You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.08 | ফ্রন্টিয়ার পত্রিকা, ৮ মে, ১৯৭১ পূর্ব বাংলার ঘটনা প্রবাহের ওপর ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার একটি সমীক্ষা - সংগ্রামের নোটবুক

ফ্রন্টিয়ার পত্রিকা
৮ মে, ১৯৭১
পূর্ব বাংলার ঘটনা প্রবাহের ওপর ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার একটি সমীক্ষা
পরবর্তী ধাপ
পূর্ববাংলা
– কে সেন

বাংলাদেশে যুদ্ধ প্রায় এক মাস হয়ে গেল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তিনি বলেছিলেন যে তিনি ৪৮ ঘনতায় এই আন্দোলন শেষ করতে পারবেন সম্ভবত তিনিও অবাক হবেন যে তা করা যায়নি যদিও তা আর্মির বিরুদ্ধে ছিল। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার অস্বস্তি ভোগ করছে কারণ তারা মুদ্রার মূল্যহ্রাস করতে সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে হাজার হাজার শরনার্থি ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছে এবং এমনকি যদি তারা যা বলে তার ভগ্নাংশ সত্য হয় তবে তা আর সোনার বাংলা নাই যা তারা দেখে এসেছিল। শহরগুলি প্রায় ফাঁকা এবং সুবিশাল গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বিধ্বস্তপ্রায়।

তারপরেও যুদ্ধ চলছে। এখনো তেমন কোন দিন নেই যে মুক্তিফৌজ তাদের বিজয় দাবি করতে পারে। এটা এখন শুধু যুদ্ধ করতে করতে মারা যাওয়া অথবা শেষ পর্যন্ত মারা যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রথমটাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়। ঢাকা সাংবাদিকরা সম্প্রতি নতুন করে গ্রুপিং দেখেছেন। সেটা খুব দেখার মত বিষয় হবে।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া একটি দীর্ঘায়িত যুদ্ধ হতে পারে না। মুক্তিফৌজ বর্তমানে পার্লামেন্টারি ফোর্সের একটি আধাসামরিক বাহিনী। যতদূর সম্ভব তাদের প্রধান কাজ হিসেবে প্রতিরোধ করা। যদিও পত্রিকায় বাড়ীয়ে লেখা হয় – তবে বাস্তবে প্রতিরোধ তেমনটা হচ্ছে না। এটা সহজেই অনুমেয় কারণ তেমন প্রস্তুতি নেই। কিন্তু এখন আর্মি বাংলাদেশে গেড়ে বসেছে – কাজ হল এদেরকে বের করা। এবং রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে কিছু করা গেলে এই যুদ্ধ সফল হত যা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে।

ডিসেম্বরের নির্বাচন আওয়ামী লীগ কে সামনে এনেছে। এবং পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের গণতন্ত্রকে উপেক্ষা তাদের (আওয়ামীলীগের) গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। মুজিব পল্টন ময়দানে বজ্র কণ্ঠে কথা বলেছেন এবং তার দ্বাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি নতুন উচ্চতা লাভ করেছে। তারপর সেনাবাহিনী আঘাত হানে। আর সীমান্তের চারপাশে অনেক আওয়ামীলীগ নেতারা অবস্থান করছেন। এটি অনেককে হতাশ করেছে। জয় বাংলার উদ্দীপনা আগের মত নাই। এখন এই প্রশ্ন করার সময় এসেছে যে বাংলাদেশে এখন আওয়ামীলীগের প্রভাব খাটানোর মত ক্ষমতা আছে কিনা।

আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সুপরিচিত। এবং সব সময় চেষ্টা করেছে কিভাবে অবাঙ্গালি শাসকদের পরিবর্তে বাঙ্গালিদের শাসন চালু করা যায়। এই দলের লক্ষ্য ছিল অর্থণৈতিক অধিকার আদায় করা। মুজিব শেষ পর্যন্ত হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াবে। সে যখন এটা করেছে অনেক সময় দলের অধস্তনদের চাপ ছিল। তবে সব সময় সে চেষ্টা করেছে ইয়াহিয়ার সাথে একটি বোঝাপড়ায় আসতে। যেহেতু আলোচনা এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাই মুজিব বলেছে যে যদি সেনা শাসন চলে তাহলে কমিউনিস্টরা সুবিধা পাবে। তার এন্টি-কমিউনিজম সম্পর্কে সবাই জানে। একজন প্রায়ক্টিকাল রাজনীতিবিদ জানেন যে, তার দল সাংগঠনিকভাবে অথবা আদর্শগতভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য আন্দোলনে যাবার জন্য প্রস্তুত নয়। সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছেন যে জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে তাকে কমিউনিস্টদের সাহায্যও লাগবে। এখন মনে হচ্ছে, তার কথাই সত্য হতে যাচ্ছে।

