পাক জঙ্গীশাহীর দোসর
ভিয়েৎনামে কম্যুনিজমের প্রসার রােধের নামে এক দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধে ইন্ধন যােগানাের পর মার্কিন সরকার এশিয়ায় সম্ভবত আর একটি ভিয়েৎনামের সূচনা করতে চলেছেন। বাংলাদেশের নিরীহ জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যার জন্য এখন তারা ইয়াহিয়া খানের জল্লাদদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। গত মার্চের শেষে বাংলাদেশে পাক সামরিক চক্র যখন গণহত্যায় মেতে উঠেছিল তার কিছু দিনের মধ্যেই ওয়াশিংটন কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানকে কোন সামরিক অস্ত্র সরবরাহ করবেন না বলে ঘােষণা করে বিশ্বের প্রশংসা ভাজন হয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘােষণা স্থায়ী হল না। পিন্ডিকে তারা অস্ত্র সরবরাহের নীতি ত্যাগ করেন নি। এখন দেখা যাচ্ছে জাহাজের পর জাহাজ মার্কিন সমর-সম্ভার নিয়ে করাচী অভিমুখে রওনা হচ্ছে। মার্কিন প্রশাসকগণ যদি প্রথম থেকেই পিন্ডিকে সাহায্য দানে অবিচল থাকতেন তাহলে তাদের স্বরূপ বােঝা যেত। কিন্তু মুখে এক কথা, কাজে অন্য রকম করে তারা সারা বিশ্বকে ধােকা দেবার চেষ্টা করছেন।
দেশের জনমত, সংবাদপত্রগুলির সনির্বন্ধ অনুরােধ অগ্রাহ্য করে মার্কিন প্রশাসকরা পিন্ডিকে সাহায্য দিচ্ছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে বিরােধ জিয়িয়ে রেখে তা থেকে রাজনৈতিক সুযােগ গ্রহণের অভিলাষ পােষণ করছেন। মানবতাবােধ, মমত্ববােধ সব কিছুই তাঁদের কাছে নিরর্থক।
ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ গৃহহারার দুঃখ দুর্দশা, স্বামী পুত্রহীনা নারীর কাতর ক্রন্দন, পাক সামরিক শিবিরে নির্যাতিতা তরুণী-কিশােরীর সকরুন দীর্ঘশ্বাস, অনাথ বালক-বালিকার অসহায় দৃষ্টি ভবিষ্যৎ জিজ্ঞাসা, কোন কিছুই মার্কিন প্রশাসকদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে নি যদিও মার্কিন পত্রিকাগুলাে নীরব নয়। পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্যদানকল্পে ফ্রান্স সম্প্রতি কোন চুক্তি করে নি বলে জানিয়েছে। সােভিয়েট ইউনিয়নও সমর-সম্ভার প্রেরণ করছেন বলে যে অভিযােগ উঠেছে দিল্লীস্থ সােভিয়েট দূতাবা অস্বীকার করেছেন। ভারত সরকারও এ সংবাদ মিথ্যা বলে জানিয়েছেন।
ভারতস্থ প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত চেষ্টার বােলজ পাকিস্তানে মার্কিন সরকারের সমরাস্ত্র প্রেরণের কঠোর সমালােচনা করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় তিনি বলেছেন, এটা যদি মার্কিন সরকারের স্বেচ্ছকৃত সিদ্ধান্ত হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় আর একবার মারাত্মক ভুল করল। এই ভুল ইন্দোচীনের ভুলের চেয়েও অমার্জনীয়। ইতিহাস এ জন্য আমেরিকাকে ক্ষমা করবে না।
মার্কিন সরকার বাংলাদেশের সমস্য সম্পর্কে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছেন। এক দিকে তারা বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের সগ্রামকে দমনের জন্য ইয়াহিয়া চক্রকে সামরিক সাহায্য দিচ্ছেন। অন্য দিকে ভারতে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর জন্য ভারতকে সাহায্য দানের আশ্বাস দিয়েছেন। পাকিস্তান সমরাস্ত্র প্রেরণের দ্রুত সরকারি ব্যবস্থার সমালােচনায় সেনেটর এডােয়ার্ড কেনেডি এক মন্তব্যে বলেছেন, মানবিক সাহায্য দানের চেয়ে দ্রুত সমর-সম্ভার প্রেরণে মার্কিন প্রশাসন অধিকতর যােগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির চাপ দেবার আশা যে সুদূর পরাহত ভারত সরকার তা উপলব্ধি করেছেন। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দুর্বিষহ বােঝা থেকে ভারতকে পরিত্রাণ পেতে হলে অন্য পন্থা তাদের অবলম্বন করতে হবে। শরণার্থীদের দায়িত্ব ভারতের একার নয়, সমগ্র বিশ্বের বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক রাষ্ট্রের দ্বার থেকে অন্য রাষ্ট্রের দ্বারে দীর্ঘদিন ধরে চীৎকার করেও রাষ্ট্র কর্ণধারদের ঘুম ভাঙাতে পারবেন না। তারা জেগে ঘুমাচ্ছেন। এ ঘুম তাদের ভাঙবে না। বিবেক বলতে তাদের কিছু নেই।
