You dont have javascript enabled! Please enable it!

সমাজতান্ত্রিক জার্মানী মনে করে
শুধু রিলিফ নয় রাজনীতিক সমাধানে পাক জঙ্গী-চক্রকে বাধ্য করাই একমাত্র পথ
শরণার্থীদের সাহায্য পাঠানাের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্তি

(বিশেষ প্রতিনিধি)

বালিন, “শুধু সেবাকার্যে সাহায্য করেই বাঙলাদেশের শরণার্থী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়— তা সে সাহায্যের পরিমাণ যত বিরাট হােক না কেন, জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যােয়াকিম রাদাদ শরণার্থীদের জন্য রিলিফের জিনিসপত্র বােঝাই বিমানটি রওনা হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে কালান্তর- এর বিশেষ প্রতিনিধিকে শুক্রবার এই কথা বলেন।
জি, ডি, আর এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হল, বাঙলাদেশে এমন অনুকূল রাজনীতিক পরিবেশের সৃষ্টি করা যাতে শরণার্থীরা নির্ভয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকে নিরাপদ মনে করতে পারেন আর সেই পরিবে ণ সৃষ্টি করার জন্য পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করতে হবে।”
শুক্রবার মাত্র দু ঘণ্টার নােটিশে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ রাদদে এই প্রতিনিধিকে তার দপ্তরে ডেকে পাঠান ও বাঙলাদেশ সম্পর্কে সরকারের নীরবতা ভঙ্গ করে বাংলাদেশ থেকে যে লক্ষ লক্ষ নরনারী ও শিশু জন্মভূমি পরিত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন তার রাজনীতিক কারণ ব্যাখ্যা করেন। উল্লেখযােগ্য যে, তিনি যখন এই বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করছিলেন তার ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পরে অর্থাৎ শনিবার ১২ জুন শরণার্থীদের সেবার জন্য ব্যবহার্য ওষুধপত্র, তাঁবু ও অন্যান্য সরঞ্জামে বােঝাই একটি বিমান ভারত অভিমুখে যাত্রার জন্য বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ডাঃ যােয়াকিম জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের এশীয় বিষয়ক বিভাগের অন্যতম বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, “বাঙলাদেশ থেকে যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের ভারতের পথে ছুটে চলেছেন তাঁরা ভারতের সমৃদ্ধির প্রতি বিশেষ আকর্ষণের জন্য যাচ্ছে না। পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গ তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছেন।
ডাঃ রাদদে বলেন, নির্বাচনের ফলাফল থেকে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পাকিস্তানের শাসকবর্গ জনগণের সেই রায়ের প্রতি যদি সম্মান দেখাতেন তাহলে পরিস্থিতি কখনই এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করত না। কিন্তু তার পরিবর্তে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার নির্মম দমননীতির খড়গ নিয়ে নেমে এলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলেন এমন কি মুজিবর রহমানকেও গ্রেপ্তার করলেন।”
তিনি আরাে বলেন, “ভারত অভিমুখে বিপুল স্রোতের মত শরণার্থীদের আগমনের এই হলাে কারণ। কয়েকটি পাশ্চাত্যদেশ এই সমস্যাকে যেভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করছে সেই ধরণের আর্তত্রাণের সমস্যা এটি নয়। মূলত এ সমস্যা রাজনীতিক এবং সেই পথেই এর সমাধান খুঁজতে হবে।”
