এ চুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম
সম্পাদিত হয়েছে ভারত-সােফিয়েত মৈত্রী চুক্তি। মূলতঃ এটা আত্মরক্ষামূলক চুক্তি। কিন্তু তার সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম। তৃতীয় রাষ্ট্রের আক্রমণে বা আক্রমণের হুমকির সক্রয় মােকাবিলায় উভয় রাষ্ট্র একযােগে উদ্যোগী হতে প্রতিশ্রুত। অপর কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে তারা করবে না এমন বােঝাপড়া যা হতে পারে এই চুক্তির পক্ষে ক্ষতিকর। তা ছাড়া চুক্তিতে আছে অনেক কথা। এগুলাের প্রকৃতি গতানুগতিক। গ্রোমিকোর দিল্লী আগমন এবং ক’ ঘণ্টার মধ্যেই চুক্তি সম্পাদন নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর সংবাদ। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে চমকে উঠবে দুনিয়া। তারপর শুরু হবে ঘরে বাইরে প্রচণ্ড আলােড়ন। সীমান্তের এপার থেকে শােনা যাবে ইয়াহিয়ার আর্তনাদ। ক্রোধে দিশাহারা হয়ে পড়বেন প্রেসিডেন্ট নিকসন। মুখ থেকে বেরুবে না কোন কথা। আত্মস্থ হবার পর আসবে হুমকি। ব্যর্থ হলে তিনি আরম্ভ করবেন ইন্দিরা প্রশস্তি। নাসের সম্পর্কে মার্কিন কর্তাদের পুরনাে ছকবাঁধা নরম-গরম নীতির নতুন প্রয়ােগ হবে ভারতে। পণ্ডিতেরা বসবেন চুলচেরা বিচারে। কেউ বলবেন এ চুক্তি জোট নিরপেক্ষতার পরিপন্থী। আবার অনেকে রায় দেবেন ঠিকই আছে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি। পরিবর্তিত অবস্থায় তার প্রয়ােগের পরিবর্তন ঘটেছে মাত্র। সােফিয়েত রাশিয়াও এই চুক্তির মধ্যেই স্বীকার করে নিয়েছে ভারতের জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের অধিকার।
দ্রুত পাল্টাচ্ছে দুনিয়া। সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে জোট নিরপেক্ষতার ধারণা। এমন কি, পাকিস্তানও চেষ্টা করছে, এ গােষ্ঠীতে ঢােকার। তা নিয়ে ঝামেলা বড় কম হয়নি গত জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সম্মেলনে। আন্তর্জাতিক বিবেক আজ অস্তিত্বহীন। কোন সামরিক জোটের রাষ্ট্র যদি আক্রমন করে কোন জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে তবে তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না অপর কোন রাষ্ট্র। একক ভাবে লড়তে হবে তাকে। আর আক্রমণকারী জোটের রাষ্ট্র পাবে তার জোটের শরিকদের মদৎ। রাষ্ট্রসঙ্ঘ ক্লীব। ওটা আমেরিকার বগলদার। বিশ্বসভার সেক্রেটারী জেনারেল প্রকৃত পক্ষে মার্কিন জমিদারের গােমস্তা। সুতরাং শান্তিকামী রাষ্ট্রগুলাের ভরসা কোথায়? দিত্বীয় মহাযুদ্ধের পর যদি শক্তিশালী সােফিয়েট রাশিয়ার আবির্ভাব না ঘটত তবে গােটা দুনিয়াটাই পরিণত হত আমেরিকার তাবেদারে। থাকত না ছােট ছােট রাষ্ট্রের কোন অস্তিত্ব। ঔপনিবেশিক দেশগুলাে পেত না মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণা। নেহরু পেয়েছিলেন যুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ার দুটি শিবির—একটির নেতা আমেরিকা এবং অপরটির সােফিয়েট রাশিয়া। এ দুয়ের মাঝখানে দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি সদ্য স্বাধীন ভারতকে। আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে তখনও নামে নি চীন। পৃথিবী এখন ত্রিধাবিভক্ত। পিকিং, মস্কো এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে দীর্ঘদিন চলেছে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযােগিতা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্নয়নশীল। এই ধনীর দল এক একটা সামরিক জোটের শরিক। এদের প্রভাব এড়াতে পারছে না। জোট নিরপেক্ষরা ফলে হারিয়ে ফেলেছে তারা পুরানাে জোলুষ। দরকার পড়েছে নতুন মূল্যায়নের। ভারতসােফিয়েট মৈত্রী চুক্তি এই মূল্যায়নেরই প্রত্যক্ষ ফল।
