মুজিবের নয়, ইয়াহিয়ার বিচার চাই
জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁর হাতে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য সম্পর্কে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মােস্তাক আহম্মদ যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সে উদ্বেগ তার একার নয়, সকল সভ্য মানুষেরই এই বিষয়ে উদ্বেগ বােধ করার কথা। শাসক হিসাবে যার বন্দুকের জোর ছাড়া আর কোন জোরই নেই সেই ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে হত্যা করতে চাইছেন শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত নেতা। জঙ্গী শাসককে এই জিঘাংসাপরায়ণতা থেকে নিবৃত্ত করার দায়িত্ব সারা পৃথিবীর, সমগ্র মনুষ্যজাতির।
বিদেশী সাংবাদিকের কাছে দম্ভভরে বাংলাদেশের কসাই ইয়াহিয়া খা বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে গােপন বিচারের সম্মুখীন করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে যে অভিযােগ আনা হবে তাতে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। দশ লক্ষ মানুষের হত্যা, অসংখ্য নারীর নির্যাতন, লুণ্ঠন ও ধ্বংসের জন্য যিনি দায়ী তিনি কি করে অন্যের বিচার করবেন? জল্লাদ যেখানে হাকিম সেখানে বিচার বিভাগ হবে? আর শেখ মুজিবুর রহমান এমন কি করেছেন যার জন্য তাঁকে ইয়াহিয়ার কাছে প্রাণবলি দিতে হবে? দেশদ্রোহিতা? মুজিব যদি দেশদ্রোহী তাহলে ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করছিলেন কেন? এই বিচার গােপনেই বা অনুষ্ঠিত হবে কেন? যাকে ইয়াহিয়া খাঁ নিজে একদা ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী বলে আপ্যায়িত করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে আজ কি অভিযােগ, কি সাক্ষ্যপ্রমাণ, এসব কথা দেশের লােককে ও পৃথিবীর মানুষকে জানতে দেওয়া হবে না কেন? ঘৃণিত ইহুদী হত্যাকারী আইকম্যানের বিচারও তাে প্রকাশ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এমনকি ন্যুরেমবার্গের বিচারও গােপনে হয়নি। একজন নিরস্ত্র, নিঃসঙ্গ মানুষ তার হাতের মুঠোয় আদালত তাঁর নিজেরই তৈরি। তবু সেই মানুষটিকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারছেন না? শুধু যে প্রকাশ্য বিচার হবে না, তাই নয়, পিন্ডির মিলিটারি ডিকটেটর বলেছেন, কোন বিদেশী উকিলের সাহয্যও পাবেন না শেখ সাহেন। অর্থাৎ যে মামলা তিনি সাজাবেন সেই মামলা যাতে ফেঁসে না যায়, তার জন্য তিনি খুব হুঁশিয়ার। বিচারের নামে এই প্রহসনে দণ্ডটা আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে, বাকী সবটা মিথ্যা চাল।
এট লক্ষ্য করার বিষয় যে, বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ফাঁসিকাঠে ঝােলাবার হুমকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া একথাও গেয়ে রেখেছেন যে, মৃত্যুদন্ডের আদেশ মকুব করার ক্ষমতা তার রয়েছে। তার এই কথার ইঙ্গিত সম্ভাবত এই যে, মুজিবের প্রাণকে বাড়ী ঘরে তিনি রাজনৈতিক জুয়াখেলায় নামবেন। মুজিবের অনুগামীদের সম্ভবত প্রচ্ছন্নভাবে তিনি এটাই জানিয়ে দিতে চান যে, তারা যদি তাদের নেতাকে প্রাণে বাঁচাতে চান তাহলে তার সঙ্গে একটা আপােষে আসতে হবে। কিন্তু তার সঙ্গে একটা আপােষে আসতে হবে। কিন্তু তার এই শয়তানি চাল ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেননা, বাংলাদেশের মানুষ ইসলামাবাদের পশুশক্তির বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে নেমেছে সেটা মরণপণ লড়াই। কোন ভয় দেখিয়ে বা চাল দিয়ে তাদের সঙ্কল্প থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। সেকথা না বুঝে ইয়াহিয়া যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসির দড়ি পরাতে যান, তাহলে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ পতিনিধি জনাব কে এম সাহাবুদ্দিনের ভাষায়, বাংলাদেশ তাকে কোন দিন ক্ষমা করবে না। তখন আমাদের জবাব হবে—“রক্তের বদলে রক্ত, প্রাণের বদলে প্রাণ।
কিন্তু রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া খাকে এই চরম নির্বুদ্ধিতার পথ থেকে নিবৃত্ত করবে কে? বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মােস্তাক আহম্মদ এই বিচারের প্রহসন বন্ধ করে শেখের প্রাণ বাঁচাবার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি-জেনারেল উ থান্টের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। সেক্রেটারি জেনারেলের উ থান্টের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। সেক্রেটারি জেনারেলের নিশ্চয়ই, এই বিষয়ে একটা কর্তব্য রয়েছে। মানবিকতার নামে, ন্যায়বিচারের নামে তার নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত। পৃথিবীর অন্যন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকেও ইসলামাবাদের শাসকদের উপর চাপ আসা উচিত যাতে বন্দী অবস্থায় মুজিবের কোনরকম শারীরিক ক্ষতি না হয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে যারা মনে করে যে, পিন্ডির নায়করা তাদের কথায় বিন্দুমাত্র দাম দেন। মুজিবের বিচার প্রহসন বন্ধ করার দাবীতে সারা পৃথিবীর জনমত সােচ্চার হয়ে ওঠা উচিত। আর ভারতবর্ষের দিক থেকে আসা উচিত সবচেয়ে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। নয়াদিল্লী পরিষ্কার জানিয়ে দিক যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার জন্য বিচারের মিথ্যা ভাঁওতা দেওয়া হলে ভারত বুঝে নেবে, পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধানই চায় না এবং তখন। আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরে যাওয়ার অনুকূলে অবস্থা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ভারত যে-কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২২ জুলাই ১৯৭১