You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.14 | আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ মে, ১৯৭১, শরণার্থী শিবিরে শ্রীমতি গান্ধী - সংগ্রামের নোটবুক

আনন্দবাজার পত্রিকা
১৪ মে, ১৯৭১
শরণার্থী শিবিরে শ্রীমতি গান্ধী

পূর্বাঞ্চলের শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখবেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। রবিবার আসবেন তিনি বনগাঁয়। এই শিবিরগুলোতে ইতিমধ্যেই তিরিশ লক্ষ আতংকিত মানুষ মানুষ জড়ো হয়েছেন। আরও আসছেন হাজারে হাজারে। জলের মত টাকা খরচ হচ্ছে। বাইরের সাহায্য বড় একটা পাওয়া যাচ্ছে না। এপারে এসে দূর্ভাগাদের সোয়াস্তি নেই। মাঝে মাঝে তাদের উপর পড়ছে পাক-কামানের গোলা। এই পর্বত প্রমাণ বোঝা বহনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেন্দ্রীয় সরকার। অথচ এর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল অনেক আগেই। প্রশাসকদের অদূরদর্শীতা জটিল করে তুলেছে গোটা পরিস্থিতি। শরণার্থীর ভারে নুইয়ে পড়ছে পশ্চিম বাংলা। নয়াদিল্লী ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন বাস্তব অবস্থা। পাল্টাচ্ছে তাদের ত্রাণ পরিকল্পনা। আত্মবঞ্চনা করে লাভ নেই। ইয়াহিয়ার চালের হারে হেরে গেছে ভারত। গণহত্যা এবং মানুষ-খেদার অভিযান সম্পূর্ণ হলে বহাল তবিয়তে ঘর গুছাবেন ইয়াহিয়া খান। আর তার দুষ্কার্যের ভারবাহী হয়ে থাকবে ভারত। মুক্তিযোদ্ধারা লড়বেন। তাঁদের সর্বাত্মক বিজয় কবে সম্ভব হবে তা জানবেন না কেউ। অন্তত এইটুকু সত্য আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য শরণার্থীরা থাকবেন ভারতে। অনেকে হয়তো আর ফিরে যেতেই চাইবেন না। ইসলামাবাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন নয়াদিল্লী। এ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার পথ একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

শরণার্থী শিবিরগুলোতে দেশী-বিদেশী অনেক মহামান্যের পদধূলি পড়েছে। তাতে হতভাগ্যদের ভাগ্যের কোন পরিবর্রতন ঘটেনি। বাংলাদেশের পাক-অত্যাচার বন্ধ হয়নি। শ্রীমতি গান্ধীর আগমনে লক্ষ লক্ষ মানুষের দীর্ঘশ্বাসের গরম হাওয়া ঠান্ডা হবার নয়। ওরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বদেশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলেই অধিকাংশই হয়ত ফিরে যাবেন। এই পরিবেশ সৃষ্টিতে যত দেরী হবে অনেকের ফিরে যাবার পথও তত কন্টকিত হয়ে উঠবে। শেষ পর্যন্ত ক’লক্ষ নরনারীর হয়তো ফিরে যাওয়াই হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ছাড়া আর কেউ শরনার্থীমুক্ত করতে পারবেন না ভারতকে। তার জন্য দরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক অগ্রগতি এবং মুক্ত অঞ্চলের পরিধির বিস্তার। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পাননি কারও কূটনৈতিক স্বীকৃতি। তাদের ভাগ্যে জুটছে না প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র। ইয়াহিয়ার সুসজ্জিত বাহিনীর সঙ্গে তাঁরা লড়াই করবেন কিসের জোরে? বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাবার অনুমতির জন্য ইসলামাবাদের কাছে আর্তি জানাচ্ছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘ। আমেরিকা পিছন থেকে ঠেকা দিচ্ছে ভারতকে। ইয়াহিয়া শুধু বলছেন- এখনও সময় আসেনি। বাংলাদেশকে একেবারে পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত ইসলামাবাদের বাঞ্চিত সময় আসবে না। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বেন বাঙ্গালী জনতা। এপারে শরণার্থীদের ঘিরে দানা বাঁধবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। কৃতজ্ঞতার বদলে দেখা দেবে ভারতের প্রতি বিতৃষ্ণা। ঠিক এই মুহূর্তেই আসবে ইয়াহিয়ার অনুকূল সময়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাহায্য তিনি নিতে চাইবেন নিজের হাতে। তাতে হয়ত আপত্তি করবেন না বিশ্বসভার মানবদরদীরা। পাক-ঘাতকেরা নামবে আর্ত-ত্রাণে। লাভের ব্যবসা ফাঁদবেন ইসলামাবাদ। বৈদেশিক সাহায্যের ছিটেফোঁটা যাবে বাংলাদেশে। পরের ধনে দল ভারী করবে কুচক্রী দল। ক্ষুধার অন্ন যে তুলে দেবে আর্তের মুখে জনতা তাদেরই জানাবেন সেলাম। ভুলে যাবেন অতীতের নারকীয় ঘটনা। দুনিয়ার এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে না বাংলাদেশে। মুক্তিযোদ্ধারা সহজে ছাড়বেন না। ভারত সীমান্ত থেকে ওঁরা চালাবেন গেরিলা তৎপরতা। অসহায় নয়াদিল্লী চেয়ে চেয়ে দেখবেন। পাক-বেতার শুরু করবে উলটো প্রচার। পূর্ববাংলা শান্ত। তাকে অশান্ত করছে ভারতাশ্রিত গেরিলারা। আর্ত ত্রাণে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে পদে পদে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞের দল তখন বলবেন- কথাটি ফেলনা নয়।

