You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন আগরতলা। ইচ্ছে ছিল, সেখান থেকে জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে যােগাযােগ করা যায় কিনা সে চেষ্টা করা। সফল হননি। ফিরে এলেন ঢাকায়। ৭ ফেব্রুয়ারি জননিরাপত্তা আইনে বন্দী হলেন। তাঁর সঙ্গে আরাে গ্রেফতার হলেন আবুল মনসুর আহমদ, মানিক মিয়া, রণেশ দাস গুপ্তসহ ১৭ জন। ২ জুন সামরিক শাসনের অবসান হলে ১৮ জুন তিনি মুক্তি পান। ডিসেম্বরে মানিক মিয়ার সাহায্যে নেহেরুর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি তৈরি করেন। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে পাঞ্জাবিদের চরম শােষণ ও রাওয়ালপিন্ডির সামরিক স্বৈরাচারী শাসন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং বাঙালিদের জন্য গঠন করতে হবে একটি স্বাধীন আবাসভূমি। এ জন্য শেখ মুজিব চলে যাবেন লন্ডন। এবং সেখানে ঘাঁটি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করবেন। এ জন্য তিনি একটি রােডম্যাপও তৈরি করেছিলেন-
১. মুজিব চলে যাবেন লন্ডন।
২. মানিক মিয়া থাকবেন ঢাকায়। নিয়মিত স্বায়ত্তশাসনের প্রয়ােজনীয়তা ও দাবি নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে লিখবেন।
৩. মুজিব লন্ডন থেকে ১৯৬৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অথবা ১ মার্চের ভেতর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করে লন্ডনে প্রবাসী সরকার গঠন করবেন।৬
৪. পণ্ডিত নেহেরু এই সংগ্রামের নৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, কৌশলগত ও পার্থিব সাহায্য প্রদান করবেন।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খান যেমন একদিকে মৌলিক গণতন্ত্র ঘােষণা করেন, অন্যদিকে সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের কারণে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। সােহরাওয়ার্দী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না, কারণ তাদের ধারণা ছিল, এতে আইউব বিরােধী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে। এর বিকল্প হিসেবে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমােক্র্যাটিক ফ্রন্ট বা এনডিএফ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কিন্তু এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের নয় জন রাজনীতিবিদ গণতান্ত্রিক সংবিধান, ফেডারেল সংসদীয় ব্যবস্থা, বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদি বিষয়ে এক বিবৃতি দেন। এঁরা হলেন নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হােসেন সরকার, মাহমুদ আলী, শেখ মুজিবুর রহমান [জেলে], ইউসুফ আলী চৌধুরী, পীর মােহসেন উদ্দিন ও সৈয়দ আজিজুল হক।৭ বিবৃতিটি দেয়া হয়েছিল ২৪ জুন। এরপর এনডিএফ গঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তানে সােহরাওয়ার্দী-মুজিব ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলেন।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন চাচ্ছিলেন। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী সম্মত নন। নেতার সম্মতি নিতে লন্ডন গিয়েও সম্মত করতে পারেন নি। সােহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেন ৫ ডিসেম্বর। শেখ মুজিব পাকিস্তান গিয়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটান।
১৯৬৪ সালের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দল পুনরুজ্জীবিত করা হয়। মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ হন সভাপতি, শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ছিলেন পুনরুজ্জীবনের বিরােধী। তারা এনডিএফকেই কার্যকর মনে করেছিলেন।৮ এমনকি মানিক মিয়াও তা সমর্থন করেন নি। তিনি লিখেছিলেন, “শহীদ সাহেবের পরলােক গমনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবীত হয়। আমি তীব্র বিরােধিতা করিয়াও পুনরুজ্জীবন রােধ করিতে পারি নাই। পরবর্তীকালে ঘটনাপ্রবাহের চাপে পড়িয়া এবং আওয়ামী লীগ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধ্বংস হইয়া যায়, এই আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত আমাকে বাধ্য হইয়া মত পরিবর্তন করিতে হয়।”৯
