আওয়ামী লীগের ইতিকথা
আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৯ সালে নারায়ণগঞ্জে। তখন তার নাম ছিল “আওয়ামী মুসলিম লীগ।” মুসলিম লীগ তখন ক্ষমতাসীন ছিল, অধিষ্ঠিত ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সেই সময়ে এই আওয়ামী মুসলিম লীগই ছিল কার্যত একমাত্র বিরােধী দল।
এই পার্টির প্রতিষ্ঠাতারা মুসলিম লীগের নেতৃত্ব সম্পর্কে অসন্তুষ্ট ছিলেন, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্না সম্পর্কেও। এঁদের মধ্যে ছিলেন মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি, আতউর রহমান খা, সুহরাওয়র্দি প্রমুখের মতাে জিন্নার অনুগামিবৃন্দ ও প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।
অনতিকাল পরেই আওয়ামী মুসলিম লীগ ধর্ম-নিরপেক্ষতার দিকে পা বাড়ায়। নতুন নামকরণ হয় আওয়ামী লীগ। সাধারণ লােকের একটা ধারণা আছে যে এই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অবিভক্ত বাঙলার সূহরাওয়ার্দি। কিন্তু আসলে প্রতিষ্ঠাতা হলেন মৌলানা ভাসানি। সহ-সভাপতিদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান খা, আবদুস সালাম ও আবদুল মনসুর আহম্মদ। আতাউর রহমান খা পরে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হন।
পার্টি সামসুল হককে তার সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করে এবং তিনজন সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত করে—শেখ মুজিবর রহমান, রফিকুল আহসান ও খােন্দকার মুস্তাক আহমদকে। আহমেদ এখন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা। শেখ মুজিবর রহমান তখন জিন্নার বিরুদ্ধে ছাত্রদের এক বিক্ষোভ-শােভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করার অপরাধে জেলে বন্দি ছিলেন ।
পাকিস্তানের রাজনীতি যখন মুসলিম লীগের উঁচু মহলের কোন্দলে দূষিত, সেই সন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ প্রায় সমস্ত জনপ্রিয় কৃষক-নেতা, শ্ৰমিক-নেতা ও ছাত্রনেতাদের নিজের দলে টে নেয়। পূর্ব পাকিস্তানে এঁরাই ছিলেন মুসলিম লীগের মেরুদণ্ড। পার্টির পােড়খাওয়া নেতারা তখনকার মানুষের মেজাজটা সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। পার্টির নীতি তারা তদনুযায়ী ঠিক করেন। যে দুটি বিষয় পূর্ববঙ্গকে সবচেয়ে বেশি আলােড়িত করছিল, সেই ভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন দুটিকেই প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার করা হয়। পার্টির স্লোগান—“পূর্ব পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য জনমনে বিদ্যুৎ সঞ্চার করে। এটাই ছিল ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব সাফল্যের চাবিকাঠি। যুক্তফ্রনে শরিক আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসে প্রধান বিজয়ী হিসেবে, আর মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
যুক্তফ্রন্টের এই বিরাট জয়লাভের কারণ ছিল বিভিন্ন ছাত্র-আন্দোলনের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাদের আমলাদের নির্মমতা। সত্যি বলতে কি স্বয়ং জিন্না সাহেবই এই অসন্তোষের বীজ বপন করেছিলেন। মার্চ ১৯৪৮-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রসভায় বক্তৃতাপ্রসঙ্গে জিন্না ঘােষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একদল ছাত্র সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার করে ওঠেন—“না, না।” জাতির পিতা মনে আঘাত পান এবং রুষ্ট হয়ে সভা থেকে চলে যায়। তারপর শুরু হয় ছাত্র ও যুব বিদ্রোহীদের ভয় দেখিয়ে দমন করার জন্য সন্ত্রাস অভিযান। ভাষা আন্দোলন এইভাবে গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। খুব কম বাঙালিই এই আন্দোলনের বাইরে থাকতে পেরেছিলেন।
এর পর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখের ঐতিহাসিক ছাত্র ধর্মঘট। পুলিশের অমানুষিক বর্বরতা সেদিন ১৯টি তরুণের প্রাণ হরণ করে। তিন দিন হত্যালীলা চালাবার পর কর্তৃপক্ষের চৈতন্যোদয় হয়; কিন্তু ছাত্র যুবরা তাদের আত্মবলিদান দিয়ে মানুষকে এই কথাটা বােঝাতে পারেন যে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত মুক্তি। সংস্কৃতিগত দমন, তার সঙ্গে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক শােষণের ফলে এই ধারণা জন্মায় এবং সে ধারণা বদ্ধমূল হয় যে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ মাত্র। এর কৃতিত্ব আওয়ামী লীগেরই প্রাপ্য। তারাই এসম্পর্কে নিরবচ্ছিন্ন ও কার্যকর অভিযান চালিয়েছেন। আর আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন এই স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতীক।
