You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.11 | একটি স্পষ্ট নিশানা | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

একটি স্পষ্ট নিশানা

বাঙলাদেশে ইয়াহিয়া খানের চরম বর্বরতার ফলে যে জরুরী অবস্থার উদ্ভব হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর যে দারুণ চাপ ভারতের ওপর এসে পড়েছে তার গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রীশরণ সিং বিদেশ সফরে বেরিয়েছেন। বন্ধু রাষ্ট্র সােভিয়েত দেশেই তিনি প্রথম যান এবং সেখানে গিয়ে সফরের সূচনাই তিনি সাফল্য অর্জন করেছেন। মস্কোতে তিনদিন অবস্থান করে তিনি শীর্ষ স্থানীয় সােভিয়েত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনা করেন যাদের মধ্যে সােভিয়েতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীকোসিগিন এবং পররাষ্ট মন্ত্রী শ্রীগ্রোমিকোও ছিলেন।
এই সাক্ষাৎকার ও আলােচনার পর যে ভারত সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতি বেরিয়েছে তা নানাদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ও আশাপ্রদ। বাঙলাদেশ থেকে শরণার্থীদের আগমন যে অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার এবিষয়ে সােভিয়েত সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। কেবল তাই নয়, আগত শরণার্থীরা আবার যাতে দেশে ফিরে যেতে পারেন তার জন্য সেখানে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপত্তামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে এবং সে বিষয়ে ভারতের প্রতি সােভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আছে।
কেবল সমর্থন জানিয়েই বিবৃতি শেষ করা হয় নি। বিশেষ জোর দিয়েই বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীর স্রোত সুনিশ্চিতরূপে বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে বাঙলাদেশই ব্যবস্থা অবলম্বন করা অবশ্য কর্তব্য। এমন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে যাতে ভারতে শরণার্থী আগমনের ইতি ঘটে।
পাক জঙ্গীশাহীর জল্লাদপনায় ভারতকেও যে জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পেরেছেন সােভিয়েত নেতৃবৃন্দ। সেই কারণেই তাদের প্রত্যয় জন্মেছে ভারত থেকে শরণার্থীদের স্বগৃহে ফিরিয়ে দেবার জন্যে সত্বর আরাে কিছু করা দরকার। বাঙলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে না আনতে পারলে বা শরণার্থীদের মনে নিরাপত্তাবােধ এনে দিতে সক্ষম না হলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আগত শরণার্থীদের ত্রাণকার্য পরিচালনাই এখন একমাত্র কর্তব্য নয়, আর যাতে শরণার্থী না আসে এবং যারা এসেছে তারা যাতে অবিলম্বে ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না।
সুতরাং বাঙলাদেশে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের একমাত্র উপায় ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনী থেকে তাকে মুক্ত করা। এই দখলদার জল্লাদবাহিনী সেখানে থাকতে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে বা লােকের মনে নিরাপত্তাবােধ ফিরে আসতে পারে না। ভারত সােভিয়েত যুক্তবিবৃতিতে তারই ওপর জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, বাঙলাদেশের অভ্যন্তরেই এমনভাবে শান্তিও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ভয়ে গৃহত্যাগের চিন্তা সেখানকার সাধারণ মানুষের মনে না আসে এবং ভারতে আগত শরণার্থীরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে ভয় না পায়। যারা মনে করেন, সােভিয়েত নেতৃবৃন্দ আসল সমস্যাটাকে এড়িয়ে গেছেন এবং মৌলিক কিছু ভাসা ভাসা কথা বলেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে বিদায় করেছেন তারা এই যুক্ত বিবৃতির সারবস্তু হয় ধরতে পারেন নি নয় সােভিয়েত বিষেশত সেটাকে লঘু করে দেখাবার চেষ্টা করছেন। সমস্যার মূলে রয়েছে খান বাহিনীর নৃশংসতা ও তার ফলে লক্ষ লক্ষ নরনারীর ভিটেমাটি ত্যাগ করে অন্য রাজ্যে এসে আশ্রয় গ্রহণ। সেই নৃশংসতা বন্ধ করে ব্যাপক উৎসাদবােধ ও গৃহত্যাগীদের ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাই সমস্যার মূলে গিয়ে পৌঁছানাে। যুক্ত বিবৃতিতে তারই ওপর জোর দেয়া হয়েছে এবং এ সম্বন্ধে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের দিকেও দৃষ্টি রয়েছে।
এই জটিল সমস্যা সমাধানে সােভিয়েত ইউনিয়নের ঐকান্তিক আগ্রহ ও ভারতের প্রতি তার সহযােগিতার হস্তপ্রসারণকে বিকৃত ব্যাখ্যার দ্বারা লঘু করে দেখাবার অর্থ ভারত ও বাঙলাদেশ উভয়েরই কল্যাণের প্রতি বিরূপতা। যাঁরা মনে করেন, শান্তির পথে অগ্রসর না হয়ে এই উপমহাদেশকে যুদ্ধবিগ্রহের দিকে ঠেলে দেয়াই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ সােভিয়েত আন্তরিকতায় তাঁর সন্দিহান হবেনই। বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সম্পর্কে বিবৃতিতে কোন স্পষ্ট ঘােষণা না থাকায় কোন কোন সন্দিগ্ধ মহল হতাশ হয়েছেন এবং এর মধ্যে কোনাে আশার আলােই দেখতে পান নি। দিনের আলােতে চোখ বুজে থাকা যাদের স্বভাব দিবাকরের মুখ দেখা থেকে তারা চিরদিনই বঞ্চিত।

সূত্র: কালান্তর ১১.৬.১৯৭১