অস্ত্রে আত্মনির্ভরতা
প্রতিরক্ষা দপ্তর আশাবাদী। অস্ত্রে স্বয়ম্ভরতার পথে তারা নাকি বহুদূর এগিয়ে গিয়েছেন। পরনির্ভরশীলতার বিপদ কতখানি হতে পারে তা বুঝেছিলেন কর্তৃপক্ষ ১৯৬৫ সালে। পাক-ভারত লড়াইর গতি যখন ভারতের অনুকূলে অতখ অস্ত্র এবং যন্ত্রপাতির সরবরাহ বন্ধ করেছিল বৃটেন এবং আমেরিকা। ব্যবসায়িক চুক্তির মর্যাদা বৃটেন দেয় নি। তারপর স্বম্ভরতার দিকে নজর পড়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। তৈরী হয়েছিল বিভিন্ন পরিকল্পনা। ফল প্রত্যাশিত নয়। উৎপাদনের গতি ছিল মন্থর। পদে পদে ধরা পড়েছিল প্রশাসনিক দুর্বলতা। একথা সত্য, বর্তমান যুগে কোন রাষ্ট্রেরই অস্ত্রে স্বয়ম্ভর হওয়া সম্ভব নয়। বাইরের সরবরাহের উপর তাদের খানিকটা নির্ভর করতে হয়। অস্ত্রের উৎকর্ষের জন্য দরকার উপযুক্ত গবেষণার ব্যবস্থা এবং কারিগরী বিদ্যার জ্ঞান। এ দুটিরই অভাব আছে ভারতে। মনে রাখতে হবে, মারণাস্ত্রের উন্নতির ধাপ খুবই দ্রুত। আজ যা আধুনিক, কাল তা সেকেলে। ভারতের সম্মুখ গতি পরিমাপ করা যাবে চীনের সঙ্গে তুলনা করলে। ১৯৬৫ সালে চীন নিয়েছিল পারমাণবিক বােমা এবং ক্ষেপণাস্ত্রসহ সামগ্রিক সমরসম্ভার উৎপাদন পরিকল্পনা। প্রাথমিক স্তরে সােভিয়েট সাহায্য ছিল তার উন্নয়নের মূল ভিত্তি। হঠাৎ বন্ধ হল সােভিয়েট সাহায্য। দমলেন না তাতে বিজ্ঞানীরা। ১৯৬৪ সালে লােপনেরের পারমাণবিক সংস্থা দুনিয়াকে তাজ্জব বানিয়ে দিল। চীন শূন্যে ঘটল পারমাণবিক বিস্ফোরণ। ভারতের নেই এ ধরনের সঙ্কল্পের দৃঢ়তা। এখানেই যত গন্ডগােল।
চীন এবং পাকিস্তান—এদুটি বৈরী রাষ্ট্র দাড়িয়ে আছে ভারতের দু’পাশে। পিকিং-এ অস্ত্রসজ্জা ব্যাপক এবং মারাত্মক। প্রতি বছর সে তৈরী করছে চল্লিশটি পারমাণবিক বােমা। তার এক একটির ধ্বংসের ক্ষমতা নাগাসাকি এবং হিরােশিমার বােমার চেয়ে দশগুণ বেশী। তাছাড়া চীনের অস্ত্রাগার আছে মাঝারী এবং দূরপাল্লার রকেট। গােটা দুনিয়া চষে অস্ত্র সংগ্রহ করছে পাকিস্তান। ফ্রান্স থেকে সে নিয়েছে সাবমেরিণ এবং জঙ্গী বিমান। আমেরিকাও তার জন্য বাড়িয়েছে অস্ত্রের উদার হাত। বাংলাদেশের গণহত্যা দেখেও থামাচ্ছে না সে অস্ত্র সাহায্য। নয়াদিল্লীর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় নেই পারমাণবিক বােমা নির্মাণের কোন উদ্যম। তাদের ধারণা, পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই অদূর ভবিষ্যতে। ভারতীয় বাহিণীর অস্ত্রসজ্জা ট্রাডিশন্যাল। যুদ্ধজাহাজ থেকে সুরু করে ট্যাঙ্ক, বিমান প্রভৃতি অতি প্রয়ােজনীয় যুদ্ধ সরঞ্জামগুলাে উৎপাদন ব্যবস্থা বিদেশী সহযােগিতায় গড়া। যন্ত্রাংশের অনেকখানি