You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.20 | কার ভরসায় ফিরবেন শরণার্থীরা? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

কার ভরসায় ফিরবেন শরণার্থীরা?

শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাদের ফেরত পাঠাবেন। এদিকে শরণার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের সংখ্যা এখন ষাট লক্ষের কোঠা ছাড়িয়ে গিয়াছে। প্রধানমন্ত্রীর যুক্তির সঙ্গে কারও মতবিরােধ নেই। শরণার্থীরা ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক। মানবতার খাতিরে ভারত দিয়েছে তাদের সাময়িক আশ্রয়।.ওরা পাকাপাকিভাবে থাকতে পারেন না এদেশে। এই দুর্গত মানুষগুলােকে ফেরত পাঠাবার উপায় কি? এ নিয়ে শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে অনেকরই মতের মিল হবে না। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে এবং নয়াদিল্লী বলছেন, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দরকার বাংলাদেশে। কিন্তু এই পরিবেশ সৃষ্টি করবেন কারা? তার পদ্ধতিই বা কি? এমতী গান্ধীর মতে, ইয়াহিয়া-মুজিবুর আলােচনায় বসবেন। গণতান্ত্রিক ফয়সালা মানতে বাধ্য করতে হবে ইসলামাবাদকে। কে বাধ্য করবেন ইয়াহিয়া খানকে? এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব মিলছে না নয়াদিল্লীর কাছ থেকে। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলােও চায় বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। এই সমাধানের জন্য ইসলামাবাদের উপর প্রত্যক্ষ চাপ দিতে তারা অনিচ্ছুক। পাক সৈন্যরা বিরামহীন ধ্বংস যজ্ঞ চালাচ্ছে বাংলাদেশে। সুপরিকল্পিত উপায়ে তাড়াচ্ছে সংখ্যালঘু এবং জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের। আবর শরণার্থী ফেরত নেবার জন্য দু-চারটি শিবিরও তারা খুলছে। ইয়াহিয়া জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। একমাত্র আসল পাকিস্তানিই পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাবার অধিকারী—একথা তিনি আগে বলেছেন। এখন বড় একটা বলছেন না। গােপন নির্দেশ হিসাবে ওটা হয়ত কার্যকর হবে। দুনিয়াকে ধোঁকা দেবার জন্যই চলছে এ ধরনের কারসাজি।
ইসলামাবাদের সুহৃদরাও হালে পানি পাচ্ছেন না। রাষ্টসঙ্রে শরণার্থী দপ্তরের হাই-কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান নিজেও বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের অনুকূল নয়। সন্ত্রাসের শাসন বন্ধ করতে হবে সেখানে। তা বন্ধ করার দায়িত্ব বিশ্বসভার শরণার্থী দপ্তরের নয়। এদিকে গাঁটের পয়সা খরচ করে মন্ত্রীরা ঘুরছেন দেশ-বিদেশ। ওরা ভুলে যাচ্ছেন, ভারতীয় মন্ত্রীদের অশ্রুসজল মুখখানি দেখে নীতি নির্ধারণ করবে না বিদেশী রাষ্ট্রগুলাে। তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং সমস্যার নিজস্ব মূল্যায়নের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে তাদের পাকিস্তানি নীতি। একথা এখন স্পষ্ট যে, ওরা চায় না পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব ভেঙ্গে ফেলতে। জনগণের সংখ্যাধিক্যের রায় সামরিক শাসকরা যদি জঞ্জালের ঝুড়িতে ফেলে দেন, তাতে ক্ষতি নেই। তবু পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব চাই। ইসলামাবাদ প্রচার করছেন, সামরিক অভিযানের দ্বারা তারা অটুট রেখেছেন ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান। জনগণের সমর্থনহীন ঐক্যের মূল্য কতটুকু তা নিয়ে মাথা ব্যথা।
