ইয়াহিয়ার জন্য জলছত্র
অপদার্থ কেন্দ্রীয় প্রশাসন। তাদের অদূরদর্শিতার পুরা সুযােগ দিচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। পঞ্চাশ লক্ষ বাঙ্গালী শরণার্থী তিনি পাঠিয়েছেন ভারতে। আরও পাঠাবেন। সবাইকে তিনি ফেরত নেবেন না। নয় দিল্লীর বিশ্ব পরিক্রমা ব্যর্থ হবে। বাইরের স্বীকৃতি এবং সাহায্য ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আর কতদিন ঘাটি আগলিয়ে থাকবেন? এ সত্য অস্বীকার করে লাভ নেই, স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া অধিকাংশ শরণার্থী ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। আনেকে মরবেন। যারা বাঁচবেন শেষ পর্যন্ত তাদের হয়ত হবে জমিদান। ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকার খুলেছেন জলছত্র। ভারতীয় নদীর জল নিয়ে পশ্চিম পাঞ্জাবের কৃষকরা ফেপে উঠছেন। তাদের সন্তানরা যােগ দিচ্ছেন সৈন্যদলে। বাংলাদেশে এসে করছেন গণহত্যা, নারী ধর্ষণ এবং ধ্বংসলীলা। তাদের নারকীয় তান্ডবের জের পােহাতে হচ্ছে ভারতকে।
দশ বছর আগে, ১৯৬০ সালে নেহরু-আয়ুব স্বাক্ষর দিয়েছিলেন সিন্ধু নদের জন বণ্টন চুক্তিতে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ছিলেন তার সাক্ষী। দু’শ ষাট লক্ষ একর জমির জন্য ভারত পেয়েছিল পাঞ্জাবী নদীগুলাের মােট জলের বিশ ভাগ। আর তিনশ’ নব্বই লক্ষ একর জমির জন্য পাকিস্তানের কপালে জুটেছিল আশীভাগ। তাছাড়া বাঁধ নির্মাণের ব্যয় বাবদ পাকিস্তানকে ভারত দিয়েছিল কিস্তিবন্দী হারে মােট তিরাশী কোটি তিরিশ লক্ষ টাকা। অতি উল্লাসে নেহরু সেদিন ঘােষণা করেছিলেন—এ চুক্তি পাক-ভারত মৈত্রী এবং সহযােগিতার দৃঢ় বুনিয়াদ। চুক্তির অসম শর্তগুলাে নজরে পড়ে নি কর্তৃপক্ষের। তাঁদের পাকিস্তান তােয়াজ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চুক্তির দশ বছরের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ইরাবতী, শতদ্রু এবং বিপাশার পুরা জল এখন ভারতের দখলে। চুক্তি অনুযায়ী তার কোন অংশ পেতে পারে না পাকিস্তান। কিন্তু দখলের জন বেদখল হয়ে যাচ্ছে। দশ বছরের মধ্যে পাক-সরকার সব গুছিয়ে নিয়েছেন। ভারত পড়ে আছে বহু পিছনে। ইরাবতীতে হয় নি প্রয়ােজনীয় বাঁধ নির্মাণ। জল চলে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষিক্ষেত্রে। ভারতীয় জলে ফসল ফলাচ্ছেন পাক-চাষীরা। ভারতরে চাষীরা মাথায় হাত দিয়ে ভাবছেন—কোন রাজত্বে বাস করছেন তারা? যে জল হাতছাড়া হচ্ছে সে জল ব্যবহার করতে পারলে ভারতের জমিতে উৎপাদত হতে পারত পঁয়তাল্লিশ কোটি টাকার খাদ্যশস্য। কেন এই অঘটন ঘটছে তার কৈফিয়ৎ চেয়েছিলেন লােকসভার সদস্যগণ। গতানুগতিক জবাব দিয়েছেন সেচমন্ত্রী ডা: কে এল রও। সেই পুরানাে কথা—অর্থাভাব। মাত্র তিনশ’ কোটি টাকা। এই টাকাটা হাতে পেলেই নাকি কর্তৃপক্ষ কেল্লা ফতে করতে পারতেন। এক ফুটা জলও যৈত না পাকিস্তানে। চতুর্থ যােজনায় তারা পান নি প্রয়ােজনীয় টাকা। পঞ্চম যােজনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সুতরাং অনির্দিষ্টকালের জন্য ইরাবতীর জল গড়াবে পাকিস্তানে। নয়াদিল্লীর বন্ধু নন ইসলামাবাদ। খেয়ে দেয়ে ওদের গায়ের জোর যত বাড়বে ভারতের উপর তত বেশি আঘাত আসবে। ইরাবতীর জলকে কেন অগ্রাধিকার দেওয়া হল না—তার জবাব কে দেবেন? লােকসভায় শ্রীমতী গান্ধীর দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাধিক্য। কাউকে পরােয়া করার দরকার নেই। মন্ত্রিসভার নির্বুদ্ধিতাকে অতি বুদ্ধিমানের লক্ষণ বলে চালালেও কারও কিছু বলার নেই। জলের জন্য মাথা কুটুক ভারতীয় চাষী। ভারতের বেওয়ারিশ জল নিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাক পাকিস্তান। তিনশ’ কোটি টাকাও জুটবে না। ইরাবতীর পুরাে জল ভারতেও পাবে না।
খালেদ জল নিয়ে আয়ুব খান করেছেন বহু কারসাজি। সেচের টাকা এবং জল ব্যবহৃত হয়েছে সামরিক প্রয়ােজনে। ১৯৬৫ সালের লড়াই-এর সময় ইছেগিল খালের পারে দাঁড়িয়ে জওয়ানেরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন এই নির্মম সত্য। বাঁধ নির্মাণের জন্য পাকিস্তানকে দেয়া টাকা বন্ধ করার দাবী উঠেছিল লােকসভায়। সেচের খাল সামরিক প্রয়ােজনে নির্মাণ এবং ব্যবহার চুক্তিভঙ্গের সামিল। বিশ্ব ব্যাঙ্কের পশ্চিমী মুরুব্বীরা প্রতিকূল। তাদের চাপে নয়াদিল্লী নিতে পারেন নি কোন সক্রিয় ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রী বলেছিলেন—
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ জুন ১৯৭১