কম্পাস পত্রিকা
২৯ মে, ১৯৭১
বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ ও সুদৃঢ় নীতির দাবীতে-
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চাপ আসতে পারে, এজন্যই ভারত সরকার ইতস্তত করছেন। সাধারণভাবে এরকম একটা ধারণাই এখন জনসাধারণে দেখা যাচ্ছে। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি হয়তো ভারত সরকারকে অনুসরণ করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। এটাই নাকি ভারতের পক্ষে স্বাধীনভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে যথেষ্ট বাধার কারণ।
কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে বিদেশী রাষ্ট্রগুলির মনোভাব কি দাঁড়াতে পারে, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
চীন সুস্পষ্ট ভাষায় ভারতকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত যেন আর নাক না গলায়। সর্ব প্রথম চীনের হুমকির বিষয়ে আলোচনা দরকার।
পূর্ব বাংলার ঘটনাবলীতের উদ্বেগ প্রকাশ করে ১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিল সোভিয়েট রাশিয়া পাকিস্তানের কাছে এক নোট পাঠিয়েছিল। এরপরেই আসে ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল চীনের তরফে ভারতের প্রতি হুঁশিয়ার বাণী। চীনের এই হুঁশিয়ারীর পরেই এদেশে অনেকেই বলতে শুরু করলেন “আর কিছু করার প্রয়োজন নেই”, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত যেন আর জড়িয়ে না পড়ে।
অবশ্য চীনের ঐ নোটের তাৎপর্য খুব সতর্কতার সঙ্গে অনুধাবন করলে দেখা যায়-
(ক) সম্ভবতঃ রাশিয়ার নোটের প্রত্যুত্তরে পাকিস্তানের অনুরোধ বা চাপে চীন ভারতের প্রতি ঐ ধরনের হুঁশিয়ারী দিয়ে থাকতে পারে। যদি চীন সত্যিই তার হুঁশিয়ারী সম্পর্কে সিরিয়াস হয়ে থেকে, তাহলে তাকে অবশ্যই ভারত আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। আর এরকম ব্যবস্থা নেওয়ার অর্থই হল বিশ্বযুদ্ধকে ডেকে আনা। কিন্তু এই মুহুর্তেই যে চীন বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তা কারুর মত নয়। শুধু হুমকি দিয়েই চীন পাকিস্তানের সঙ্গে তার বন্ধুত্বকে বজায় রাখতে চেয়েছে-তার বেশী কিছু নয়।
(খ) চীন যে হুঁশিয়ারী দিয়েছে, তাতে কোথাও পূর্ব বাংলার আন্দোলন ও দাবীর ন্যায্যতা সম্পর্কে যেমন কিছু বলেনি, তেমনি ঐ আন্দোলন ও দাবীর সম্পর্কে অন্যভাবে কোন বক্তব্য রাখেনি। চীন শুধু ভারতের হস্তক্ষেপেরই নিন্দা করেছে। এর অর্থ জলো পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি সম্পর্কে বিবেচনার পথ সে খোলাই রেখেছে। এ প্রশ্ন নক্যে তখনই সে বিবেচনা করবে, যখন তার স্বার্থের প্রশ্ন দেখা দিবে।