জোরদার একটা ছাত্র ও যুবশক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগ ছিল সমস্ত গণআন্দোলনের পুরােভাগে। সাধারণ মানুষের বিদ্রোহের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে এই দলই হয়ে দাঁড়ায় পূর্বপাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির একমাত্র মুখপাত্র। যাই হােক, এই দল ক্ষমতার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তার ফলে পার্টিতে ফাটল ঘটে ১৯৫৪ সালে। পার্টির নির্বাচনী ইস্তাহার লঙ্ন করে সুহরাওয়র্দি সাহেব ১৯৫৪ সালের পাকমার্কিন সামরিক চুক্তিকে সমর্থন করেন। তারই ফলে দেখা দেয় গুরুতর মতবিরােধ । সুহরাওয়র্দি তখন পাকিস্ত শনের প্রধানমন্ত্রী। এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মৌলানা ভাসানি তার কঠোর সমালােচনা করেন। ১৯৫৪ সালে কাগমারিতে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে পার্টির ভাঙনের মধ্যে এই বিরােধ শেষ হয়। মৌলানা তার বেশ কিছু অনুগামী নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। পরে ১৯৬৬ সালে এ-পার্টিও অবশ্য ভাগ হয়।
পার্টি ভাগাভাগির পর সুহরাওয়র্দি সাহেব হন আওয়ামী লীগের নেতা আর শেখ মুজিবর রহমান হন। তার অকৃত্রিম শিষ্য।
প্রাক্তন পাক-প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খাঁ কর্তৃক একদা বর্ণিত ‘দেশদ্রোহী’ এবং ইয়াহিয়া খা কর্তৃক বর্ণিত ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে ছিলেন মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার নেতা। তিনি ছিলেন ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক যুব লীগের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা। শেখ সাহেব প্রায় ১০ বছর জেলে কাটিয়েছেন। প্রথম কারাবাস ১৯৪৮ সালে। বন্দি দশার প্রথম দিকেই শেখ সাহেব আস্তে আস্তে পরিণত হন একজন বিদ্রোহীতে। আজও তিনি সেই বিদ্রোহীই রয়েছেন।
আদর্শের জন্য দীর্ঘকালের কারাবাস ও কষ্টভােগের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান যে শুধু তার নিজের পার্টির লােকদেরই বিশেষ শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন তা নয়, মৌলানা ভাসানি ও আতাউর রহমান খাঁ-র মতাে। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের শ্রদ্ধাও তিনি অর্জন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট শেখ সাহেব বাগ্মীও নন, তাত্ত্বিকও নন। তবু তিনিই হলেন পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তথাকথিত যে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে আইয়ুব খাঁ জড়িয়েছিলেন তার বিচার হয়েছিল, সেই মামলার ফলেই তার জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ শিখরে ওঠে।
পার্টির ঐতিহাসিক ছ-দফা কর্মসূচিই এখন বাঙলা জনগণের আশা-আকাক্ষার সনদ। এই কর্মসূচিটি পূর্ববঙ্গের ছােট একদল তরুণ বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের চিন্তার ফল। এঁরা গত দশ বছর যাবৎ শেখ সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। প্রতিভাসম্পন্ন এই গােষ্ঠীটির নেতা হলেন অক্সফোর্ড থেকে পাস করা ব্যারিস্টার এবং আন্তর্জাতিক আইনে ডক্টরেট প্রাপ্ত মি. কামাল হােসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রহমান সােবহান। শেখ সাহেব তার বিরাট জনপ্রিয়তা নিয়ে যেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্লাবন এনেছেন, অন্যদিকে তাঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা। তাদের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ফোরামের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের মূল নীতিকে চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগের সরকারি মুখপাত্র ইত্তেফাক সংগঠন সম্পর্কে এবং অন্যান্য পার্টি সম্পর্কে পার্টির নীতি ও মনােভাবকে প্রকাশ করে।
সাংগঠনিক ব্যাপারে প্রধান ব্যক্তিরা হলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক তাজুদ্দিন আহমদ এবং কামরুজ্জামান সইদ, নুরুল ইসলাম, খােন্দকার মুস্তকে আহমদ ও মনসুর খার সঙ্গে আলােচনার সময়ে এরা সকলেই শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে ছিলেন।
(আই-পি-এ)
সূত্র: সপ্তাহ, ১৬ এপ্রিল ১৯৭১