You dont have javascript enabled! Please enable it!

সবাই নামুন

বাঙলাদেশ থেকে শরণার্থীদের অবিরাম স্রোত যেভাবে পশ্চিমবঙ্গকে প্লাবিত করছে, অবিলম্বে তার সুষ্ঠু মােকাবিলা করা না হলে পশ্চিমবাঙলা বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাজেশ্বর রাও-এর এই হুঁশিয়ারি কেবল কথার কথা নয়। সভা, সমিতিতে, বক্তৃতায়, বিবৃতিতে, আইনসভা বা সংসদের আলােচনায় এমনকি সরকারের রাজ্য ও কেন্দ্রের মুখ্য ও প্রধানমন্ত্রী কেউই ঘটনার গুরুত্বকে কমিয়ে দেখানাের চেষ্টা করেননি। বরং তারা বলার সময়ে বেশীই বলেছেন। অথচ এইসব সাধু ঘােষণা সত্ত্বেও পশ্চিমবাঙলায় ৫০ লক্ষ শরণার্থীদের মধ্যে ৫ লক্ষের জন্য আশ্রয় এবং শতকরা ২৫ ভাগকে রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেছে। এদের আশ্রয়দান, খাদ্যের জোগান এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা যদি এই হারে চলতে থাকে, তবে ক্ষুধা এবং মহামারীর দাপটে শরণার্থীদের শিবিরে অনিবার্যভাবেই মড়ক দেখা দেবে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়, এই শরণার্থীদের সংখ্যার চাপে, মহামারীর ছোঁয়ায় আর সবার ওপরে সুযােগসন্ধানী রাজনীতিকদের উস্কানীতে সায়িক হাঙ্গামায় পশ্চিমবাঙলার সামাজিক এবং অর্থনীতিক জীবন কেবল বিপর্যস্ত নয়, ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য।
পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন রাজনীতিক দল যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সমগ্র দেশকে এই সমস্যার মােকাবিলার কাজে নামিয়ে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাঝখানে কিছুটা চড়া সুরে কথা বলার পর প্রধানমন্ত্রী কয়েক ঘণ্টার জন্য ছুটেও এসেছিলেন। কিন্তু সব মিলিয়ে ভারত সরকারের মনােভাব এখনও নির্মমভাবে অমার্জনীয়।
শ্রী রাও আবার ঐ দাবির পুনরুল্লেখ করে বলেছেন, ভারত সরকার কেবল প্রয়ােজনীয় সাহায্যই দেবে, তাই নয়, প্রতিটি রাজা সরকারকেও এ ব্যাপারে সব রকম সাহায্য দেবার জন্য বাধ্য করতে হবে। শরণার্থীদের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রশ্নে প্রথম থেকেই কেন্দ্রের প্রতিরােধমূলক মনােভাব ছিল। কোন কোন রাজ্য সরকার ঐ মনােভাবের আড়ালে সামান্য কিছু সাহায্য পাঠিয়ে এই বিরাটি দুর্যোগের মাঝে বাঙলাদেশ শরণার্থী এবং পশ্চিমবাংলার প্রতি দায়সারা কর্তব্য পালন করেছিলেন। পশ্চিমবাংলার বিপর্যয় ভারতকে অক্ষত রাখবে না। এই উপলব্ধি উট পাখীর মত আজও তাদের হয়নি। অবিলম্বে প্রত্যেকটি রাজ্য সরকারের দায়িত্বে শরণার্থীদের সরিয়ে নিয়ে পশ্চিমবাঙলার চাপ হালকা করার দাবির পুনরুক্তি করে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রস্তাবও করেছেন। তার অন্যতম হলাে, প্রতিটি রাজ্য সরকারকে পশ্চিমবাঙলায় একটি করে সুসজ্জিত বড় হাসপাতাল করে দিতে হবে।
এ সবকিছুই করা সম্ভব, যদি সমস্যাটিকে ভারতের রাজনীতিও অর্থনীতির বিপর্যসৃষ্টিকারী সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। যদি একে মােকাবেলার জন্য কালবিলম্ব না করে যুদ্ধকালীন তাৎপরতা শুরু করা যায়, যদি সমস্যাটিকে বাঙলাদেশের মুক্তির এবং ভারতের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়।
কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক এই দিকটির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন এবং এই পথে সমগ্র দেশকে সংগঠিত করার জন্য কমিউনিস্টদের উদ্যোগী হওয়ার আবেদন করেছেন।
পশ্চিমবাঙলার শত শত মাইলব্যাপী সীমান্ত ধরে লক্ষ লক্ষ অসহায় নরনারী অনাহার ও মহামারীর শিকার হয়ে পথে প্রান্তরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন আর পশ্চিমবাঙলা সমেত ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলির গণতান্ত্রিক অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে, এ কল্পনা আজ আকাশকুসুম। কোন কমিউনিস্টই এই সময়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকতে পারেন না। পঞ্চাশের সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনসৃষ্ট মন্বন্তরকে কমিউনিস্টরা সামাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রামের মেজাজ নিয়েই মােকাবিলায় ঘর, বাড়ি এবং কর্মক্ষেত্র নিয়ে বুভূক্ষুদের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। সেদিন সম্বল ছিল কেবল বে-সরকারি সাহায্য এবং সমর্থন। আজ সম্পূর্ণ এক অভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিপন্ন মানবতার পাশে গিয়ে কমিউনিস্টদের দাঁড়াতে হবে। শুধু সেবা নয়, শরণার্থীদের মনােবল অক্ষুন্ন রাখার জন্য সেই সঙ্গে পশ্চিমবাঙলাকে সাম্প্রদায়িকতার বলি থেকে রক্ষার জন্য কমিউনিস্টদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক তাঁর বক্তব্যের শেষেই দাবি জানিয়েছেন।

সূত্র: কালান্তর ১০.৬.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!