নিক্সনের ঘােষণার পর বাঙলাদেশ
সব ওলট পালট করে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট নিকসন। তাঁর সম্ভাব্য পিকিং সফরের ঘােষণা জোর ধাক্কা দিয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপর। বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন নয়াদিল্লী। প্রয়ােজন পড়েছে পররাষ্ট্র নীতি ঢেলে সাজবার। ইয়াহিয়ার নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব-জনমত চাঙ্গা করে তােলার বিরামহীন অভিযান এখন স্তিমিত। দুনিয়ার সামনে এতদিন ছিলনা কোন নূতন করে গজান আন্তর্জাতিক সমস্যা। বাংলাদেশ পেয়েছিল প্রাধান্য। এখন নিকসন চৌ এন লাই নিয়ে গবেষণা চলবে সর্বত্র। বাংলাদেশ স্থান পাবে পিছনের সারিতে। অথচ ভারতের কাছে এই সমস্যা জীবন-মরণের সমস্যা। মাত্র ক’দিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি সুপারিশ করেছিলেন পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য বন্ধের জন্য। তারা বলেছিলেন, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত এ সাহায্য পাঠান উচিত হবে না। বিশ্বব্যাঙ্কের মূল্যায়ন এবং মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সুপারিশ আশা জাগিয়েছিল ভারতের মনে। নয়াদিল্লী ভেবেছিলেন, মার্কিন কর্তাদের উপর পড়েছে জনমতের চাপ। তাদের নতি স্বীকার আসন্ন। এ আশা এখন ভেস্তে যাবার উপক্রম। ইয়াহিয়া খান দাড়িয়ে আছেন আসামীর কাঠগড়ায়। তার পক্ষের উকিল চীন। এই চীনের সঙ্গেই ঘটতে যাচ্ছে মার্কিন মিতালী। এর ব্যাপকতা কতখানি এখন তার পরিমাপ করা মুস্কিল। তবে একথা সত্য, চীন-মার্কিন রাখীবন্ধনে দুতীয়ালী করেছে পাকিস্তান। তাকে চটাবে না। আমেরিকা। পাকিস্তান চটলে চটবে চীন। তাতে বিঘ্নিত হবে নিকসনের শান্তি অভিযান। মনে হয় ইয়াহিয়ার নরমেধযজ্ঞে পড়বে মার্কিন সম্মতির প্রকাশ্য ছাপ। তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশের সংগ্রম। ভারতের ভাগ্যে জুটবে আরও বিড়ম্বনা। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী নিয়ে সে পড়বে অথৈ জলে।
নয়াদিল্লী যদি সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দেখাতে পারেন তবে হয়ত ফাড়া কাটবে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে কোন দিনই সমর্থন করেন নি মার্কিন শাসকগােষ্ঠী। ওরা আগাগােড়াই সাহায্য দিয়েছেন ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীকে। সব সময়ই চীন আড়াল করেছে ইয়াহিয়া খানকে। পৃথকভাবে এর দুজনেই পাকিস্তানের প্রাণের দোস্ত। এতদিন তার পৃথকভাবে দাঁড়িয়েছিল ইসলামাবাদের পাশে। এখন হয়ত স্থান নেবে একত্রে। যদি সম্ভাব্য চীন-মার্কিন সমঝােতার প্রকৃতি কূটনৈতিক গন্ডীর বাইরে না যায় তবে ভারতের ভাবনা নেই কিছু। কিন্তু এটা যদি হয় প্রভাবক্ষেত্র বিলিবণ্টনের পূর্বাভাষ তবে প্রয়ােজন পড়েব নূতন চিন্তার। পশ্চিম এশিয়া কিছুতেই ছাড়বে না আমেরিকা। পূর্ব, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নিয়ে চলবে টানাহেঁচড়া। মার্কিন কর্তৃপক্ষ এ অঞ্চল চীনের হাতে ছেড়ে দেবেন কিনা, বলা মুস্কিল। গােপনে যদি এ ধরনের একটা ব্যবস্থা হয়ে থাকে তবে প্রয়ােজন পড়বে নয়াদিল্লীর সামরিক স্ট্র্যাটেজীর