You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.28 | ইয়াহিয়া দুকোটি বাঙালি তাড়িয়ে সংখ্যাসাম্য আনবে | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়া দুকোটি বাঙালি তাড়িয়ে সংখ্যাসাম্য আনবে
রাজনৈতিক সংবাদদাতা

পাকিস্তানের ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা তাদের শাসন ও শােষণ কায়েম রাখতে বাঙালাদেশ থেকে ২ কোটি বাঙালিকে হত্যা করে এবং তাড়িয়ে কমাতে চায়। পাকিস্তানি জঙ্গী শাসন বাঙালিকে খুন করছে। সেই সঙ্গে আরাে খুনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ােগ করা হচ্ছে। বাঙালি নিধনে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ যুক্তভাবে চলছে। সরকারি উদ্যোগে খুন করছে সামরিক-বাহিনী আর বেসরকারি উদ্যোগ চালাচ্ছেন পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় শিল্পপতিরা ; করাচি, পিন্ডি, লাহােরের বড় বড় শিল্পপতি যারা বাঙলাদেশে কলকারখানা ও অন্যান্য ব্যবসার মাধ্যমে অবাধ শােষণ চালাচ্ছিল তারা এই বাঙালি খুনের জন্য ভাড়াটিয়া খুনী নিয়ােগ করছে—এই খুনীদের যথেষ্ট টাকা-পয়সা, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। ঢাকার খাজা খয়রুদ্দিন ও খুলনার সবুর মিঞা সহ মুসলিম লীগ ও কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতারা দিবারাত্র পরিশ্রম করে খুন ও বিতাড়ন চালাচ্ছেন।
দুইটি লক্ষ্য সামনে নিয়ে এই খুন ও বিতাড়ন পর্ব চলছে। এই খুন ও বিতাড়নের প্রথম লক্ষ হলাে বাঙলাদেশ থেকে দুই কোটির মতাে বাঙালিকে মেরে বা তাড়িয়ে গিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের জনসংখ্যার সাম্য আনা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তান লােকসংখ্যায় কম তাই দুই কোটি মানুষকে যদি মেরে ফেলা বা তাড়িয়ে দেওয়া যায় তবে দুই পাকিস্তানে জনসংখ্যা সমান হয়ে যাবে। তখন পূর্ব পাকিস্তান আর
শ্রমিক-কর্মচারী খুন চলছে অতি পরিকল্পিতভাবে। বাঙালিরা কলকারখানায় এলেও খুন করা হচ্ছে, অনেক

ক্ষেত্রে কাজ করতে ডেকে এনে অথবা পাওনা বেতন মিটিয়ে দেবার কথা বলে কর্মচারীদের ডেকে এনে সারবন্দি দাঁড় করিয়ে খুন করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আরাে একটা কাজ করা হচ্ছে। তা হলাে—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অবাঙালিদের এনে বাঙালিদের কাজের জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেশকিছু আড়কাঠিও এই ব্যাপারে ভারতে এসে বিভিন্ন প্রদেশের অবাঙালি মুসলমানদের নানা প্রলােভনে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, বিহার, উত্তর প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে আড়কাঠিরা লােভ দেখিয়ে বলছে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বহু বড় বড় বাড়ি দোকান তারা গিয়ে দখল করলেই তার মালিক তারা হয়ে যাবে। তৈরি বাড়ি ও মূল্যবান সম্পত্তি দোকান যদি তারা পেতে চায় তবে দ্রুত পূর্ব-পাকিস্তানের যে কোন অঞ্চলে চলে যাক। চাকরির তাে অভাব নেই। কনস্টেবল গেলে দারােগা হবে, কেরানি গেলে অফিসার হবে।
ভারত থেকে অবাঙালি আমদানির চেষ্টার মধ্যে দুটো কারণ বর্তমান। প্রথম কারণ হলাে পূর্ববাঙলাতেও যাতে অবাঙালির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় কারণ হলাে—ভারতে উদ্বাস্তু আগমন সম্পর্কে পাল্টা প্রচারে এই ব্যক্তিদের নিয়ােগ করা হবে। মারণ ও তাড়ণ পর্বের দ্বিতীয় লক্ষ্য হলাে দুই কোটির মতাে মানুষ ভারতে পাঠিয়ে ভারতকে বিপদে ফেলা। উদ্বাস্তু সমস্যায় ভারত হিমসিম খাবে, খাদ্যসংকট ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিয়ে সংকটে পড়বে। প্রচারে পাকিস্তান ভয় পায় না। দুই কোটি মানুষকে যদি ভারতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে আর সেই মানুষের সমস্যায় যদি ভারত হিমসিম খায় তবে দুটো দেশ তাকে নিন্দা করলাে আর গালি দিল তাতে কিছু আসে যাবে না। পাকিস্তান সরকার শুধু গুলি বন্দুক বেয়নেট দিয়েই বাঙালি তাড়াবে তাই নয়, আরাে দুটো অস্ত্র সে বাঙালি নিধন বিতাড়ণের জন্য প্রস্তুত করেছে। একটা হলাে এখন যে ৮০/৯০ লক্ষ হিন্দু আছে তাদের তাড়াতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানাে হবে। দ্বিতীয় হলাে, খাদ্যসংকট সৃষ্টি করা হবে। দাঙ্গা লাগলে হিন্দুরা পালিয়ে যাবে আর খাদ্যসংকটে হিন্দু মুসলমান দুই দলই ভারতমুখখা ছুটবে।
খাদ্য-সংকট ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য বৎসর খাদ্য সংগ্রহ ও আমদানির যে সকল পরিকল্পনা থাকে এইবার সেই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর শুধু মাত্র সামরিক বাহিনী ও তাদের রসদ ওঠানাে-নামানাে কাজে লাগানাে হচ্ছে। এই সময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাঙলায় সাধারণত ১৫ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি হয়ে থাকে। এই বৎসর তার এক দানাও হয়নি। এই সবই করা হচ্ছে যত বেশি বাঙালিকে ভারতে পাঠানাে যায় বা তাড়ানাে যায়, সেই পরিকল্পনা মতাে। এই সঙ্গে আরাে একটা পরিকল্পনাও পাকিস্তান ঠিক করে রেখেছে। তা হলাে যাতে কোনক্রমে ভারতে যাওয়া বাঙালিরা পূর্ব বাঙলায় ফিরে আসতে না পারে। প্রথমত এমন অবস্থা সৃষ্টি করাে যাতে কেউ আর বাঙলাদেশ-মুখাে হতে চায়, দ্বিতীয়ত উদ্বাস্তুদের মধ্যে বেশ কিছু ছদ্মবেশী লােক থাকায় যারা অহােরাত্র প্রচার করবে যে আর বাঙলাদেশে ফিরে যাওয়া নয়। তারা বলবে বাচি মরি এই দেশেই থাকব।
সূত্র: সপ্তাহ, ২৮ মে ১৯৭১