You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নতুন চক্রান্ত

মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর অবস্থা যতই শােচনীয় হয়ে উঠছে পাকিস্তানের বিদেশি মুরুব্বিরা ততই ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েছে। প্রথমদিকে তাদের আশা ছিল, অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্রের মদত দিলে পাকিস্তানি সামরিক কর্তারা ভারতের উপর ঝাপিয়ে পড়ে একটা যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারবে। প্রভুদের নির্দেশমতাে সে চেষ্টার কসুর করতেও পাকিস্তানি বশংবদরা ছাড়েনি। কিন্তু সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীয় বাহিনীর হাতে উপযুক্ত জবাব পাবার পর তারা ক্রমশ বুঝতে শুরু করেছে লড়াই বাধাবার সাধ থাকা এক কথা, সাধ্য থাকা সম্পূর্ণ অন্য কথা।
অবস্থা দেখে পাকিস্তানের মুরুব্বিরা আবার কোমর বেঁধেছে বাঙলাদেশের প্রশ্নকে নিয়ে জল ঘােলা করার উদ্দেশ্য। ইঙ্গ মার্কিন ইঙ্গিতে বেলজিয়াম নিরাপত্তা পরিষদে বাঙলাদেশ প্রসঙ্গ তােলবার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। ভিয়েতনামে বছরের পর বছর নিরস্ত্র, নিরীহ নরনারী-শিশুকে যিনি নির্বিবাদে হত্যা করে চলেছেন সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিকসন হঠাৎ পাক-ভারত উপমহাদেশে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় নতুন করে শিউরে উঠেছেন। ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কীটিং মারফত তিনি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আবার এক চিঠি পাঠিয়েছেন। এই চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ পেলেও এটা খুবই পরিষ্কার যে । বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করে ইয়াহিয়ার খুনী রাজত্বকে বাঁচাবার যে কোনাে প্রস্তাবই তিনি সুকৌশলে হাজির করার চেষ্টা করেছেন।
যেদিন নিকসনের বিশেষ বার্তা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার কাছে পৌচেছে ঠিক সেই দিনই পিকিং এ এক সংবর্ধনাসভায় চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী লি শিয়েন নিয়েন বাঙলাদেশের প্রশ্নে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আর-এক দফা বিষােদ্গার করেছেন এবং ইয়াহিয়া সরকারের উদ্দেশে নতুন করে সমর্থন জানিয়েছেন। আলবেনিয়ার মুক্তির ২৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংবর্ধনা-সভায় এই ভদ্রলােক বলেছেন, সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক প্ররােচনা সৃষ্টি করছে। পাকিস্তানের ভূমিগত অখণ্ডত রক্ষার সংগ্রামে চীন কিন্তু পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।
সীমান্তে প্রচণ্ড পাকিস্তানি যুদ্ধপ্রস্তুতি এবং ভারত সীমান্ত প্রতিদিন পাকিস্তানি গােলা বর্ষণ সত্ত্বেও ভারত সরকার যখন অদ্ভুত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন যখন পাক-ভারত যুদ্ধের বিপদ হাস করার জন্য সমস্ত প্রকারে চেষ্টা করছে তখন চীনের এই বিপজ্জনক মনােভাব শুধু সাম্রাজ্যবাদ আর স্তাবকদেরই খুশি করবে। বাঙলাদেশের মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষের কাছে দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের জন্য চীনের তথাকথিত দরদের স্বরূপটাও এতে আর-একবার ভালাে করেই ধরা পড়বে।
অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের এই ধরনের কার্যকলাপে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। দীর্ঘদিন ধরে এই দুটি দেশ পাকিস্তানের অত্যাচারী সামরিক শাসকদের গণতন্ত্র হত্যার কাজে সব রকমের সাহায্য দিয়ে এসেছে। মার্কিন আর চীনা অস্ত্র দিয়ে ইয়াহিয়ার খুনী বাহিনী বাঙলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের রক্তে সে দেশের মাটি ভিজিয়ে রাঙা করে দিয়েছে। কিন্তু তাতে মুক্তিকামী মানুষের দুর্জয় ভিজিয়ে রাঙা করে দিয়েছে। কিন্তু তাতে মুক্তিকামী মানুষের দুর্জয় সাহস আর অদম্য মুক্তিপিপাসাকে দমন করা যায়নি। বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নতুন চক্রান্তও যে বানচাল হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ বাঙলাদেশের একের পর এক অঞ্চলকে পাকিস্তানি শত্রুসৈন্যর দখলমুক্ত করে চলেছে। সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয় যেদিন স্বাধীন বাঙলাদেশের পতাকা সমগ্র বাঙলাদেশে বিজয়গর্বে শােভা পাবে এবং বাঙলাদেশের মাটিতে ইয়াহিয়া খানের পশ্চিম পাকিস্তানি দস্যুবাহিনীর বিন্দুমাত্র চিহ্নও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর আজ যারা বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চক্রান্তের জাল বুনছে তাদের স্থান হবে। শুধু ইতিহাসের ডাস্টবিনে।

সূত্র: সপ্তাহ, ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!