কশাই-এর হাতে কলম
ছুরি ছেড়ে কশাই ধরেছেন কলম। জোর খোঁচা মেরেছেন আওয়ামী লীগের উপর। পাক-জাতীয় পরিষদে মােট সদস্য সংখ্যা তিনশ তের। তার মধ্যে একশ সাতষট্টিটি আসন দখল করেছিল আওয়ামী লীগ। ইয়াহিয়ার কলমের এক খোচায় জবাই হয়েছেন উনআশী-জন। ওরা বসতে পারবেন না জাতীয় পরিষদে। রাজ্যের আইনসভাগুলাের উপরও চলবে হানা। সেখানে পড়বে কলমের খোঁচা। কুপােকাত হবেন অনেকে। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার কাজ খতম। বাকী আছে পূর্ববাংলার রাজ্যেসভা। সেখানেও মুজিবুরের দলের পাখনা থেকে টেনে খসান হবে অনেক পালক। ইয়াহিয়ার দরকার সংখ্যালঘু বাঙালী। গণহত্যা এবং ব্যাপক বিতাড়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে তিনি করছেন জনশূন্য। আর কলমের খোঁচায় জাতীয় পরিষদে এবং পূর্ববাংলার আইনসভায় আওয়ামী লীগের উপর নিচ্ছেন একহাত। মাথা খারাপ হয়েছে ইসলামাবাদের ডিকটেটরের। গত ডিসেম্বর মাসে হয়ে গেছে নির্বাচন। তারপর বসেনি জাতীয় কিম্বা রাজ্য পর্যায়ে কোন অধিবেশন। পঁচিশে মার্চ রাস্তায় বেরিয়েছে ঘাতকবাহিনী। ইয়াহিয়ার হুকুমে আওয়ামী লীগ বে-আইনী সংস্থা। স্বয়ং মুজিবুর রহমান বন্দী। তার সমর্থকরা গড়ে তুলেছেন স্বাধীন পাল্টা সরকার। মুক্তিবাহিনী নাজেহাল করে তুলেছে পাক-চমূ। জাতীয় পরিষদ এবং রাজ্যের আইনসভার অপমৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। অখণ্ড পাকিস্তানের সঙ্গেই এগুলাে এখন কবরস্থ। দুশমন ইয়াহিয়া কি করলেন এবং কি না করলেন তাতে কিছু আসে যায় না স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের।
তাসের ঘর তৈরী করছেন ইসলামাবাদের শাসকগােষ্ঠী। যাদের নাম কাটা পড়েছে তাদের শূন্য আসনগুলাের জন্য নাকি হবে উপনির্বাচন। ইয়াহিয়ার আটাশে জুনের বেতার ভাষণে ছিল এসব কথা। বাংলাদেশে চলছে স্বাধীনতার লড়াই। পাক-দখলদার বাহিনীর আওতায় উপনির্বাচন এক তাজ্জব ব্যাপার। আমেরিকা এবং তার দোস্তরা ছাড়া এই সার্কাসের খেলা অন্য কেউ উপভােগ করবে কিনা সন্দেহ। আটঘাট বাঁধার ত্রুটি ইেন। মার্কিন পীড়াপীড়িতে বাংলাদেশে যাবেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল। আত্রাণের নামে তারা করবেন পাক-বাহিনীর যােগাযােগ ব্যবস্থার টহলদারী। ঠেকাবার চেষ্টা হবে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি। মুস্কিল বাধাচ্ছে ভারত। কিছুতেই সে নিতে চাচ্ছে না তার এলাকায় কোন আন্তর্জাতিক ভালমানুষের দল। বাংলাদেশ সমস্যাটা আসলে পাক-ভারত বিরােধ—একথা কিছুতেই মুখ দিয়ে বার করা যাচ্ছে না নয়াদিল্লীর। মিথ্যাকে সত্য বলে কবুলের জন্য চলছে ক্রমাগত চাপ। মার্কিন অস্ত্র জমা হচ্ছে পাক-অস্ত্রগারে। শান দিচ্ছেন তাতে জঙ্গী নেতারা। হামেশাই তরপাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। তিনি নাকি করবেন লড়াই। লড়াই করতে গিয়ে তার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভবিষ্যতের সম্বল পশ্চিমের কয়েক ফালি জমি। ১৯৬৫ সালে বেশী ফুটানী করতে গিয়ে তা প্রায় হারাতে বসেছিলেন আয়ুব খান। এবার ইয়াহিয়ার পালা তিনিও ধরতে চাচ্ছেন আয়ুবের পথ। পিছন থেকে চীন-আমেরিকা প্যালা দিলেও শেষরক্ষা কি করতে পারবেন তিনি?
সােফিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকো অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদ। শয়তানি চক্র বহু দেখেছেন তিনি। এসেছেন ভারতে দয়া করে যান তিনি শরণার্থী শিবিরগুলােতে। সেখানে যাদের সঙ্গে তাঁর হবে মুলাকাৎ তাদের মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্কেরা বাংলাদেশের ভােটদাতা। হয়ত মিলবে না কিশাের এবং যুবকদের দেখা। ওদের আছেন বাংলাদেশের ভিতরে। লড়াই করছেন পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্ত অঞ্চলে সামরিক শিক্ষণ শিবিরগুলােতে পড়ে গেছে লাইন। বাঙালী ভােটদাতারা লিখাতে চান মুক্তিবাহিনীতে নাম। ভােটপত্রের বদলে তাদের বাঞ্ছিত হাতিয়ার রাইফেল। স্বৈরচারীর শাসনে ব্যালট বাক্স অচল। পাল্টা আঘাত সেখানে সত্য। এই আঘাতের সার্থকতার পরই আসবে ভােট গ্রহণের প্রশ্ন। শরনার্থী শিবিরগুলাে দেখতে যখন যাবেন আন্দ্রে ঘোমিকো তখন একবার তাকাবেন সীমান্তের ওপারে। দেখবেন শঙ্কিত হৃদয়ে ঘুরছে ঘাতকদল। পাইকারীহারে চলছে গুলী। মরছেন নিরস্ত্র জনতা। তাদের সহযােগী সশস্ত্র ধর্মান্ধের দল। সবাই মিলে করছে নরহত্যা, লুটতরাজ এবং নারী ধর্ষণ। ইয়াহিয়ার কলিপ্ত উপনির্বাচনে এরাই সভ্য ভােটদাতা এবং ভােটকেন্দ্রগুলাের পরিচালক। আর বাকী সবাই খরচের খাতায়। শরণার্থীরা তাে হিসাব থেকে একেবারেই বাদ। পাক-ভাষ্যে এর নামই গণতন্ত্র। তাতে যদি কেউ আপত্তি জানান সঙ্গে সঙ্গে রেরিয়ে পড়বে ইয়াহিয়ার সদাচারের মার্কিন সার্টিফিকেট। তাতেও যদি না কুলােয় তবে ডেকে আনা হবে চীনকে এবং ঐশ্লামিক জোটের মােল্লাদের। অভয় দিয়েছেন ঐশ্লামিক দপ্তরের জেনারেল সেক্রেটারী টুঙ্কু আবদুল রহমান। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে বলেছেন তিনি কথা-বার্তা। ভারত ছেড়েই তিনি দুনিয়াকে দিয়েছেন আশ্বাস। রাষ্ট্রসঙ্ঘে তদারকীতে ইয়াহিয়ার আশ্রয়ে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানই যুক্তিযুক্ত। নয়াদিল্লী শুনছেন না এই সদুপদেশ। ভারতীয় নেতারা যাবেন কোথায়? এত শরণার্থী তার পুষবেন কি করে? আর কটি মাস কাটিয়ে দিতে পারলেই ল্যাঠা যাবে চুকে। অর্থাভাবে ভারতীয় নেতারা দেখবেন চোখে সরষের ফুল। তারপর বাপ বাপ বলে শরণার্থীদের ফেরত পাঠাবেন পূর্বপাকিস্তানে। টুঙ্কু সাহেব হয়ত নিজের অজান্তে বলে ফেলেছেন পাক-মার্কিন নেতাদের মনের কথা। ফাস করেছেন তাদের গােপন ষড়ন্ত্রের রহস্য।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ আগস্ট ১৯৭১