হচ্ছিল। পূর্ব বাংলার প্রতি আচরণের অপ্রতুলতায়, ব্যর্থতায় আজ তারা সকলেই ক্ষুদ্ব হয়েছেন এ কথা বলাই বাহুল্য। এর ফলে ভারতের রাজনীতি এই কষ্টার্জিত স্থিতিশীলতা আর বেশিদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। কার্যাকালে যার বল কার্যকর নয় এমন মানুষ কখনো কারো শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে ভারতের ব্যর্থতা সত্যিই বেদনাদায়ক। পাকিস্তানী জঙ্গীবাদের জয় হলে এশিয়া ভূখন্ডে গুরুতর বিপর্যয় ঘটতে পারে। এবং তার জন্য ভারতের দায়িত্ব পাকিস্তানের চেয়ে কম নয়।