(গ) যদি পাকিস্তান চূড়ান্ত পরিণতিতে সম্পূর্ণরূপে শত্রুভাবাপন্ন দুটি ইউনিট ভেঙ্গে পড়ে আর ঐ ইউনিট দু’টি একে অপরের থেকে স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে চীন এবং অন্যান্য শক্তিগুলিকে (যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট রাশিয়া ও বৃটেন) একটিকে ছেড়ে আর একটি বেছে নিতে হবে। অবশ্য উপরোক্ত রাষ্ট্রগুলির প্রত্যেকেই পাকিস্তানের ঐক্যাবস্থা বজায় রাখতে আগ্রহী। কারণ, সাধারণভাবে এশিয়ায় এবং বিশেষভাবে ভারত উপমহাদেশে নিজেদের আন্তর্জাতিক রণকৌশল স্বার্থ বজায় রাখার জন্য তারা প্রত্যেকেই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। এতে তাদের দুটি উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে- ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানকে দাঁড় করিয়ে সাম্য সৃষ্টি করা এবং নিজ নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে পাকিস্তানকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তানকেই বেছে নেবে- পুর্ব বাংলাকে নয়। পশ্চিম পাকিস্তানই সত্যিকারের পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা ত’ ‘পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে যাতে সামরিক দিক দিয়ে সংযোগ না ঘটতে পারে, সে উদ্দ্যেশ্যে এ দুটি দেশের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানকে গোঁজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। চীনকে পশ্চিম পাকিস্তান তার প্রথম শ্রেণীর বিপক্ষে বন্দর করাচীকে ব্যবহার করার জন্য দেবে। চীন আজ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর অফ্রিকায় ঘাঁটি গড়তে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের মাধ্যমে চী সহজেই ঐ দুটি অঞ্চলে প্রবেশে সুযোগ পাবে।
(ঘ) অবশ্য চীন যে তার ভৌগলিক রাজনৈতিক হিসাবের খাতা থেকে পূর্ব বাংলাকে একেবারে খারিজ করে দেবে, তা নয়। সে পূর্ববাংলার প্রশ্নটিও খোলা রেখেছে। যাতে আওয়ামী লীগেই নেতৃত্ব একই সাথে ভারতের সঙ্গে কলংকিত হয় এটা দেখবার জন্যই চীন অপেক্ষা করছে। মুজিবর রহমান ও তার দল সুস্পষ্টরূপে ভারতের সমর্থক। এবং বাংলাদেশের জনসাধারণও মুখ্যত ভারতের সমর্থক। ইয়াহিয়া খানের নির্মম নিপীড়নে ভারতে প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি পরাজিত ও কলংকিত হয়, সেক্ষেত্রে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হতাশা ও শূন্যতা দেখা দেবে। তা পূরণের জন্য সেখানে চীনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে আসবে। আর তখন চীন পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে প্রবেশ করতে ইতস্তত করবে না। সে অবস্থায় চীন শুধু পূর্ব বাংলার প্রশ্নেই আবদ্ধ থাকবে না। সম্ভবতঃ সিকিম, ভূটান, নেপাল ও ব্রহ্ম সমেত আসাম, নেফা, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা মণিপুর এবং পশ্চিম বঙ্গকে নিয়ে সারা পূর্ব ভারতে সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য পূর্ব বাংলাকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ভারত কি এই অবস্থা ঘটতে দেবে? এটা কি ভারতের পক্ষে আত্মহত্যার শামিল নয়?