শরনার্থী শিবিরগুলো দেখতে এসে শ্রীমতি গান্ধী ভালই করবেন। তিনি বুঝতে পারবেন ‘দেখি কি হয় নীতির পরিণাম’। সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটা বিরাট অঞ্চলকে ছাড়খার করছে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরের একটা হানাদার বাহিনী। বিশ্ববিবেকের মাথায় দিনের পর দিন লাথি মারছেন ইয়াহিয়া খান। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো অত্যাচারিতের সেবার জন্য লোক দেখানো কলরব তুলছে। ঘাতকের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছেন তাঁদের জন্য কারও মাথা ব্যাথা নেই। ওঁদের সরকার পাচ্ছেন না কূটনৈতিক স্বীকৃতি। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসছে না অস্ত্রশস্ত্র। এই রাষ্ট্রগুলোর মুখ চেয়ে বসে আছেন নয়াদিল্লী। ঘরের পাশে একটা পশু শক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে পারল না ভারত। তার এই দুর্বলতার জের চলবে দীর্ঘদিন। বাইরের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর কোন আস্থা থাকবে না নয়াদিল্লীর উপর। তাদের শক্তির আড়ম্বর দাগ কাটবে না কারও মনে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের মর্যাদাহানির পরিপূরণ করতে পারবে না নিষ্ক্রিয় নৈতিক বাক্যবিন্যাসে। শ্রীমতি গান্ধীর জন্য অপেক্ষা করছে শরনার্থীদের বুক ফাটা কান্না। চোখের সামনে যারা নিহত হতে দেখেছেন প্রিয়জনদের, কি দিয়ে তিনি তাঁদের দেবেন সান্ত্বনা। প্রতিশোধের জন্য বাংলাদেশের সাচ্চা তরুণ-তরুণী পাগল। তাদের সামনে কি দৃষ্টান্ত রেখেছেন নয়াদিল্লী? ভারতীয় অঞ্চলে পড়ছে পাক-কামানের গোলা। মরছেন ভারতীয় নাগরিক। সীমান্ত রক্ষীদের অপহরণ করছে পাক-হানাদাররা। শুধুমাত্র কড়া নোটে পাঠিয়েই কর্তব্য বোধ করছেন কেন্দ্রীয় সরকার। শক্তিমানের শক্তির আস্ফলনের বাস্তব প্রয়োগ নেই যেখানে, সেখানে সে হতে পারে না অন্যের শক্তির প্রেরণা। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রয়োজন ছিল শ্রীমতি গান্ধীর। হয়ত তিনি পারবেন তা শরনার্থী শিবিরগুলিতে।

নয়াদিল্লীর হাতে আছে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর সার্টিফিকেট। অমানুষিক সংযমের পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা। শত শত জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বাংলাদেশে। দশ লক্ষ নরনারীর রক্তে ভেসে গেছে পথঘাট। এবং কুকুরের দল গলিত শব নিয়ে করছে টানাটানি। কোটি টাকা এবং রাশি রাশি সোনা রূপা পাচার হয়েছে পাকিস্তানে। হাজার হাজার নারী ধর্ষিতা। তিরিশ লক্ষ শরনার্থী বোঝা নিয়ে ধুঁকছে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো। ভারতের আকাশসীমা এবং সীমান্তরেখা লঙ্ঘিত হচ্ছে বার বার। ঢাকায় রয়েছেন ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীরা আটক। তা স্বত্ত্বেও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গেনি নয়াদিল্লীর। ধরিত্রীর মত এই সর্বসংহা আচরণের অসংখ্য সাধুবাদ দিয়েছে বৃটেন, সোভিয়েট রাশিয়া এবং আমেরিকা। নিজেদের ঘাড়ে যখন এসে পড়ে নিরাপত্তার সমস্যা তখন তাদের মধ্যে দেখা যায় না বহু প্রশংসিত এই সংযম। তার প্রমাণ, কিউবায় মার্কিন অবরোধ, হাঙ্গেরী এবং চেকোশ্লোভাকিয়ায় সোভিয়েট প্রতিরোধ এবং ১৯৫৬ সালে বৃটেনের সুয়েজ অভিযান। বাংলাদেশের ঘটনাবলীর সঙ্গে এগুলোর তুলনা চলে না। এ অঞ্চলের সংগ্রাম গণতন্ত্রের সংগ্রাম এবং সংখ্যালঘু ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠদের লড়াই। ভারতের উপর চলছে তার প্রত্যক্ষ জের। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী ভেবে দেখুন- তিনি বৃহৎ শক্তিগুলোর দেওয়া সার্টিফিকেট সোনার ফ্রেমে বাধিয়ে রাখবেন, না তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আত্মশক্তিতে বাস্তব অবস্থার মোকাবিলা করবেন।