You dont have javascript enabled! Please enable it!

সদরুদ্দিনের হাত ধরে ওরা ফিরবেন না

রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী সংক্রান্ত হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগামী মঙ্গলবার যখন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে গিয়ে আশ্রয়প্রার্থীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন ঠিক তখনই কয়েশ শ আশ্রয়প্রার্থীকে এই দেশের আরও ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিমানে তােলা হচ্ছিল। প্রিন্স যা চাইছিলেন তা যদি না হত তাহলে এরা সীমান্তের ক্যাম্পগুলিতেই পড়ে থাকতেন। কিন্তু যেহেতু বাস্তব ঘটনা হল এই যে, এই শরণার্থীদের পূর্ববঙ্গে ফিরে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়নি এবং যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে এই লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু সমাগমের বোেঝা সামলান সম্ভব নয় সেহেতু এই ভাগ্য-তাড়িত মানুষগুলিকে যেতে হচ্ছে ঘরের দিকে নয়, ঘর থেকে আরও দূরে।
প্রিন্স সদরুদ্দিন নিজে এখন ইরানের নাগরিক হলেও বংশ-পরিচয়ে তিনি ভারত বা পাকিস্তান, কোথাও অজানা মানুষ নন। তাঁর পিতা মহামান্য আগা খা অবিভক্ত ভারতে একজন সুপরিচিত মানুষ ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনায়ও তাঁকে যােগ দিতে দেখ গেছে। আর প্রিন্স সদরুদ্দিনের অগ্রজ এক সময়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলেন। এবার তিনি নিজে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফ থেকেই পাকিস্তান ও ভারতে এসেছেন। সুতরাং তিনি এই সফরে এসে যা কিছু করবেন ও যা কিছু বলবেন তার উপর গুরুত্ব আরােপ করতেই হবে। তিনি বলেছেন যে, শরণার্থীদের সমস্যার সঠিক সমাধান তখনই হবে যখন এরা নিজেদের ঘরে ফিরে যাবেন। তিনি একথাও স্বীকার করেছেন যে, শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার মতাে অবস্থা সৃষ্টি করার দায়িত্ব পাকিস্তানের। সমস্যাটি যে বিরাট ও ভারতবর্ষ এদের জন্য যা করছেন সেটা যে প্রশংসনীয়, এসব কথাও প্রিন্স সরফুদ্দিন বলতে দ্বিধা করেন নি। তার এইসব মন্তব্যের জন্য এদেশের মানুষ ও এদেশের সরকার তাঁকে ধন্যবাদ দেবেন। তার কথার মধ্য দিয়ে অন্তত এইটুকু ভরসা পাওয়া যাচ্ছে যে, এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ভারত রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাহায্য পাওয়ার আশা করতে পারে।
একদিক থেকে দেখতে গেলে অবশ্য রাষ্ট্রসঙ্ঘ এই শরণার্থী সমস্যায় নিজেকে জড়িতেদ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও গ্রহণ করেছে। কেননা রাষ্ট্রসঙ্ঘের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের সাহায্য দেওয়ার একটি অবশ্যপালনীয় শর্তই হল এই যে, এই শরণার্থীরা যে দেশ থেকে এসেছেন সেই দেশেরই নাগরিকরূপে গণ্য হবেন, যেহেতু আশ্রয় নিয়েছেন সেদেশের অথবা অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব তাঁরা গ্রহণ করতে পারবেন না। এই কারনেই এর আগে যতবার ভারতে পাকিস্তান থেকে আশ্রয়প্রার্থীরা এসেছেন কোন সয়য়ে রাষ্ট্রসঙ্ তাদের নিয়ে মাথা ঘামান নি, এবার ঘামাচ্ছেন। তবু প্রিন্স সদরুদ্দিন যে নিজে সরকারিভাবে সফরে এসে কথাগুলি বলে গেলেন এতে ভারত সরকারের কয়েকটি প্রধান বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া গেল।
কিন্তু একই সঙ্গে রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই হাই কমিশনার মহােদয় ইয়াহিয়া সরকারকে যে সার্টিফিকেট দিয়েছেন সেটা মেনে নেওয়া মুশকিল। তিনি বলেছেন, শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার নাকি বড়ই আগ্রহী এবং এই উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গের জঙ্গী সরকার সীমান্তে যেসব অভ্যর্থনা শিবির’ খুলেছেন সেগুলিতে তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন শুরু হতে দেখেছেন। শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ইসলামাবাদের যদি এতই আগ্রহ তাহলে পূর্ববঙ্গ থেকে এখনও শরণার্থীরা আসছেন কেন? সংবাদে প্রকাশ যে, কয়েকদিন আশ্রয়প্রার্থীদের আগমন বন্ধ থাকার পর আবার গত রবিবার থেকে তিন দিনে সীমান্তের দুটি জায়গা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দুটি জেলায় ১৮ হাজার মানুষ এসেছেন। যদি ফিরে যাওয়ার মতাে অবস্থা তৈরি হয়ে থাকে তাহলে এরা আবার নূতন করে আসছেন কেন?। ২২ মে তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ‘যথার্থ পাকিস্তানিদের ফিরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তারপর থেকে ২০ লক্ষ নূতন আশ্রয়পার্থী এসেছেন। তবু মানতে হবে পূর্ববঙ্গে ফিরে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে? আর এই ‘যথার্থ পাকিস্তানি’ কারা, তাদের যাচাই করার কি ব্যবস্থা? এসব বিষয়ে প্রিন্স সদরুদ্দিন সাহেব কি পাকিস্তানের জঙ্গী নেতাদের কাছ থেকে সন্তোসজনক জবাব পেয়েছেন? পাকিস্তানের প্রতিনিধি তাে রাষ্ট্রসঙ্ঘে বলেছেন যে, মাত্র হাজার চল্লিশেক পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে গেছেন। এতে কি আশ্রয়প্রার্থীদের নিজের নিজের ঘরে ফিরতে দেওয়ার আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছে?
আসলে এই শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার প্রশ্নটি যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের সঙ্গে জড়িত সেকথা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে দাবিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টায় ইয়াহিয়া সরকার পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের নির্বিচারে তাড়াবার ও মুসলমানদের মধ্যে বেছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে বিশ্বসীদের উৎখাত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এই মতলব ছাড়তে যতদিন ইসলামাবাদকে বাধ্য করা না যাচ্ছে ততদিন প্রিন্স সদরুদ্দিনের হাত ধরে ঘরে ফিরে যেতে আশ্রয়প্রার্থীদের রাজী করান যাবে না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৭ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!