কারও। একটা রাষ্ট্রের অখণ্ডতু যদি এতই মূল্যবান হয়ে থাকে তবে সাইপ্রাসে তুর্কী সিপ্রিয়টদের বিচ্ছিন্নতামূলক আন্দোলন কোন যুক্তিতে সমর্থন করেছে পাকিস্তান? তার দোস্ত তুরস্কই বা বিচ্ছিন্নতাকামীদের উস্কানী দিচ্ছে কেন? বৃটেনই বা সংখ্যাগুরু গ্রীক সিপ্রিয়টদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আঁটছে। কেন? জনসংখ্যার দিক থেকে গােটা পাকিস্তানে সংখ্যাধিক বাংলাদেশ। সংখ্যাগুরুরা করতে পারে না বিচ্ছিন্নতামূলক সংগ্রাম। ওটা করে থাকে সংখ্যালঘুরাই। বাংলাদেশের সংগ্রাম, স্বৈরাচারী সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুর সংগ্রাম। এই মৌল তত্ত্ব গুলিয়ে দিলে চলবে না।
আত্মপ্রবঞ্চনা করে লাভ নেই। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম না হলে অধিকাংশ শরণার্থী ফিরবেন না স্বদেশে। ইসলামাবাদ অনড়। তারা স্বেচ্ছায় ছাড়বেন না বাংলাদেশের শাসন অধিকার। ইয়াহিয়া-মুজিবুরের পুনঃবৈঠক সুদুরপরাহত। শহীদের রক্তের উপর পদচিহ্ন রেখে মুজিবুর যাবেন না ইয়াহিয়ার কলঙ্কিত হাত স্পর্শ করতে। স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্বীকার করার অর্থ পূবের বাঙালীর অপমৃত্যু। তার পরিণাম, হিন্দুশূন্য বাংলাদেশ। এ ধরনের ঘটনা যদি সেখানে ঘটে তবে এখানে পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর। সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেবে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া। সংযমের বহু সার্টিফিকেট পেয়েছেন। নয়াদিল্লী। এগুলাে ধুয়ে জল খেলে হবে না মুস্কিল আসান। ইয়াহিয়া ভারতে জ্বালাতে চান সাম্প্রদায়িকতার আগুন। তাঁর ষড়যন্ত্র বানচাল করতে কেন্দ্রীয় সরকার বদ্ধপরিকর। তাঁদের সাধু উদ্যমে সবার আছে অকুণ্ঠ সমর্থন। ইয়াহিয়া বাধাতে চান পাক-ভারত লড়াই। দলে দলে তিনি শরণার্থী পাঠাচ্ছেন। তার কামানের গােলা পড়ছে ভারতীয় এলাকায়। এ পর্যন্ত হতাহত হয়েছেন সত্তরজন ভারতীয় নাগরিক। প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছুই করবেন না কর্তৃপক্ষ। করলে যুদ্ধ বাধবে। ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র সার্থক হবে। এই ক্লৈব্যনীতি নিয়ে কাকে কি বুঝাবেন প্রধানমন্ত্রী? শরণার্থীর বােঝা বেশিদিন বইতে পারবে না ভারত। শক্তির প্রয়ােগ তাকে করতেই হবে। তার প্রথম ধাপ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান। জয়যুক্ত করতে হবে তাদের সংগ্রাম। বাংলাদেশ থেকে ইয়াহিয়ার চমুর সমূলে উচ্ছেদের পরই আসবে শরণার্থীদের স্বদেশে পাঠাবার প্রশ্ন। এ কাজ যত বিলম্বিত হবে সমস্যার জটিলতা তত বাড়বে। জোড়াতালির কোন সুযােগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর আস্ফালনে আস্থা নেই কারও। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া ঘায়েল না হলে শরণার্থীদের তিনি ফেরত পাঠাতে পারবেন না নিজেদের বাড়ী-ঘরে। কার ভরসায় ফিরবে তারা? এই সহজ সত্য তিনি বুঝতে চাচ্ছেন বলেই ভারতের ভাগ্যে জুটছে শুধু বিড়ম্বনা। তার আকাশে জমা হচ্ছে দুর্যোগের ঘনঘটা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২০ জুন ১৯৭১