You dont have javascript enabled! Please enable it!

উত্তরবঙ্গে অকাল-বন্যা

শরণার্থীর স্রোত, কলেরা মহামারী, নিত্য খুন-যখম—এই সবের পর ছিল এই অভাগা পশ্চিম বাংলার কপালে কি আরও সঙ্কট লেখা ছিল? আমরা উত্তরবঙ্গের বন্যার কথা বলছি। বন্যা অবশ্যই এই রাজ্যের নতুন সমস্য নয়। গত বছরই প্রায় গােটা পশ্চিম বাংলা জলের তলায় ডুবে ছিল। আর উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে বন্যা তাে প্রায় বাৎসরিক অভিজ্ঞতা। তবে এবারে বন্যা এসেছে অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক আগে। তার জন্য দায়ী অকাল বর্ষণ। তিস্তার জলে কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যেই ডুবে গেছে। অন্ততঃ বিশ হাজার লােক এখনই গৃহহীন। করলা নদীর জলও কূল ছাপিয়ে উঠেছে। স্থানীয় অধিবাসীরা তাে বিপন্ন বটেই, বাংলাদেশের যে-সব শরণার্থী কোনােরকমে শিবিরে মাথা গোঁজবার জায়গা পেয়েছিলেন তারা আবার নতুন করে আশ্রয়চ্যুত।
উত্তরঙ্গে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভীড় করেছেন। এমনিতেই তাদের ত্রাণের ব্যবস্থা করতে সরকার হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। উত্তরবঙ্গ সফর করে এসে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেদিন বলতেছিলেন যে, সেখানে কয়েক লক্ষ শরণার্থী বসবাসের ব্যবস্থা করার অসুবিধে হবে না। কিন্তু এখন এই অকাল বন্যা সব হিসেবই বানচাল করে দেবে। নতুন শিবির তৈরি দূরে থাকুক, যেগুলি তৈরি হয়েছে সেগুলি টিকিয়ে রাখাই এখন দুস্কর। বন্যার ফলে শিবিরগুলিতে স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়বে এবং রােগের প্রকোপ বাড়বে। তা ছাড়া স্থানীয় লােকের ত্রাণের ব্যবস্থার সমস্যা তাে আছেই।
শরণার্থীরা এই নতুন বিপদকে হয়ত তাদের মন্দ ভাগ্যেরই আর একটি নিদর্শন বলে মেনে নিতে পারেন, কিন্তু উত্তরবঙ্গের মানুষ কি তা পারবেন? তারা কি বেশ কয়েক বছর ধরেই শুনে আসছেন না যে বন্যার কবল থেকে তাদের বাঁচাবার জন্যে সরকার নানা পরিকল্পনা তৈরি করছেন, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন? পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে ঠিকই, টাকা খরচও কিন্তু কম হয়নি, হয়েছে তাপ্পি দিয়ে কাজ চালাবার চেষ্টা। তাই আমরা দেখেখি উত্তরবঙ্গে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বন্যার পর দুর্গত ত্রাণের জন্য খরচ করা হয়েছে ৫৬ কোটি টাকা অথচ টাকার এবং উদ্যোগের অভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য রচিত ১১৪ কোটি টাকার মাস্টার প্ল্যানের ওপর সরকারি দপ্তরে ধুলাে জমেছে। অবশেষে এই বছরেরই গােড়ায় রাষ্ট্রপতির শাসনের আমলে উত্তরবঙ্গের জন্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠন করতে কেন্দ্রীয় সর হন। তখন রাজ্য সরকারের সেচ বিভাগের সচিব এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, গত আর্থিক বছরের মধ্যে অর্থাৎ মার্চের মধ্যেই কমিশনের কাজ শুরু হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজের যে খবর আমরা পেয়েছি তা হল সেচমন্ত্রী ড: কে এল রাও পাঁচজনকে নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাের্ড গঠন করেছেন এবং নিজে শিরােমণি হয়ে বসেছেন। অবশ্য মার্চের মধ্যে কাজ হলেই এ-বছরের বন্যা ঠেকানাে যেত না, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তা হল এ-বিষয়ে আর কোনাে কালক্ষেপনের সময় নেই। ড: রাও সব দায়িত্ব নিজের কাধে— বলেই এ-ব্যাপারে তার কেরামতির কথা আমরা — তাছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারই বা শেষ পর্যন্ত — উপুড়হস্ত হবেন তাও আমরা জানি না, কারণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশনের জন্যে নাকি প্রয়ােজনীয় বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাজ দস্তুরমতাে সুরু হওয়া এখনই দরকার। অন্তত: উত্তরবঙ্গের মানুষ এ বছর বন্যার জলে খাবি খেতে খেতেও এই স্বপ্ন দেখতে পারেন যে, এ দুর্ভোগের সত্যিই এক দিন অবসান হবে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৪ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!