You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরণার্থীদের বাড়ীঘর বেদখল

বিচলিত হয়ে পড়েছেন নয়াদিল্লী। ইসলামাবাদের কাছে নােট পাঠিয়েছেন তারা। তাতে জানানাে হয়েছে। ভারতের উদ্বেগ। কেন্দ্রীয় সরকারের অভিযােগ, হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক শরণার্থীরা যাতে স্বদেশে ফিরতে না পারেন তার পাকাপাকি ব্যবস্থা করছে পাকিস্তান। তাদের ফেলে আসা বিষয়সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গী শাসকেরা এগুলাে বিলিয়ে দিচ্ছেন সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলমান এবং জঙ্গীশাহীর দালালদের মধ্যে। আসল মালিকদের দলিলপত্র ধ্বংস করা হচ্ছে। সরকারি মহাফেজখানায় মিলবে না তার সন্ধান। শরণার্থীরা সঙ্গে করে আনতে পারেন নি তাদের দখলীস্বত্বের প্রমাণ। সবারই যে বিষয়সম্পত্তি ছিল এমন কোন কথা নেই। এই শ্রেণীর শরণার্থীর ঘরে ফেরার কোন পথই খােলা থাকবে না। বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল এক কোটি। ইয়াহিয়ার শাসনচক্র চালু থাকলে তাদের একজনও টিকতে পারবেন না তাদের বাড়ী ঘরে। ওদের সমূলে উচ্ছেদ ইসলামাবাদের সুপরিকল্পিত নীতি। জঙ্গী শাসকরা তাদের মনােভাব গােপন রাখেন নি। লন্ডনের সান্ডে টাইমসে প্রকাশিত এন্থনী মাসকারেনহসের বিবরণে এবং শরণার্থীদের মুখের জবানীতে জানা গেছে এই নারকীয় তথ্য। যদি হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকরা কোনদিন ফিরে যেতে চান স্বদেশে তবে সেখানে গিয়ে কি দেখবেন তারা? বাড়ীঘর, জমিজমা, বিষয়সম্পত্তি সব বেদখল। আর বেদখলদারদের রক্ষা করছেন জঙ্গী শাসকেরা। দলিলপত্র লােপাট। বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দার প্রমাণ জুটাতে পারবেন না তারা। খালি হাতে আবার ফিরে আসতে হবে ভারতে।
ইয়াহিয়া আগেভাগেই গেয়ে রেখেছেন—আসল পাকিস্তানিরাই শুধু ফিরতে পারবেন পূর্ব পাকিস্তানে। নকলরা পাবেন না সেখানে কোন ঠাই। এই নকলের দলে অবশ্যই পড়বেন হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক শরণার্থী। এদের বিষয়সম্পত্তির বিলি বণ্টন ইতিমধ্যেই প্রায় সমাপ্ত। যাদের তাড়ান এখনও বাকি আছে তাদের ভিটে ছাড়া সম্পূর্ণ হলেই কাজ হাসিল। ওদের অধিকাংশই হিন্দু। এই অবস্থায় নয়াদিল্লী পাঠিয়েছেন নােট। ইসলামাবাদরে কাছে তারা অনুরােধ করেছেন—শরণার্থীদের ফেলে আসা বিষয়সম্পত্তির দলিলপত্র যেন ধ্বংস করা না হয়। তাদের বাড়ীঘর এবং জমিজমাও যেন বেদখল হয়ে না যায়। নয়াদিল্লী হয়ত ভাবছেন, সামনের দিনগুলাের কথা। তাঁদের ধারণা, অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হলেই ওরা ফিরবেন স্বদেশে। যারা পরিকল্পনা অনুযায়ী তাড়াচ্ছেন হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের তারাই কি সৃষ্টি করবেন শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের অনুকূল অবস্থা? যারা ফেরত নেবেন না তথাকথিত নকলদের তারাই কি আগলিয়ে রাখবেন তাদের পরিত্যক্ত বিষয়সম্পত্তি? এ নােটের বাস্তব মূল্য নেই এক কানা কড়িও। পাকিস্তান ওটাকে ফেলে দেবে জঞ্জালের ঝুড়িতে। আর ভারত এ নােটের প্রতিলিপি সযত্নে ফাইল বন্দী করে রাখবে তার মহাফেজখানায়। আসল সমস্যা যখন আসবে তখন সে ওটা হাতে নিয়ে বিশ্ব জনমতের কাছে সুরু করবে। মরা কান্না।
শরণার্থীদের ফিরে যাবার প্রসঙ্গটি নূতন নয়। ১৯৫০ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল নেহরু-লিয়াকত চুক্তি। উদ্বাস্তুদের পরিত্যক্ত বিষয়সম্পত্তি সংরক্ষণ এবং সেগুলাের প্রত্যর্পণের সুনির্দিষ্ট ধারাগুলাে সন্নিবিষ্ট ছিল। তাতে। এ চুক্তি কি মেনেছে পাকিস্তান? কতজন উদ্বাস্তু ফিরতে পেরেছিলেন স্বদেশে? পুরানাে পথের ব্যর্থতা চোখের সামনে সজীব থাকা সত্ত্বেও নূতন পথ দেখছেন না নয়াদিল্লী। আবার ধর্ণা দিচ্ছেন ইসলামাবাদের দরজায়। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ছাড়া শরণার্থী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ঢাকা এবং ইসলামাবাদের জোড়াতালির আপােষ কোন কাজে আসবে না। যতদিন পাক সৈন্যদল বাংলাদেশে থাকবে ততদিন শরণার্থীদের ফেলে আসা সম্পত্তির বেদখলদারদের উচ্ছেদ করতে পারবেন না কেউ। যিনি এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা হবেন তিনি নিজেই (যদি গর্দান বাঁচাতে পারেন) শরণার্থী হয়ে ঘুরছেন আশ্রয়ের সন্ধানে। মুক্তিফৌজের সংগ্রাম যদি জয়যুক্ত না হয় তবে বাংলাদেশের এক কোটি হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক মুসলমানদের কোন সম্ভাবনা নেই স্বদেশে ফেরার। অন্ধকারাচ্ছন্ন এই সম্ভাবনার কথা চিন্তাও করা চলে না। অকারণ সময় নষ্ট করছেন নয়াদিল্লী। স্বীকৃতি দিন বাংলাদেশ সরকারকে। জোড়দার করুন তাদের হাতিয়ার। এ পথেই আসবে বাংলাদেশের শক্তি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২১ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!