তামাম মুস্লিম জাহান আজ নীরব। বাংলাদেশের গণহত্যা, ভারতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আগমনে তাদের বিন্দু মাত্র বিবেক জাগ্রত হয় নি। পাকিস্তানের নিন্দা করা বা গণহত্যা বন্ধে পাকিস্তানকে চাপ দেওয়া তাে দূরের কথা, তাদের অনেকেই পাক-সামরিক চক্রকে সাহয্য দিচ্ছেন।
আর এক বিস্ময়কর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘ। তারাও পাকিস্তানের গণহত্যার নীরব সাক্ষী। ভারতে আগত শরণার্থীদের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘ সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘ তাতে সাড়াও পেয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘের পক্ষ থেকে কোন সাহায্যই ভারতে এসে এখনও পর্যন্ত পৌছায় নি। পাক সরকারের আমন্ত্রণে আগত বৃটিশ পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দল পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা, লুণ্ঠন, নিপীড়ন এখনও ব্যাপকভাবে চলছে বলে ঘােষণা করায় ইয়াহিয়া শাসক চক্র বেসামাল হয়েছেন। পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দল বাঙলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার মিথ্যা কাহিনী ফাঁস করে দিয়েছেন। পাকিস্তানকে এখন কোন সাহায্য দেওয়া হবে না বলে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘােষণা, বৃটিশ সংবাদপত্র বেতার ও টেলিভিশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত ঘটনার তথ্য ও চিত্র প্রকাশের প্রতিবাদ জানিয়েছেন পাকিস্তান। দ’ দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে বলে শাসিয়েছে। প্রখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ‘নিউজ উইক’-এর এক প্রতিনিধি সম্প্রতি কৃষ্ণনগর হাসপাতাল পরিদর্শণ করলে ওপার বাঙলার কুষ্ঠিয়া থেকে আগত ছােট্ট একটি মেয়ে হাতে করে তার গলার গভীর ক্ষতটি ঢেকে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমার কি হবে? কুষ্টিয়ায় ইয়াহিয়া খানের সৈন্যদের হাতে ত পিতা ইসাক আলি নিহত হয়েছেন। মা, তার বড় ভাই, চার বােনকে পাঞ্জাবী সৈন্যরা হত্যা করেছে। সেও রেহাই পায় নি। তার গলাতেও ছুরি বসিয়ে দিয়েছিল জল্লাদরা। পড়ে গিয়ে সে মৃতের ভান করেছিল।
সৈন্যরা চলে গেলে বাড়ী থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়ে। এক সহৃদয় ব্যক্তি তাকে সাইকেলে করে কৃষ্ণনগর হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। মার্কিন সাংবাদিকটি এই অনাথা বালিকার প্রশ্নে বিচলিত হয়েছিলেন। সঠিক উত্তর দিতে পারেন নি। মাতৃপিত আত্মীয়স্বজনহীন নিঃসঙ্গ এই মেয়েটির এ প্রশ্ন বিশ্ব বিবেককেও, এ প্রশ্ন বিশ্বের কর্ণধারদেরও। আমার কি হবে?—তার এই ভবিষ্যৎ জিজ্ঞাসার উত্তর মিলবে কি?
বৃটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ন বাঙলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের আচরণকে কাপুরুষতা বলে অভিহিত করে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি: ডগলাস হিউমকে বিষয়টি রাষ্ট্রসঙ্ঘে উত্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহী যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছে বিশ্বের দরবারে তার প্রতিকার দাবীর পুরাে ভাগে ভারত রয়েছে বলে বৃটেন ভারতকে সাহায্য করছে বলে পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়।
নিকট পাক সরকারের প্রতিবাদকে সম্পাদকীয় স্তম্ভে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।—নিজস্ব প্রতিনিধি
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ জুলাই ১৯৭১