১৫ আগস্ট, ২০০৮। অবশেষে আজ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন হল বাংলাদেশে। এই বাক্যটি লেখা শেষ হতে না হতেই এক ঐতিহাসিক ঘটনা মনের ভিতরে আপনা-আপনি হাজির হল। ১৮২১ সালে সেন্ট হেলেনা নামে একটি নির্জন দ্বীপে নেপােলিয়ন বােনাপার্ট মারা যান। সম্ভবত তাকে বিষ প্রয়ােগে হত্যা করা হয়। তারপর অনেক বছর পরে জনগণের শ্রদ্ধা-ভালােবাসার নিদর্শনস্বরূপ প্যারিস শহরের একটি পার্কে তার মর্মর প্রতিমূর্তি স্থাপন করা হয়। তখন নেপােলিয়নের জননী জীবিত ছিলেন, কিন্তু পুরােপুরি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এক ষােড়শী দৌহিত্রীর কাঁধে হাত রেখে পায়ে হেঁটে তিনি পুত্রের মর্মর প্রতিমূর্তির সামনে পৌঁছলেন। সস্নেহে প্রতিমূর্তির গায়ে হাত বুলিয়ে বারবার প্রার্থনা করার মতাে মৃদুস্বরে বলতে থাকলেন । সম্রাট স্বদেশে ফিরে এসেছে। দু-চোখ দিয়ে ঝর্নাধারার মতাে আনন্দাশ্রু গাল বেয়ে নেমে তার বুক ভিজিয়ে দিল। | ১৯৮৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলা বিভাগ প্রচার করেছিল একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠানমালা, যার নাম ছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ১৫ বছর’। এগুলাে পরে বিবিসি বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান সিরাজুর রহমান কর্তৃক সংকলিত হয়ে বই আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি থেকে সংক্ষেপিত উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
“২৫ শে মার্চ-এর শেষবেলার ঘটনাবলি সম্বন্ধে জমিরুদ্দিন আহমেদ বলেন, তখন ইয়াহিয়া খান ও সরকারি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের কথাবার্তা চলছিল। আমাকে ভুট্টোর সঙ্গে যােগাযােগ রাখার কাজ দেয়া হয়েছিল। হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আমি চারটের সময় গেলাম। মুস্তফা খার বললেন, ভুট্টো সাহেব ঘুমাচ্ছেন। তুমি সন্ধ্যা আটটায় আসাে। আমি আটটার সময় গেলাম। আর বললেন, চিড়িয়া তাে ভেগে গিয়েছে। চিড়িয়া অর্থাৎ ইয়াহিয়া খান। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসলাম । মুজিব ভাইকে বললাম, প্রেসিডেন্ট তাে চলে গিয়েছে। তিনি বললেন, ভুট্টো ক বলে শুনে আসাে। আমি আবার গেলাম। তখন প্রায় দশটা বাজে। আর বললেন ভুট্টো দেখা করতে চান না।
আমি ফিরে মুজিব ভাইকে ভুট্টোর কথা বললাম। তিনি বললেন, জানিয়ে আমি তাজউদ্দিনদেরকে বলেছি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার জন্য, কিন্তু আমি কী করি বলআমি কী কলি বল। যদি ধৱা না দিই, ওরা তাে পাগলা কুত্তার মতন আমার সব ওয়ার্কারদের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে। দু-ঘন্টা ধরে এদিক-ওদিক গুলি শুনতেছি।
আমি মুজিব ভাইকে টেলিফোন করলাম ভাবী ধরলেন। বললাম, মুজিব ভাইকে কি নিয়ে গিয়েছে। তিনি বললেন, না এখনও নেয়নি। তবে গুলি করছে আমাদের বাড়িতে। এরপর টেলিফোন বন্ধ হয়ে গেল।” (পৃষ্ঠা ৫-৬) | ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাদের গােলাগুলি শুরু হওয়ার পরক্ষণেই ঢাকা রেডিওতে ব্যবহৃত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি বেতারে শােনা গেল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। এটাই ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর অধীনে বাংলাদেশ তখন ছিল কার্যত স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু অবশ্যই জানতেন ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি অফিসাররা, বিশেষ করে ইলেকট্রিক মেকানিক্যাল কোৱে যারা কর্মরত ছিলেন তারা গােপনে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন তাদের ওয়ার্কশপে ট্যাঙ্কগুলাের চাকার সঙ্গে সংযুক্ত লােহার বেল্টের ওপরের অংশে রাবারের বেন্ট জুড়ে দেয়ার কাজ চলছে। যার অর্থ ট্যাংকগুলাে শহরের রাস্তায় ব্যবহার করা হবে। এই খবর পেয়ে ধ্বংসযজ্ঞ কী পরিমাণ ভয়াবহ হবে সেটা বঙ্গবন্ধু আঁচ করতে পেরেছিলেন।