You dont have javascript enabled! Please enable it! দ্য সানডে অস্ট্রেলিয়ান | ৬ জুন ১৯৭১ | সম্পাদকীয় - বাংলা পীড়ন ও প্রতিক্রিয়া - সংগ্রামের নোটবুক

দ্য সানডে অস্ট্রেলিয়ান | ৬ জুন ১৯৭১ | সম্পাদকীয় – বাংলা পীড়ন ও প্রতিক্রিয়া

পশ্চিম বাংলায় আমরা আজ যে মানবিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করছি তার সমকক্ষ বিংশ শতাব্দীর ভয়ালতম ইতিহাসেও খুব একটা নেই। এই ধংসযজ্ঞের বৃহৎ ব্যপকতা এবং অনন্য মর্ম বিদীর্ণ করা ভোগান্তির সমকক্ষ কিছুই নেই যা এই মুহুর্তে পুর্ব পাকিস্তানের শরনার্থীরা ভোগ করছে। এ পর্যন্ত জানা পরিসংখ্যায় মৃত এবং উদ্বাস্তুদের সংখ্যা খুবই আতঙ্কজনক; আর এর ফলশ্রুতি তার চেয়েও ভয়াবহ। এই ভয়াবহতা আমাদের অনেককেরই ইচ্ছাশক্তিকে অবশ করে দিয়েছে, মনের অনুভূতি বিলোপ করেছে এবং এই সন্ধিক্ষণে সমস্যার অত্যাবশ্যকীয়তা ধরতে পারছি না। মনে করুন, মেলবোর্ন এবং সিডনির সমগ্র জনগোষ্ঠীকে একসাথে তাদের বাড়িঘর থেকে মারমুখী আর্মি মেরে তাড়িয়ে দিল, প্রানভয়ে তারা ক্ষুধার্ত হয়ে বনে আশ্রয় নিল, খাদ্য-পানি এবং আশ্রয়হীন এই মানুষেরা কী নিদারুণ যন্ত্রণায় তাড়িত হবে, যারা খাদ্যাভাব এবং রোগবালাইয়ে মরার জন্য ধাবিত হবে।

পুর্ব পাকিস্তানে ইতিমধ্যে অনেক বেশি বিপর্যয় ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পোল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের মতই এটি একটি অন্যতম দুর্ভাগা দেশ। ছয়মাসও হয়নি সাইক্লোনে এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ নিহত এবং গৃহহীন হয়েছে। দুই মাস চলছে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিশোধ পরায়ণ আর্মি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর নির্মম আক্রমণ চালাচ্ছে এবং হত্যা ও ধংসযজ্ঞ জারি রেখেছে। ইতিহাসে এর চেয়ে নির্মম কৌতুক আর কিছু হতে পারেনা, যেখানে লাখ লাখ দারিদ্র পীড়িত, ভয়ার্ত মানুষ প্রাণ বাচাতে পালিয়ে যাচ্ছে এমন একটি দেশে যে দেশটি নিজেই সমপর্যায়ে দরিদ্র, অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত, রোগবালাইয়ে বিপর্যস্ত এবং প্রায় একই রকম সমস্যাগ্রস্ত।

এই বিয়োগান্ত পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে বিশ্ব অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছে। বিদেশী সরকারগুলোর সাহায্য অত্যন্ত ধীর এবং অপ্রতুল, এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারকে নিন্দা করে এখনো কিছুই বলেনি যারা এমন ভাব করছে যেন শরনার্থী সমস্যাকে ইচ্ছা করে বড় করে প্রচার করা হচ্ছে। রেড ক্রস এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রাথমিক সমীক্ষা অন্তত এটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমান করে যে পশ্চিম বাংলায় অনুপ্রবেশকারী শরনার্থীর সংখ্যা মাত্রাধিক এবং তা ভারত সরকারের উপর অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে। তাদেরকে একা করে দেওয়া যায়না। ভারতের হিসার মতে এই পরিমাণ শরনার্থীকে আগামী ছয়মাস বাচিয়ে রাখতে হলে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এই রকম ব্যয় সাপেক্ষ ভার যা ভারত সরকার স্বেচ্ছায় নিয়েছে তা চালিয়ে গেলে অতি শীঘ্রই পশ্চিম বাংলা সরকারের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে। ইতিমধ্যে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন যে ভারতের হয়ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও শরনার্থীদের প্রত্যাবাসন করতে হতে পারে। সেহেতু সামাজিক অবক্ষয় ও কলেরার মত মহামারি পশ্চিম বাংলায় একটা আলাদা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সারা ভারতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে।