আমদানী করতে হয় বিদেশ থেকে। তার জন্য বাৎসরিক ব্যয়ও বড় কম নয়। ধাপে ধাপে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাবার ইচ্ছা থাকলেও দীর্ঘদিন চলবে পরনির্ভরশীলতা। সরকারি আশ্বস যত উদার ফলশ্রুত তত উৎসাহজনক নয়। প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৯৬২ সালের পরের ঘটনা। ঢাকঢােল পিটিয়ে মাউন্টেন গান নির্মাণের তােড়জোড় হয়েছিল। যেখানে মাসে পঁচিশটি কামান বানাবার কথা, সেখানে তৈরী হয়েছিল মাত্র ছ’-সাতটি। ফিল্ড গান নির্মাণের বেলায়ও দেখা গিয়েছিল একই ধরনের গাফিলতি। এসব কাহিনীর কথা মনে পড়লে প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মতৎপরতায় সংশয় জাগে পদে পদে। তাদের আশ্বাসে মনে দেয় না আশার দোলা। সামনের দিনগুলাে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের হাতে যেসব মারণাস্ত্র রয়েছে, তার দ্বারা পাকিস্তানের মােকাবিলা খুবই সহজ। কিন্তু পিকিং যদি ইসলামাবাদের সঙ্গে জোটে, তবে অবস্থাটা মারত্মক হতে বাধ্য। পাক-চীনের সম্মিলিত বিমানবহর কঠিন আঘাত হানতে পারে ভারতের উপর। নয়াদিল্লী অবশ্যই প্রতিশােধ নেবেন। কিন্তু তার ব্যাপকতা সীমিত হতে বাধ্য। তার উপর যদি আসে পারমাণবিক বােমার হুমকী, তবে বিপদ এড়ান কঠিন। এ-ধরনের সঙ্কটে চাইতে হবে অন্যান্য পারমাণবিক রাষ্ট্রের সাহায্য। সেখানেও বড় হয়ে উঠবে পরনির্ভরশীলতা। আমেরিকাকে বিশ্বাস সেই। সে পাকিস্তানের পরম সুহৃদ এবং তার সামরিক জোটের শরিক। কোন পাক-ভারত লড়াই-এ ভারতকে সে দেবে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। এমনকি শান্তির সময় (১৯৬২ সালের পর) নয়াদিল্লী চেয়েছিলেন অত্যাধুনিক মার্কিন জঙ্গী বিমান। সরাসরি এ-অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ওয়াশিংটন। ভারতের সুবিধা, একটি রাষ্ট্র তাকে অস্ত্র দিতে নারাজ হলে সে শরণাপন্ন হতে পারে অন্য রাষ্ট্রের। মিগ বিমান নির্মণে সােভিয়েট সহযােগিতা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। লােকসভায় স্বরম্ভারতার অগ্রগতির লম্ব ফিরিস্তি দিয়েছেন। ফিরিস্তি দেওয় সােজা, কিন্তু তা কার্যকর করা কঠিন। এসব পরিকল্পনার সময় একটা বড় কথা। কাজের গতি দ্রুত না হলে অর্থের অপচয়রােধ সম্ভাব নয়। নির্দিষ্ট সময়সূচী মেনে না চললে কারখানা থেকে যা বেরুবে তা হবে সেকেলে। এ অবস্থায় পরনির্ভরতার অভিশাপ মত হওয়া যাবে না কোনদিনই। আর যথাসম্ভব তা না হলে জাতির মনে জাগবে না আত্মবিশ্বাস। ঘুচবে না প্রতিরক্ষা বাহিনীর দুর্বলতা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১১ জুলাই ১৯৭১