বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার
দুর্বাসা বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জয় অনেক বাজারী পণ্ডিতকে খুবই বেকায়দায় ফেলেছে দেখা যাচ্ছে। এই সব দু হাজারি-তিন হাজারি পণ্ডিতদের গ্রাম্ভারী চালের সমস্ত গবেষণা মাত্র সপ্তাহের মধ্যেই যে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে স্থান লাভ করবে কে তা ভাবতে পেরেছিল। ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে এখন তারা পাগলা মেহের আলির মতাে ‘সব ঝুটা হ্যায়’ বলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলছেন।
একজন তাে আবার যুগান্তকারী সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নাকি আর পাঁচটি দেশের মুক্তিসংগ্রামের চেয়ে স্বতন্ত্র । বাঙলাদেশ নাকি প্রচলিত অর্থে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিল না। এবং বাঙলাদেশের মানুষ নাকি স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি মেনে নিয়েছিলেন। কাজেই তারা পরাধীন ছিলেন না, অতএব তারা স্বাধীন হয়েছেন বলা যায় কি করে।
যুগান্তকারী আবিষ্কারই বটে। যেন এক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আর-একদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কার্বন কপি হবারই কথা। কিন্তু পণ্ডিতপ্রবরের বিসমিল্লাতেই গলদ। তিনি ভুলে গেছেন, দেশ-বিভাগটা ছিল সাম্রাজ্যবাদের ভেদনীতিরই ফলশ্রুতি। ১৯৪৭ সালে হয়তাে পূর্ব বাঙলার বাঙালি মুসলমানেরা পাকিস্তানকে প্রসন্ন চিত্তেই মেনে নিয়েছিল কিন্তু পরবর্তী বছরগুলােতে তাদের সে মােহ একটু একটু করে টুটে গেছে। ধর্ম জাতিসত্তার একমাত্র অভিজ্ঞান হতে পারে না। ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের কখনই কোন আত্মিক যােগাযােগ স্থাপিত হয়নি। ইতিহাস, আচার-ব্যবহার বা ঐতিহ্যগত কোন ঐক্য তাদের মধ্যে কখনও ছিল না। তাই রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য তাদের কাছে ঔপনিবেশিক আধিপত্য বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি, বিশেষ করে পাঞ্জাবী ধনিকগােষ্ঠীর নির্মম শােষণ, বাঙলাদেশকে করে রেখেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কাঁচা মালের যােগানদার। উন্নয়ন প্রকল্পের ছিটেফোঁটাই চুইয়ে আসতে তাদের ভাগ্যে। এমনকি পূর্ব বাঙলার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণেরও কোনাে প্রয়াস কোনাে দিন হয়নি। অথচ বাঙালিরাই ছিল পাকিস্তানের জনসমষ্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশশাসনের দায়িত্ব তাদেরই বহন করার কথা। কিন্তু দীর্ঘ দুই যুগ ধরে গণতন্ত্র কখনও পাকিস্তানের মাটিতে শিকড় চালাতে পারেনি। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কিন্তু গয়ের জোরে তাদের শুধু ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা হয় তাই নয়, সমস্ত বাঙলাদেশের মানুষের উপর লেলিয়ে দেওয়া হয় খান সেনাদের। বাঙলাদেশের মানুষ তারই বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রাম পরিণত হয় মুক্তির সংগ্রামে। এ-ইতিহাস সকলেরই জানা। বাজারী পাণ্ডিতদেরও না জানার কথা নয়। আর জ্ঞানপাপী বলেই সম্ভবত শেষ পর্যন্ত তাঁদের শঠ যুক্তির আশ্রয় নিতে হয়, বলতে হয় কমিউনিস্ট মতেও নাকি এ-সংগ্রাম মুক্তিসংগ্রাম নয়। কেননা কমিউনিস্টরা বলে মুক্তিসংগ্রামে “শ্ৰমিক-শ্রেণীর অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব থাকতে হবে।”
পণ্ডিতপ্রবরকে জিজ্ঞাসা করতে পারি কি এই তত্ত্বটা তিনি কোথা থেকে পেলেন? মার্কস এঙ্গেলস লেনিন এমনকি স্তালিনের কোন কেতাবে এমন ধরনের কথা আছে দয়া করে তিনি জানাবেন কি? কমিউনিস্ট শাস্ত্রের সঙ্গে বর্তমান লেখকের অল্পবিস্তর পরিচয় আছে, তাতে এমন উদ্ভট যুক্তি কোথাও চোখে পড়েছে বলে তাে তার মনে পড়ে না। আফ্রিকা ও এশিয়ার যেসব দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে কিংবা সংগ্রাম করে জয়যুক্ত হয়েছে কমিউনিস্টরা তাদের সকলের প্রতি জানিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। কমিউনিস্ট সাহিত্যে এই সমস্ত সংগ্রামকেই মুক্তিযুদ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়। এর মধ্যে কটি দেশে শ্রমিকশ্রেণী তথা কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত? আফ্রিকার অনেক দেশে শ্ৰমিক-শ্ৰেণীর তাে উদ্ভবই হয়নি। তাহলে কি যেসব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিসংগ্রাম নয়? প্যাট্টিস লুমুম্বার নেতৃত্বে কঙ্গোর। স্বাধীনতা সংগ্রামকে কমিউনিস্টরা কি জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম বলে গণ্য করেনি? ৮১-পার্টি দলিলে যে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ঘােষণা করা হয়েছিল তার মধ্যে কি এসব দেশ ছিল না? ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাে শ্রমিকশ্রেণীর তথা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের ভূমিকা ছিলনা—পণ্ডিত প্রবর কি এই আন্দোলনকে মুক্তিসংগ্রাম বলবেন না?
মুক্তি-আন্দোলন বিচারের এমন কোন নিরিখ কোন কমিউনিস্ট সাহিত্যে নেই। এই ধরনের একটা কথা সি পি এম নেতা প্রমােদ দাশগুপ্ত অবশ্য বলেছেন এবং আমাদের পণ্ডিতপ্রবরের মার্কসবাদের দৌড় দেখা যাচ্ছে ঐ পর্যন্তই। কিন্তু বন্ধনীতে মার্কসবাদ জাহির করলেই মার্কসবাদী হয়, তাকে কে বলল। বিশেষ করে প্রমােদ দাশগুপ্ত, তিনি মার্কসবাদ পড়াশুনাে করেছেন এমন অপবাদ তাে তার অতিবড় শত্রুও কখনও দেবে না।
সূত্র: সপ্তাহ, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১