এখন পর্যন্ত দুই পাকিস্তানকে শান্ত করে একটা রাজনৈতিক মতানৈক্যে পৌছানোর কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এটা খুবই অসম্ভাবনীয় যে এই পরিস্থিতিতে শরনার্থীরা দেশে ফিরে যেতে চাইবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের উপর থেকে হত্যার হুমকি উঠছে এবং কিছুটা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত হচ্ছে। এর দায়দায়িত্ব পুরোটাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের। বর্তমান নিদারুণ দুর্ভোগের আর কোন সমাধানই হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না শরনার্থীদের তাদের জঘন্য নোংরা শিবির থেকে সরিয়ে তাদের নিজেদের দেশে অথবা অন্য কোন নিরাপদ জায়গায় নেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এই মুহুর্তে নিতান্ত প্রয়োজন হল পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচানো। অতি অবশ্যই এখানে বহির্বিশ্বের সচেতনতা এবং সাহায্য প্রয়োজন এবং তা থেকে পালিয়ে বাচার কোন উপায় নেই। অস্ট্রেলিয়া ৫ লক্ষ ডলারের সাহায্য ঘোষণা করেছে, যা শরনার্থীদের একদিন খাইয়ে পড়িয়ে বাচিয়ে রাখবে এবং সময় মত টিকা দেবে। এটা যথেষ্ট নয়। আমরা বিশ্বাস করি সরকারের উচিত সম্পুর্ন প্রকারে সাহায্য করা এবং অস্টকেয়ারের আহ্বানে সাড়া দেওয়া যে সংস্থাটি ইতিমধ্যে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এই দুর্যোগের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ানদের সচেতন করেছে। কিন্তু, রিলিফ সাহায্য কে সত্যকার অর্থে কাজে লাগাতে হলে তা পরিকল্পনা করে বৈশ্বিকভাবে এগুতে হবে। এটা অবশ্যই পাকিস্তান সরকারের মধ্য দিয়ে করা যাবে না, যা দিয়ে তারা তাদের আর্মিকে আরো প্রস্তুত করতে পারে এবং তাদের দমননীতি আরো দীর্ঘায়িত করতে পারে। এক সময় এটা জাতিসঙ্ঘ কে দিয়ে করানো যেতে পারে। কিন্তু তারা এ পর্যন্ত অত্যাবশকীয় কিছুই করেনি। জাতিসঙ্ঘের অনুপস্থিতে অস্ট্রেলিয়া সরকার নিজের উদ্যোগেই কাজ করতে পারেঃ ভ্যাক্সিন এই মুহুর্তে অতি প্রয়োজনীয়, খাবার স্যালাইন এবং টিকাদান যন্ত্র খুবই অত্যাবশকীয় শরনার্থীদের কলেরা প্রতিরোধে। এই মুহূর্তে আমরা দূরে বসে আরামে থাকতে পারিনা। অস্ট্রেলিয়ানদের এটা একটা সুযোগ তাদের দয়া এবং সমবেদনা দেখাবার। আমাদের সবকিছু দিয়ে সাহায্য করা উচিত, মনে রাখা দরকার যে আমাদের এমনকি একটি ডলারের বিনা সাহায্য এবং একদিনের দেরি শরনার্থিদের জীবন দিয়ে শোধ করতে হবে।