(ঙ) ১৯৬২ সালে নেফায় যেদিন চীন তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে ঢুকেছিল তখন ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিচারে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সময় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলতে সত্যিকারের যা বোঝায়, তা ভারতের ছিল না। তাতেও সে সময়ে “থাগলা”; থেকে “ফুট হিলস” আসতে একমাস লেগেছিল। এখন উত্তরাঞ্চলে শত্রুকে রুখবার জন্য পাহাড়ী পরিবেশে যুদ্ধক্ষম আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত নয় ডিভিশন সৈন্যকে ভারত উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে নিযুক্ত করেছে। চীন ভুটানকে আক্রমণ করতে পারবে না। ভুটান রাষ্ট্রসংঘের সদস্য। এক্ষেত্রে ভুটান আক্রান্ত হলে বিশ্বের অন্যান্য শক্তিগুলিও জড়িয়ে পড়বে। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজকে বিপুল সাহায্য দেওয়ার উদ্দেশ্য যদি ভারত হস্তক্ষেপ করে, তাহলে অনিতিবলম্বে বাংলাদেশ পাক-বাহিনীকে নির্মূল করে দিতে পারবে। এরকম অবস্থায় পূর্ব বাংলায় অবস্থিত পাকিস্তান বাহিনীকে চীন সত্যিকারের কোন সাহায্যই দিতে পারবে না। চীনের পক্ষে ভারতের নয় ডিভিশন সৈন্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য দেওয়া সহজ হবে না। তাছাড়া, যত বড় শক্তিই হোক না কেন হিমালয় ডিঙ্গিয়ে ভারতীয় উপত্যকায় প্রবেশ করে কোন শক্তির পক্ষেই যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না- যুদ্ধের সরবরাহ পথ এতই বিপদ সঙ্কুল ও অনিশ্চিত যে সমর কৌশল প্রশ্নটি অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর তাছাড়া সাধারণত চীনকে যুদ্ধের জন্য অন্য দেশে ঢুকে পড়তে দেখা যায় না। কেবলমাত্র কোরিয়াতে এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল। তবে সেখানেও নিজের প্রতিরক্ষার স্বার্থেই চীন ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিল। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এখনও পর্যন্ত চীন ভিয়েতনামে কোন সশস্ত্র বাহিনী পাঠায়নি।
(চ) এখন চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক বর্তিমান, তা হলো প্রকাশ্য বৈরিতার। কিন্তু ১৯৬২ সালে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সে রকম সম্পর্ক ছিল না। তাছাড়া সে সময় কিউবায় পারমাণবিক বোমারু বিমানের ঘাঁটি স্থাপনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধ আসন্ন হয়ে উঠেছিল, আর সে জন্য রাশিয়া অনেকাংশে প্রতিহতও হয়েছিল। চীনও সে সময় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে বিপজ্জনক পরিণতির উদ্ভব হয়েছিল, তার সুযোগ নিয়েছিল। এখন সিংকিয়াং থেকে শুরু করে মাংগোলিয়া পর্যন্ত দু’দেশের মধ্যে বিরাজমান সুবিস্তৃত সীমান্ত জুড়ে চীনকে বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করতে হয়েছে। এটা মনে রাখা দরকার যে, সোভিয়েট-চীন সীমান্ত অঞ্চল পৃথিবীর মধ্যে দীর্ঘতম।
উপরোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করে বলা যায় যে চীন যে হুঁশিয়ারী দিয়েছে তা ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই উচিত হবে। তাই আমরা পাকিস্তানকে তার ইচ্ছামত বাংলাদেশ ও তার সংগ্রামী নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে দিতে পারি না।
ভৌগলিক- রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই রাশিয়া ও পাকিস্তান সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী। চীন এবিং যুক্তরাষ্ট্রের খপ্পর থেকে পাকিস্তানকে ছিনিয়ে আনতে রাশিয়া চায়। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখন রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষণশীল। রাশিয়াও স্থীরাবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে চায়। প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য কারণের জন্য ভারত যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে সোভিয়েট রাশিয়ার ওপরই বেশী নির্ভরশীল। কিন্তু রাশিয়ার উদ্বেগ নিয়ে ভারতের পক্ষে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। কারণ, ভারত দৃঢ়তার সঙ্গে তার নীতি অনুযায়ী এগিয়ে গেলে, রাশিয়া কোন অবস্থাতেই ভারতকে করতে পারবে না। কেননা, তাহলে তাকে সমগ্র এশিয়াতেই তার (রাশিয়ার) বর্তমান আত্মরক্ষার ব্যবস্থা পরিত্যাগ করতে হবে।
