You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.14 | মানুষ মরছে, সাহায্য দিতে তবুও এত দ্বিধা? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মানুষ মরছে, সাহায্য দিতে তবুও এত দ্বিধা?

এ আমরা কোন ধরনের পৃথিবীতে বাস করছি? একদল বর্বর হুন নগ্ন নির্লজ্জ, কাপুরুষ আক্রমণে যখন একটি নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয় ও শান্তিকামী জাতিকে ধ্বংস করবার জন্যে উদ্যত, তখনও দুনিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলি যারা দুনিয়ার ভাগ্যকে ঘুরিয়ে দেবার মতাে ক্ষমতা রুখে এবং শান্তি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি মহামূল্যবান বিষয়গুলাে রক্ষা করবার গুরুভার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে, একেবারে চুপ। তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয়, তাবৎ যে সমস্ত রাষ্ট্র একদিন নিজেরাই ঔপনিবেশিক শােষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়েছিল আর সেই শােষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের জন্যে দুনিয়ার সমর্থন কামনা করেছিল, এতবড় একটি প্রমাণিত গণহত্যার সামনে দাড়িয়েও তাদের মুখে কোনাে কথা নেই। মানুষের দুঃখে, মানুষের যন্ত্রণায়, মানুষের মৃত্যুতে সাধারণ লােকের যে প্রকাশটুকু দ্রতা ও সভ্যতাসম্মত সেটুকুও তারা দেখাতে কুণ্ঠিত দ্বিধাগ্রস্ত।
হয়ত একথা ঠিক যে, রাজনৈতিকদের কাছ থেকে একটু বেশিই প্রত্যাশা করেছিলাম কিংবা করছি। ভুলে গিয়েছিলাম যে, রাজনীতির সঙ্গে মানবতার কোনাে সম্পর্ক নেই। রাজনীতিকদের যে মন্ত্রণার কক্ষে বসে ভিয়েতনামে পচিশ হাজার পউন্ডের বােমা ফেলে পাহাড় সমতল একাকার করে দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেই কক্ষ থেকে অত্যাচারিত মানবতার জন্যে সমবেদনা কখনই উচ্চারিত হতে পারে না। কিন্তু যাদের হৃদয় সর্বদাই দয়ায়, দাক্ষিণ্যে ও খৃষ্টীয় অনুকম্পায় ভরপুর হয়ে রয়েছে পীড়িতের সেবা করা যাদের ধর্ম কিংবা পেশা কিংবা স্ব-আরােপিত ব্রত, তারা কেনা এখনাে কেবল দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন? যখন মানুষ মরছে। ঘরবাড়ি জ্বলছে, আহতের আর্তনাদে বাতাস প্রচণ্ড রকমে মুখর হয়ে উঠেছে, আশ্রয়চ্যুত, বিপন্ন মানুষ সাহায্যের সন্ধান করছে, প্রেম, ভালােবাসা, সদাচার আর মানবতার এই সব কারবারীরা এখনাে কেন নূন্যতম সাহায্যে নিয়েও এগিয়ে আসতে অনিচ্ছুক?
সে কি এই জন্যে যে, এই বিচিত্র পৃথিবীতে দয়া, মায়া, প্রেম, ভালােবাসাও আসলে রাজনীতির হাত ধরে চলে? সে কি এই জন্যে যে, যেখানে রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত নেই সেখানে মানবাধিকার প্রকাশও ঘটতে পারে না? এবং সে কি এই জন্যে যে, যেখানে নিজের ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সিদ্ধ হবে না সেখানে নিছক মানবতার সেবা করা ঈশ্বরের চোখে একটা বিরাট অপরাধ? এই কারণেই বিয়াফ্রায় যাদের পক্ষে সঙ্গে সঙ্গে ত্রাণ সম্ভার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া সম্ভব হচ্ছিল, বাংলাদেশে প্রবেশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এমন কি আন্ত র্জাতিক রেডক্রসও করাচী থেকে বিদায় হবার পর সব কর্তব্য ইতি টেনে নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে হাতপা গুটিয়ে বসে আছে।
তবু যেহেতু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানাে পাপ এবং আশার বিরুদ্ধে আশা করা মানুষের একটা পুরােনাে অভ্যাস, আমরা আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলির কাছে, বিশেষত রাষ্ট্রসঙ্ঘের ত্রাণ ও পুণর্বাসন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক রেড সােসাইটির কাছে, আবার আবেদন জানাচ্ছি, এই ঘােরতর দুঃসময়ে, বেশি, সবচেয়ে ব্যাপকভাবে প্রয়ােজন, তখন মানবিকতার দোহাই যদি উপযুক্ত মনে না হয় তাদের প্রবেশ সত্যিই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবু তাঁদের সেবার ক্ষেত্র প্রস্তুত রয়েছে ভারত আর বাংলাদেশের সুদীর্ঘ সীমান্তের সর্বত্র। পাকিস্তানি হানাদারদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিহিংসার প্রথম লক্ষবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে। নিরস্ত্র, অসামরিক মানুষকে নারী, বৃদ্ধ, এমন কি শিশুকেও। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, এক অকারণ, উন্মত্ত উল্লাসে বিধ্বস্ত করছে জনপদগুলি। তাদের এই নির্বিচার গণহত্যার যেটুকু বিবরণ দুনিয়ার মানুষের কাছে উঘটিত হয়েছে আশা করি দুনিয়ার সেব্রতীদের বিবেককে নাড়া দেবার জন্য তাই যথেষ্ট। যারা নিহত, তাদের জন্যে এখন শুদু শােকই প্রকাশ করা যায়। কিন্তু যারা আহত, যারা গৃহহারা, যারা বুভুক্ষু, যারা বিপন্ন, যারা আশ্রয়হীন, তাদের জন্যে ইশ্বরপ্রদত্ত দুটি হাত দিয়ে কিছু করা দরকার। উনুলীত, বিপন্ন এই সব মানুষ ইতিমধ্যেই দলে দলে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে আসতে শুরু করেছে। হানাদারদের আক্রমণের তীব্রতা যত বাড়তে থাকবে, যুদ্ধ উদ্বাস্তুদের এই স্রোত ততই প্রবলতর হতে বাধ্য। এই সব হাজার হাজার উদ্বাস্তুর খাওয়াবার, পরাবার, শুশ্রুষা করবার দায়িত্ব একা ভারতের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। সে সঙ্গতি তার নেই, সে দায়ও সম্ভবত তার একার নয়। এই উদ্বাস্তুরা একটি যুদ্ধের সৃষ্টি যে যুদ্ধের জন্যে ভারত একেবারেই দায়ী নয়। সুতরাং ভারতের সঙ্গে সঙ্গে এদের সেবার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলিকেও। এবং এগিয়ে আসতে হবে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে। ভারতে এসে তাঁদের আর্ত মানবতার সেবা করার পথে কোনাে রাজনৈতিক বাধা নেই। বরং গত রবিবার চন্ডগড়ে এক বক্তৃতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং এই আশাই প্রকাশ করেছেন, ভারত এই কাজে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সাহায্য পুরােপুরিই পাবে। আন্তর্জাতিক সেবাব্রতীরা কি এখন এই আশার মর্যাদা রেখে তাদের বিবেকের সততার প্রমাণ দেবেন?

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৪ এপ্রিল ১৯৭১