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আপনারা এখন এই প্রশ্নটি করতেই পারেন যে, কে বা কারা ওই রেকর্ডটি প্রচার করেছিলেন এবং সেটার খোঁজ নেই কেন? যেহেতু ঘােষণটি যে ওই তারিখে ওই সময়ে প্রচারিত হয়েছিল সেটা প্রমাণিত সত্য, সল্প সকল প্রকার প্রমাণ-অনুমান যাচাই করে আমি প্রশ্নটির উত্তর পেয়েছি। মগবাজারের টেলিফোন হাউসের ক্যারিয়ার এ্যান্ড ওয়ারলেস ডিভিশন’-এর কক্ষ থেকে রেকর্ডটি প্রচার করা হয়েছিল, ঢাকা রে%ি কেন্দ্র থেকে নয় । আমার এই উৱটির পক্ষে জোরালাে তথ্য হচ্ছে, পাকিস্তানি সেনারা স্বাধীনতা প্রচারের ঘটনাটি জেনেছিল। সেসময়ে কর্মরত একজন সামরিক অফিসার সিদ্দিক সালিক পরবর্তীকালে স্তর লেখা ‘উইটনেস ? সারেন্ডার’ বইটিতে লিখেছেন, যখন প্রথম গুলিটি ছােড়া হল তখন শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণকণ্ঠ সরকারি পাকিস্তান রেডিওর কাছাকাছি বেতার-কঙ্গে শােনা গেল। এটা নিশ্চিত এবং সে মতই শােনা গেল যেন এটা পূর্ব-রেকর্ডকৃত বাণী-শেখ পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘােষণা করছেন।” (পৃষ্ঠা ৭৫)। এটা জানার কারণে পাকিস্তানি সেনারা রেডিও কেন্দ্রে নয়, মণবাঙ্গাৱেৱ টেলিফোন হাউসে হামলা করে কর্মচারীদেরকে মেরে ফেলেছিল ও সেখানকার সবকিছু পুড়িয়ে ফেলেছিল।
দেখা যাচ্ছে বঙ্গণার অন্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের নকশা আঁকা ছিল। কিন্তু কবে থেকে? এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়ার জন্য একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির সাক্ষ্য উপস্থিত করছি। একাত্তরে মওলানা ভাসানীর ভারত প্রবাসীকালীন সময়ে তার ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন সাইফুল ইসলাম। তিনি আওয়ামী লীগের নয়, বরাবর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন এবং বামপন্থী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তার লেখা ১৯৮৭ সালে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতা ভাসানী ভাৱত’ বইটি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
অনেকে বলে থাকেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে শেখ মুজিবর রহমানের পূর্বে কোনও চিন্তাভাবনা ছিল না। কথাটা সত্য বলে আমি অন্তত মেনে নিতে পারি না। ১৯৯০ সালে আমার বন্ধু খুরশীদ আলম ও আমি প্রথম পশ্চিম পাকিস্তানে আই। তৎকালীন প্লিাহ এভিনিউতে অবস্থিত মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের ওপরতলা হতে ট্রাভেলার্স চেক সংগ্রহ করে নিচে নেমে আসেতই গলির মধ্যে শেখ সাহেব ও আইডিয়াল লাইফ ইনসিওরেন্সের আঞ্চলিক কর্মকর্তা শফিউর রহমানের সঙ্গে আমাদের মুখােমুখি সাক্ষাৎ হয়। আমাদের দেখেই উহায় শেখ সাহেব তার স্বভাবসুলভ আচরণে এগিয়ে এলেন। কাধে হাত রাখলেন। হাতে ট্রাভেলার্স চেক দেখে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কোথায় যাচ্ছি। করাচি যাচ্ছি শুনে শফিউর রহমান ঠাট্টা করে বললেনঃ ওরা ন্যাপ করে, ওদের অত তােষামােদ করছেন কেন? ন্যাপ করে তাতে হয়েছে কী? আমি যেদিন স্বাধীন বাংলার ডাক দিব, ওরা হবে প্রথম কাতারের সৈনিক’।” (পৃষ্ঠা ৪২-৪৩)।
সােনার বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালােবাসার অন্ত ছিল না। এরকম ভালােবাসা বিপদ ডেকে আনে। গান্ধী, বঙ্গবন্ধু এদের জীবনটাই তার প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের জনসভায় তার হঙ্কার আর দাবায়ে রাখতে পারবা না”—মুক্তিযােদ্ধা জনগণকে এমন সাহস যুগিয়েছিল যে তারা ২৮৪ দিনের সশস্ত্র যুদ্ধেই জয়ী হওয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বিশ্বসভায় আসন পেয়েছে।
আনন্দে-উচ্ছাসে এতক্ষণ লেখার পর যখন শেষ করার কথা ভাবছি তখন দেখছি গােড়াতেই ভুল করেছি। লেখার শিরােনামটিই ভুল। বঙ্গবন্ধু তার অন্তরে যে বাংলাদেশের নকশা এঁকেছিলেন সে বাংলাদেশ কই? তাঁর অবর্তমানে সমাজতন্ত্র বদলে হয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার। ধর্মনিরপেক্ষতা উধাও হয়েছে আল্লাহর প্রতি আস্থা। মুক্তিযুদ্ধের নাম বদলে দেয়া হয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধ। জয়বাংলা বলে মুক্তিযুদ্ধ হল, অথচ সেটা উচ্চারিত হচ্ছে না, শুনছি বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। এ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অপরিচিত বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু কেন প্রত্যাবর্তন করবেন।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, এই প্রশ্নটির উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কি পাচ্ছেন?
জনকণ্ঠ ১৫ আগষ্ট ২০০৮