ডাঃ রাদদে বলেন, ইতােমধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের আর একটি তপ্ত কটাই হয়ে পড়েছে এবং যে কোনদিন এই অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। তিনি বলেন, “তার সরকার এই বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে ঐক্যমত্য যে, বাঙলাদেশের সমস্যাটির সমাধান হবে রাজনীতিক পথে এবং তা শান্তিপূর্ণ পথেই খুঁজতে হবে। এর সমাধান সৈন্য দ্বারা যেমন হবে না তেমনি সামরিক একনায়কত্ব দ্বারা হবে না।
জিডি আর এর বিমানটি বারবার পৌঁছবে
মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র থেকে যে বিমানটি শনিবার রওনা হয়ে রবিবার কলকাতায় পৌঁছবে তাতে অন্যান্য জিনিসপত্রের মধ্যে আছে কলেরার টিকে, অন্যান্য ওষুধপত্র, বড় তাবু এবং কম্বল।
সরকার বাদেও ট্রেড ইউনিয়ন, রেড ক্রশ, চার্চ এবং আফ্রোশীয় সংহতি কমিটি বাঙলাদেশের জন্য রিলিফ সংগ্রহ করছে। দ্বিতীয় বিমানটি আগামী সপ্তাহের মধ্যেই রওনা হবে।
পশ্চিম জার্মানী কাকে সাহায্য করছে
পশ্চিম জার্মানী সংবাদপত্রগুলি বর্তমানে বাঙলাদেশের জন্য জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের চেয়েও অনেক বেশী সাহায্য অর্থাৎ ৫০ লক্ষ মার্ক পাঠাচ্ছে সেই কথা ফলাও করে প্রচার করছে। কিন্তু তারা এই সত্য গােপন করছে যে, পুলিশ জার্মান সরকার পাকিস্তানে সামরিক একনায়কত্বকে পােক্ত করার জন্য ১৮০ কোটি মার্ক সাহায্য দিয়েছে। এর শতকরা নিরানব্বই ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হয়েছে এবং প্রধানত সামরিক ও সংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যয়িত হয়েছে।
এমনকি এই বছরেও বন সরকার ইয়াহিয়া সরকারকে ১৪ কোটি মার্ক সাহায্য দিতে রাজী হয়েছে। ভারতের বাঙলার অনুরােধ সত্ত্বেও পশ্চিম জার্মানী সমেত পাকিস্তান সহায়ক গােষ্ঠীর কোন রাষ্ট্রই ইসলামাবাদের সামরিক প্রশাসনিক সাহায্য বন্ধ করতে এ পর্যন্ত রাজী হয় নি।
সংবাদ উদ্ধৃত করে শুক্রবার এ, পি জানিয়েছে যে, পশ্চিম বাঙলায় আগতদের জন্য অর্থ, খাদ্য এবং ওষুধপত্র বাবদ এ পর্যন্ত ২৫ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার সাহায্য পাঠানাে হয়েছে। এই সাহায্য জাতি সংঘের বহুমুখী কর্মসূচীতে এ পর্যন্ত যে কোন সাহায্যের তুলনায় বেশী বলে ঐ দুপুর থেকে মন্তব্য করা হয়েছে।
এই সাহায্যের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দান হলাে ৯ কোটি ৭৫ লক্ষ ডলার, বৃটেনের ৪৮ লক্ষ ডলার, পশ্চিম জার্মানীর ১৩ লক্ষ ডলার, কানাডা ২০ লক্ষ, বেলজিয়াম দেড় লক্ষ, বংসওয়ালী ৭ হাজার, সাইপ্রাস ৪ হাজার ৮শ ফ্রান্স ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার, গায়না ৫ হাজর, আয়ারল্যাণ্ড ১ লক্ষ ২০ হাজার, জাপান ২৫ লক্ষ ডলার, লাইব্রেরিয়া ২০ হাজার, নেপাল ২ হাজার ৫শ, নেদারল্যাণ্ড ৪ লক্ষ ৫১ হাজার ৭’শ ডলার। অবশ্য এই সাহায্যের মধ্যে সব টাকাটা নগদে দেওয়া হয়নি বেশি কিছু টাকা জিনিসপত্রের দেয়া হয়েছে।
সুইডেনের সাহায্য
স্টকহােম থেকে এ-পি’র সংবাদ দাতা জানাচ্ছেন, সুইডিস সরকার জাতিসংঘকে ৩ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা দানের সিদ্ধান্ত শুক্রবার গ্রহণ করে। এছাড়া ভারতে এবং পূর্ব বাঙলায় সেবারত রিলিফ প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে ৩৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দেবে।
বৃটেনের জাতীয় আবেদনে এ পর্যন্ত ৬৮ লক্ষ ৪০ হাজর টাকা সংগৃহীত হয়েছে। এই টাকার মধ্যে রানী ও রানীর স্বামী এডিলবার ডিউকের দানও আছে বলে বৃটিশ ইনফরমেন সার্ভিস জানিয়েছে।

সূত্র: কালান্তর, ১৩.৬.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!