মহা সঙ্কটে পড়েছিলেন নয়াদিল্লী। বাংলাদেশে চলছে ইয়াহিয়ার গণহত্যা। লাখ লাখ শরণার্থী জমায়েত হচ্ছেন ভারতে। কোটি কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে কোষাগার থেকে। গােটা দুনিয়া চষে বেরিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা। কোথাও পান নি তেমন কোন সাড়া। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সবাই। মার্কিন কর্তারা খেলছেন শয়তানি খেলা। ইয়াহিয়ার নারকীয় তাণ্ডবে তারা দিচ্ছেন মদৎ। এদের সঙ্গে জুটেছে চীন। নির্লজ্জের মত সে জোড়াচ্ছে পাকিস্তানে অস্ত্র। এদিকে বাংলাদেশে গড়ে উঠছে স্বাধীন পাল্টা সরকার। মুক্তিবাহিনী জোর আঘাত হানছেন পাক-চমূর উপর। তাদের আঘাতের তীব্রতা যত বাড়ছে তত ঘটছে চীনা, মার্কিন এবং পাক ষড়যন্ত্রের প্রসার। ইয়াহিয়া হয়ে উঠছেন মারমুখী। হামেশাই তিনি দিচ্ছেন যুদ্ধের হুমকি। পিছন থেকে উস্কাচ্ছে তাঁকে চীন এবং আমেরিকা। সম্প্রতি এ দুটি রাষ্ট্রের সম্ভাব্য মিতালী অবস্থাটা করে তুলেছে সাংঘাতিক রকমের ঘােরাল। ওদের ধারণা, নিঃসঙ্গ ভারতকে এলােপাথারী মারলে নেই কোন প্রত্যাঘাতের ভয়। তিনটির বিরুদ্ধে একা কি করবেন নয়াদিল্লী? চুলােয় যাবে স্বাধীন বাংলাদেশ। ভারত বিসর্জন দেবে বিবেক। শরণার্থীর ভারে কিছুদিনের মধ্যে নেতিয়ে পড়বে সে। তারপর নয়াদিল্লী ছুটবেন আমেরিকা কাছে। বগল বাজাবেন নরঘাতী ইয়াহিয়া।
ব্যর্থ হয়েছে তাদের ষড়যন্ত্র। ভারত -সােফিয়েট মৈত্রী চুক্তি যুদ্ধবাজদের চরম প্রতিষেধক। ওরা সাহস পাবে নয়াদিল্লীকে বেশী ঘাটাতে। সাহসীর পদযাত্রা এখানেই শেষ নয়, সবে আরম্ভ। আসলে সমস্যা অমীমাংসিত। নিরাপত্তার জন্য যেমন দরকার ভারত-সােফিয়েট মৈত্রী চুক্তি তেমন দরকার স্বাধীন বাংলাদেশ। এ অঞ্চলে পাক শাসনের অবসান ঘটলে বাড়বে নিরাপত্তা। কমবে চীনা আক্রমণ ভীতি। এতে সােফিয়েট রাশিয়াও হবে লাভবান। সম্ভাব্য চীন-মার্কিন আঁতাত তার পক্ষে বিপদজন। পাকিস্তানকে বিশ্বাস নেই। ভারতকে শায়েস্তা করার জন্য সে সব বিকিয়ে দিতে পারে আমেরিকার কাছে। একবার তাও করেছিলেন পাক-নায়কেরা। পেশােয়ারের বিমানঘাঁটি থেকেই সােফিয়েট রাশিয়ার উপর একদিন উড়েছিল মার্কিন গােয়েন্দা বিমান ইউ-২। এবার তিন শত্রু সঙ্ঘবদ্ধ। বিপদের সম্ভবনা আরও বেশী। এশিয়ার শান্তি র জন্যই দরকার তাদের আগ্রাসী নীতির প্রতিরােধ। তার প্রথম পর্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করার জন্যই প্রয়ােজন তার অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দান। ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামাে ভেঙ্গে ফেলার জন্য শত্রুপক্ষ করবে সব রকমের চক্রান্ত। শরণার্থীদের বেশীদিন রাখা যাবে না। এদেশে। ওদের ফেরত পাঠাবার ত্বরিত ব্যবস্থা অপরিহার্য। সক্রিয় পন্থা অবলম্বনের পটভূমি তৈরী। এর সুযােগ না নিলে ভারত-সােফিয়েট মৈত্রী চুক্তি হয়ে দাঁড়াবে অর্থহীন।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ আগস্ট ১৯৭১