মুজিবের ভয় তিনি ভারত সরকারের সাথেও আলোচনা করেছেন। এবং মুক্তিফৌজের জন্য অস্ত্র সাহায্যের ব্যাপারেও বিব্রত হন। দিল্লি সরকার জানেন যে, আওয়ামীলীগের এই মুহুর্তে ক্ষমতা নাই অস্ত্র বাংলাদেশে নিয়ে যাবার। মিসেস গান্ধি ও তার সমর্থকরা নিশ্চই চাননা যে অযাচিত ব্যাক্তির হাতে অস্ত্র চলে যাক। এবং বর্ডারে এই পাশে কিছু একটা পথ বের করতে পারবেন। সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে কোন ব্যাবস্থা নিচ্ছেন না যাতে পশ্চিমবঙ্গে কোন প্রভাব পরে। অন্যদিকে দিল্লি ইসলামাবাদের সাথে নিহিত সম্পর্কের কারণে আশা করেনা যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে এবং আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের ক্ষমতা পাবে। এটাও সন্দেহজনক যে ভারত এই অবস্থায় আরামে আছে কিনা যেখানে এমন একটি শক্তি জেগে উঠেছে। মুজিবের মত ইন্দিরাও অনড় আছেন বলে মনে হচ্ছে।

পাশাপাশি, বাংলাদেশের কম্যুনিস্টরা একটিভ আছে। আন্দারগ্রাউন্ডে। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টী যার নেতৃত্বে আছেন আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমেদ, টিপু বিশ্বাস ও অন্যান্যরা – তারা পশ্চিমবঙ্গের চি পি আই (এম) এর মত – এবং তারা বগুড়া, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও পাবনায় গেরিলা সংগ্রাম চালাচ্ছে। এদের শ্রমিক ও নিম্নশ্রেণির জনগণের সাথে প্রভাব আছে – প্রমাণ হিসেবে বলা যায় প্রায় ৪০০০০ শ্রমিক চট্টগ্রামে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। পি বি সি পি একটি ঘনিস্ট দল – সমন্বয়ে আছেন জাফর মেনন ও অন্যান্যরা যারা বিদ্রোহী ছাত্রদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মওলানা ভাষানি ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, রাজশাহী ও অন্যান্য যায়গায় প্রায় একই রকম কাজ করছেন। কমিউনিস্টরা এখন একটা অসুবিধা অনুভব করছে যা অনেক বছর ধরেই আওয়ামীলীগ করে আসছে। ই পি আর, ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজনরাও তাদের উপড় বিরূপ। তবে বড় আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত জনগণই আসল এবং কম্যুনিস্টদের তাদের সাপোর্ট হারাবার সম্ভবনা খুব কম।

পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) যার নেতৃত্বে আছেন প্রো-ভাসানী ন্যাপ এর সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি মোহাম্মদ তোয়াহা -তিনি বর্তমানে মাওবাদী এবং যশোর ও খুলনায় শক্তিশালী ঘাঁটি আছে। রক্ষণশীলদের অনুমান দলের অঙ্গীকারবদ্ধ সমর্থকদের সংখ্যা ১০০০০ হবে। মাওবাদীরা এখন একটু নিচে আছে। তবে একটি জিনিসের জন্য তারা তাদের ট্রেইন্ড ফাইটারদের মাঠে নামাচ্ছেনা। তবে বাংলাদেশি বোদ্ধা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন তাদের ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সাথে যোগ দেবার সম্ভবনা আছে।

পি বি সি পি এবং পি পি সি পি (এমএল) এর মধ্যে পার্থক্য মূলত আদর্শিক। এবং ব্যক্তিগত ঘৃণায় তা রূপ নেয় নি। তবে এই পার্থক্য কমন শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের একত্রিত হতে বাধা দেবেনা।

এই পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভবিষ্যতে কোন দিকে যাবেন। আওয়ামী লীগ ভালর জন্য দূরে থাকবেনা। দলে বিদ্রোহীরা আছে, বিশেষ করে নিচের ক্যাডারে, সামনের আন্দোলনে যাদের যোগ দেবার সম্ভবনা প্রবল। কলকাতা ও মুজিবনগরের ভদ্র লোকদের জন্য – ব্যবহারিক উদ্দেশ্যেই তারা তাদের পক্ষে যা করার তা করবে বলে মনে হচ্ছে।