১৯৬৪ সালের ৬ ও ৭ মার্চ ঢাকার হােটেল ইডেনের প্রাঙ্গনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তর্কবাগীশ ও বঙ্গবন্ধু, মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমান যােগ দেন আওয়ামী লীগে এবং একজন কর্মকর্তা নির্বাচিত হন।
ঐ বছর দুটি ঘটনা ঘটে। একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষ করে সম্মিলিত বিরােধী দল বা ‘কপ’ গঠন হয়। আরেকটি সরকারের উস্কানিতে দাঙ্গা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠিত হয়। কমিটি থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ প্রচারপত্র সেদিন আলােড়ন তুলেছিল। ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কপের প্রার্থী ফাতেমা জিন্না আইয়ুবের কাছে হেরে যান। ৬ সেপ্টেম্বর ১৭ দিন ধরে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ চলে; তাসখন্দ চুক্তিতে যুদ্ধ থামানাে হয়। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল।
সামরিক শাসন থেকে ১৯৬৫ সালের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিরােধীরা বিরােধে দীর্ণ। সম্মিলিতভাবে কোনাে প্ল্যাটফর্ম গঠন করা সম্ভব হলেও তা টিকছে না। আওয়ামী লীগের তাত্ত্বিক/নেতারা (যেমন—সােহরাওয়ার্দী) আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের বিপক্ষে। আওয়ামী লীগেও অন্তর্বিরােধ চলছে।
শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখে আসছিলেন, এ পরিস্থিতিতে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি নেহেরুর আশ্বাস পেয়েছিলেন। নিজের ওপর আস্থা ছিল, তাই তিনি ভেবেছিলেন তাঁকে ভিন্ন পথে এগুতে হবে। প্রথমে দল পুনরুজ্জীবন, মানুষকে স্বপ্ন দেখানাে এবং পাকিস্তানি মানস থেকে বেরিয়ে আসা। তারপর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে, মনজিলে মকসুদে পৌঁছানাের চেষ্টা। এ ভাবনা তিনি কখনও প্রকাশ করেন নি। তবে, অনুমান করে নিতে পারি, তিনি এ পরিপ্রেক্ষিতে ছয় দফা ঘােষণা এবং দলকে সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করাকে কৌশল হিসেবে নিলেন। এও তিনি ঠিক করেছিলেন, তাঁর পথে কেউ না এলে, যারা আসবে তাদের নিয়েই পথ চলা শুরু করবেন, সে পথ যত দীর্ঘই হােক না কেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ তাঁর মােহমুক্তি ঘটিয়ে ছিল যখন দেখা গেল, পূর্ব ফ্রন্টে কোনাে প্রতিরক্ষা নেই। পূর্ববঙ্গের মানুষ অরক্ষিত এটিই তিনি জনগণকে সচেতন করার জন্য বক্তৃতায় প্রথমে ব্যবহার করলেন। তার সূত্র ধরে এল বৈষম্যের কথা।
References:
৬. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, মুনতাসীর মামুন, বঙ্গবন্ধু কীভাবে স্বাধীনতা এনেছিলেন, ঢাকা, ২০১৩।
৭. বিস্তারিত বিবরণের জন্য, আবু আল সাঈদ, আওয়ামী লীগের ইতিহাস, ঢাকা, ১৯৯৩ ও Shyamali Ghosh, The Awami League, Dhaka, 1990.
৮. যারা এনডিএফে থেকে যান তারা হলেন—আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, জহিরুদ্দিন, নুরুর রহমান, খয়রাত হােসেন, আবদুল জব্বার খদ্দর, আলমাস রুহুল বকস, কাজী বােরহানউদ্দিন, একে রফিকুল হােসেন, আবদুল হামিদ চৌধুরী, জিল্লুর রহিম, জহুর আহমদ চৌধুরী, আমির হােসেন দোভাষ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, ডা. মযহার উদ্দিন আহমদ, রমিজউদ্দিন আহমদ, জসিম উদ্দিন আহমদ, শফিক আহমেদ, তােফাজ্জল আলী, জয়নাল আবেদীন, গাজী ইকবাল আনসারী, শওকত আলী প্রমুখ। বিস্তারিত দেখুন, নূহ-উল-আলম লেনিন, সম্পাদিত, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল, ঢাকা, ২০১৫।
৯. তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া), পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর, ঢাকা ১৯৮১, পৃ. ১৬৬।
৬ দফা স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু – মুনতাসীর মামুন, p 13-15

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!