পরিবর্তন। কারণ ভারতের বিরুদ্ধে চীনা হুমকীর পাল্টা হিসাবে আসবে না তখন চিরাচরিত মার্কিন হুমকী। ফলে পাকিস্তান হবে আরও দুর্বিনীত। এ ধরনের গবেষণা খুবই কষ্টসাধ্য। রাতারাতি আমেরিকা করতে পারে না তার পররাষ্ট্র নীতির আমূল পরিবর্তন। সােভিয়েট রাশিয়াকে কোণঠাসা করার জন্য যতটুকু দরকার তার বাইরে হয়ত সে পা দেবে না। আমেরিকার কাঁধে ভর দিয়ে জাতে উঠতে চাচ্ছে চীন। সফল হলে ভারত এবং সােভিয়েট রাশিয়া সমভাবেই হবে কোণঠাসা। তাতে বাড়বে উভয় রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা। পরিবর্তিত অবস্থার সুযােগ নিতে হবে। ভারতকে।
সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ খােলা নেই বাংলাদেশ সরকারের সামনে। নয়াদিল্লীও পদে পদে বিড়ম্বিত। একটা একটা করে তাসের ঘর তারা তৈরী করছেন। পরমুহূর্তেই সেগুলাে ভেঙ্গে পড়ছে। মুজিবুর-ইয়াহিয়ার বােঝাপড়ার সম্ভাবনা উবে গেছে। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। এখন নাকি তিনি করবেন মুজিবুরের বিচার। গণহত্যাকারী বর্বর ঘাতক সাজতে চাচ্ছেন জন-প্রতিনিধিধের বিচারক। গত তিন মাসের আপ্রাণ চেষ্টার পর বিশ্বজনমত কিছুটা জাগিয়ে তুলেছিলেন নয়াদিল্লী। মার্কিন মুলুকেও লেগেছিল তার ঢেউ। প্রেসিডেন্ট নিকসনের সাম্প্রতিক ঘােষণায় তাও পড়বে চাপা। সবাই মেতে উঠবেন সম্ভাব্য চীন-মার্কিন সম্পর্কের তাৎপর্য ব্যাখ্যায়। উপেক্ষিত হবেন নির্যাতীত বাংলাদেশের নিরীহ মানুষগুলাে। ভারতের মাথা থেকে নামবে না শরণার্থীর বােঝা। নয়াদিল্লীকে বাছতে হবে নিজের পথ। অবস্থা আগের চেয়েও বেশী ঘােরাল। প্রাথমিক সুযােগ নষ্ট করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার সক্রিয় সমর্থনে তারা যদি আগে ভাগেই এগিয়ে আসতেন তবে এড়াতে পারতেন বর্তমান উপসর্গগুলাে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই। সােভিয়েট রাশিয়ার মতামত নূতন করে বাজিয়ে দেখা দরকার। প্রেসিডেন্ট নিকসনের ঘােষণার পর অবশ্যই সুরু হয়েছে সেখানে আত্মসমীক্ষ। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের পথে নিঃসন্দেহে ভারতের পথ। স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ছাড়া শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তন ঘটলেও পরিবর্তন ঘটবে না এই মহা-সত্যের। বাংলাদেশ সমস্যার আশু সমাধান না হলে মুক্তিসংগ্রামীদের মধ্যেই হয়ত দেখা দেবে ক্ষমতার লড়াই। ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনী যখন ব্যস্ত থাকবে ধ্বংসলীলায় এবং প্রশাসনিক সংহতি প্রতিষ্ঠার কাজে তখন মুক্তঅঞ্জলে হয়ত দানা বাঁধবে দলীয় রাজনীতির প্রাধান্যের প্রতিযােগিতা। বাংলাদেশে হয়ত ঘটবে স্পেনের গৃহযুদ্ধের শেষ দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। সতর্ক হােন নয়াদিল্লী। দ্রুত বদলাচ্ছে দুনিয়ার হালচাল। সংক্ষেপ করুন দ্বিতীয় চিন্তার সময়। বাংলাদেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিন এখনই। দেরী হলে আরও বাড়বে সমস্যার জটিলতা। পঙ্গু হয়ে পড়বেন কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলাদেশের সঙ্গে মহা-তিমিরে ডুববে ভারত।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৮ জুলাই ১৯৭১