বর্তমানে আমেরিকায় বাংলাদেশ বিরোধীদের চাইতে সমর্থকদের সংখ্যাই বেশী। এখন সেখানকার প্রভাবশালী মহল পশ্চিম পাকিস্তানকে বাংলাদেশের অবস্থার জন্য নিন্দা করছে। অবশ্য মার্কিন সরকার ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করে এখনও সেই পুরোনো খেলাই খেলছে।
স্বাধীন সত্তা নিয়ে পূর্ব বাংলায় নব অভ্যুদয় ঘটেছে তাকে এখন ইংল্যান্ডের শ্রমিকদল সাহায্য সমর্থন করতে প্রায় অঙ্গিকারাবদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী যে নারকীয়তা ও নির্মমতার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে, তা সেখানকার ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলও সমর্থন করতে পারছে না।
ব্রহ্মদেশ, সিংহল, নেপাল, সিকিম প্রভৃতি ভারতের চতুর্দিকস্থ ছোট ছোট রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার পরিস্থিতিতে ভারতে কী রকম আচরণ করে এটা দেখার জন্যই অপেক্ষা করছে। যদি ভারত তার কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভারতের প্রতি এখনও তাদের যেটুকু আস্থার ভাব আছে, সেই ভাবটুকু একেবারেই কেটে যাবে এবং তারা আত্নরক্ষার জন্য অন্যান্য বৃহৎ শক্তির জন্য ঝুঁকে পড়বে।
অবশ্য ভারত সরকারও এসব বিষয়ে অবহিত। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির তথাকথিত চাপেই যে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে ইতস্তত করছে তা-ও বলা যায় না। এ ব্যাপারে অন্যান্য শক্তির ওপর ভারত সত্যিই কোন দোষারোপ করতে পারে না। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটা নেবার ভার ভারতকেই নিতে হবে- ঐ সব রাষ্ট্রকে নয়।
বাংলাদেশের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার মত শক্ত নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই তা বলা যায় না। তাছাড়া, আজ কি একটি মাত্র ব্যক্তির হুকুমে, তাঁর নিজের শাসনেই, ভারত সরকার চলছে না? কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় অন্যান্য মন্ত্রীদের অস্তিত্বটা তাঁর মর্জির উপরই নির্ভর করে। নিজেরই ইচ্ছামত প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভা গঠন করতে পারেন-ভাঙ্গতেও পারেন।
ভারতের ঐক্যবদ্ধ জনমত হিল, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক- আর খোলাখুলিভাবে উপযুক্ত পরিমাণ সাহায্য দেওয়া হোক।
এ প্রশ্ন নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে আমাদের সমর বিভাগের সেনাপতিরা যে বিরোধিতা করবে তা সত্য নয়। অবশ্য তাদের মধ্যে সকলেই খুব উৎসাহী নাও হতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধি অথবা শান্তি যাই হোক না কেন, এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ, সমর বিভাগ নয়। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মান্য করাই ও আদেশ পালন করাই সামরিক বিভাগের কাজ। সমর বিভাগের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার অর্পণ করলে, তারা সব সময় উপযুক্ত প্রস্তুতির অভাবের ছুতো দেখিয়ে যুদ্ধকে পরিহার করতে চাইবে। আর প্রস্তুতি কথাটা সবসময়ই আপেক্ষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে; প্রস্তুতি বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বুঝায়, সে অর্থে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে, সোভিয়েট রাশিয়া এবং চীনের মত শক্তিও প্রস্তুত নয়। প্রস্তুতি পর্বের সীমা থাকে না; উপরন্তু যদি আমরা দেখি যে কোন ন্যায্য কারণের জন্য এবং ভারতের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা অপ্রস্তুত অবস্থায় আছি, তাহলে কেন বছর বছর আমাদের বাজেটে সমর বিভাগের জন্য ১১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করি? আর বাস্তবিকই আমাদের সামরিক বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃত হয়নি।
এই ব্যাপারে কোন কিছু না করতে গেলে যে খরচ হবে তার পরিমাণ প্রত্যক্ষভাবে কিছু করতে গেলে, এমনকি একখন্ড সম্ভাব্য যুদ্ধ করতে হলেও তার চেয়ে বেশী হবে। বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে এক কোটির মত উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এখনই ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে বাঙ্গালী হিন্দুদের সংখ্যাই দাঁড়াবে ৯০ লক্ষের মত। বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরেপক্ষ রাষ্ট্র স্থাপিত না হলে বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তুরা কখনও দেশে ফিরে যাবে না। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য মাথাপিছু ব্যয় দৈনিক দু’টাকা ধরা হলে, ভারতকে তাদের জন্য দৈনিক দু কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। ঐ উদ্বাস্তুদের ভরণ পোষন ও পুনর্বাসনের বোঝা রাষ্ট্রসংঘ বহন করবে না এবং বহন করতে পারবে না। একমাত্র প্যালেস্টাইনের উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। অবশ্য সেই ব্যতিক্রমও ঘটেছে, যুদ্ধের পর সন্ধির শর্ত পালনের বাধ্যবাধকতা হিসবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকারীভাবে কোন যুদ্ধ ঘোষিত হয়নি- তাই সন্ধির শর্তের কোন প্রশ্নই এখানে নেই। কিছুকালের জন্য বিশ্ব সংস্থাগুলি কিছু সাহায্য দিতে পারে কিন্তু তারা নিশ্চয়ই উদ্বাস্তুদের জন্য দায়দায়িত্বের ভারগ্রহণ করবে না।
এসব উদ্বাস্তুর ভারে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। যদি ভারতে পূর্ব বাংলার সব বাঙ্গালী হিন্দুরাই চলে আসতে বাধ্য হয়, তাহলে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাট ওলট-পালট ঘটবে এবং পরিণামে ভারতেও ভীষণ সাম্প্রদায়িক রক্তবন্যা বইতে পারে। এর ফলে এ দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যও বিপর্যস্ত হবে- শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে বর্তমান মন্ত্রীসভার এবং ভারতের পুর্ব অঞ্চলের রাজ্যসমূহের মন্ত্রীসভাগুলির পতন ঘটবে। সে অবস্থায় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজ শিকেয় তুলে রাখতে হবে এবং উন্নয়নমূলক কাজগুলিকে বন্ধ রাখতে হবে। জনগণের নৈতিক মেরুদন্ড দ্রুত ভেঙ্গে পড়বে। তখন ভারতের ভেতরেই গড়ে উঠবে বিচ্ছিনতাবাদী মনোভাব। আর, চুড়ান্ত পর্যায়ে ভারত যুদ্ধকেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। আর যদি যুদ্ধ হয়ই, তাহলে এ যুদ্ধের যে খরচা পড়বে তার দশগুন বেশী খরচা পড়বে ভবিষ্যতের যুদ্ধে- যে যুদ্ধ ঘটবে পাকিস্তানের ইচ্ছায় ও পাকিস্তানের সুবিধামত।
আমাদের এই উপমহাদেশের অগ্রগতির যাত্রা পথে বাংলাদেশ হল হারানো সূত্র। সাম্প্রদায়িকতার জগদ্দল পাথরে ধাক্কা খেয়ে ভারতকে তার আদর্শ থেকে সরে আসতে হয়েছে। পাকিস্তানবাদ এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের সত্যিকারের জবাব হিসেবেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল ও ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবির্ভাব ঘটলে, এই উপমহাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণভেদ এবং সঙ্কীর্ণতাবাদের মত সব শক্তিগুলোই বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশে আমাদের সামনে এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে- যা হয়তো আগামী আর এক শতাব্দীর মধ্যে আবার আমরা পাব না।
ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে যদি পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে, তাহলে পাকিস্তান যে পূর্ব বাংলায় কয়েক দিনের বেশী টিকে থাকতে পারবে না, তা সে ভালভাবেই জানে। কিন্তু এই ভীষণ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া আর কোন পথ নেই। কারণ, পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকরা নিজেদের জনগণের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভারতের কাছে পরাজয় বরণকেই শ্রেয় মনে করবে। পশ্চিমাঞ্চলেই চূড়ান্তভাবে যুদ্ধের নিষ্পত্তি হবে। এজন্য উত্তরাঞ্চল থেকে সৈন্যদের সরিয়া আনার প্রয়োজন হবে না। পূর্বাঞ্চলে পাকবাহীনিকে উচ্ছেদ করা হলে,- যা কয়েকদিনের ব্যাপার মাত্র- আমরা স্বচ্ছন্দেই পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমফ্রন্টে শক্তি বৃদ্ধি করতে পারব। সম্ভবত এক মাসেরও অধিক কাল পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না। এ অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ধসে যাবে। অথবা এমনও হতে পারে যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা নাও করতে পারে। বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানে যে উন্মোদনা দেখা দিয়েছে, তাতে বলা যায় যে, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য গণতান্ত্রিক নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের হাতেই পূর্ব বাংলাকে সমর্পণ করে যুদ্ধে পরাজয় বরণের মত দূরদর্শিতা বিজ্ঞতা পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক গোষ্ঠির মধ্যে নাও থাকতে পারে।।
শত্রুপক্ষকে পিছন থেকে ব্যতিব্যস্ত করে শেষ করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে গেরিলা দল সংগঠন করতে বলা হয়েছে। এ অনেকটা লম্বা চওড়া নির্দেশ দেওয়ার মত ব্যাপার। এমনকি যদি তারা শেষ পর্যন্ত এরকম স্থায়ী শক্তি সংগঠন করতেও পারেন। তবুও ঐ শক্তিকে নির্দিষ্টরূপে দিতে কয়েক বছর কেটে যাবে। আর চীন ও রাশিয়া কারুর মতামতের অপেক্ষা না করে ভিয়েতনামকে যেমনভাবে বিপুল পরিমাণ সাহায্য দিয়েছিল আজও দিচ্ছে, ঠিক তেমনভাবে যে কোন অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থেকে যদি ভারত বিপুল পরিমাণ সাহায্য দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ না হয়, তাহলে এ ধরণের গেরিলা শক্তির নেতৃত্ব ভারতের পক্ষে খুব সহায়ক হবে না। তাছাড়া, মুক্তিফৌজকে অত গোপনে ঐভাবে বিপুল পরিমাণ সাহায্য দেওয়া যাবে না। মুক্তিফৌজকে বিপুল পরিমাণ সাহায্য দেওয়ার জন্যও ভারতকে অবশ্যই সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
উপরন্তু ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে এবং বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসের ভাব বজায় থাকবে না। বাংলাদেশের জনগণকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করার আগে তাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিমান করে দিতে হবে নৈতিক মানদণ্ডহীন জাতিকে যতই অস্ত্র দেওয়া হোক না কেন, কোনদিনই ওই জাতি অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না।
ভারতের মতো উপমহাদেশে নেতা হবেন সুমহান, আর তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মধ্যে থাকবে যুগপৎ দূরদৃষ্টি ও শক্তি। এই দেশকে শাসনের ভার ক্ষুদে শ্রেণীর রাজনৈতিক হাতে দেওয়া যায় না। মহান দেশরূপে যদি ভারত পরিগণিত হয়, তাহলে তাকে বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী দায়িত্বভার বহন করতেই হবে। এ বিষয়ে ইতস্তত করলে চলবে না। এই জাতিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য সুমহান কাজও সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞার প্রয়োজন। কেবলমাত্র সুমহান কাজ ও সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞাই সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। তাহলেই এ দেশ এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হবে এবং সকলের সম্মানের পাত্র ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে দাঁড়াবে। ভারতের সামনে যে দায়িত্ব উপস্থিত, তা যদি সে এড়িয়ে যেতে চায় তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য ও নিশ্চিত।
সম্পাদকীয়, কম্পাস : ২৯শে মে, ১৯৭১