You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভুট্টো-চরিতামৃত

এ. এস. জি জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো সম্প্রতি এক কিতাব লিখেছেন। কিতাবখানি পাকিস্তানের রাজনীতি সম্পর্কে জনাব ভুট্টোর ব্যক্তিগত ধ্যানধারনা ও চিন্তাধারার কিছু পরিচয়। কিন্তু ময়ূরপুচ্ছে যেমন দাঁড়কাকের বায়সচরিত্র ঢাকা পড়ে না তেমনি এ কিতাবে জনাব ভুট্টো তার নিজ চরিত্রকে আবডাল করে রাখতে পারেননি।
রতনে রতন চেনে। আয়ুব চিনেছিলেন তেমনি ভুট্টোকে। অপরিচয় ও অনাদরের আস্তাকুঁড় থেকে প্রেসিডেন্ট আয়ুবই একদিন ভুট্টোকে হঠাৎ পাকিস্তানি রাজনীতির কেউকেটা করে বসালেন। প্রেসিডেন্ট আয়ুবের কৃপায় সেই ভুট্টো হলেন পাকিস্তানের বৈদেশিক মন্ত্রি যে ভুট্টোকে তার আগে কেউ পুছত না। এবং নজর করলে দেখা যাবে, যতদিন জনাব ভুট্টো বৈদেশিক গদিতে ছিলেন ততদিনের মধ্যে একবারও তিনি পূর্ব বাঙলার জনসাধারণের দুর্দশার কথা ভাবেননি, একটা কথাও বলেননি, একফোটা চোখের পানিও ফেলেননি তাদের জন্য। অন্যদিকে ‘সমাজতন্ত্র কিংবা ‘গণতন্ত্র’? তােওবা তােওবা। এ দুটি শব্দ তাে তাঁর কাছে ছিল হারাম। যে আয়ুব খাঁ তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন তার সেই কোল আলাে করে যতদিন ভুট্টো ছিলেন ততদিন তার প্রভুভক্তি ছিল দেখার মতাে।
তবে হ্যা, রাজনীতিক চাতুরিতে যে ভুট্টোর দোসর নেই একথা বলতে হবে না। আয়ুবের রাজত্বের মূল ভিত্তিই ছিল ভারত-বিরােধীতা। আর কি ঘরে কি বাইরে সেই চূড়ান্ত ভারত-বিরােধীতা সবচেয়ে বড় গ্য জাহির করতেন ভুট্টো। কিন্তু … ঘটনাটা দাঁড়াল উল্টো। ভারত-বিরােধীতার জিগির তুলে বেশ পপুলার হওয়া যায় এমন একটা সচেতনতা যখন ভুট্টোর হলাে সেই সময়ে ভুট্টো তার ভারত-বিরােধীতায় খােদ আয়ুব খাকে টেক্কা দিতে আরম্ভ করলেন। জুতাের চেয়ে জুতাের ফিতে বড় হয়ে উঠল। তাশখন্দ চুক্তির পরে ভুট্টো সপ্তমে গলা তুলে বলতে শুরু করলেন যে আয়ুব খাঁ পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং তার ফলে ভারতেরই সুবিধা করে দিয়েছেন। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী যখন নাকি ভেঙে পড়ার মুখে তখন তাশখন্দ চুক্তি তার পুনরুজ্জীবনে সাহার্য করেছে—এ-ছিল ভুট্টোর বক্তব্য। বলা বাহুল্য, এতে ভুট্টো কিছু হাততালিও পেয়েছিলেন এবং গদি ছেড়ে চলে আসার পর দেখা পেল কিছু ফৌজি অফিসার ভুট্টোকে খােলাখুলি সমর্থন জানাচ্ছে।
এবার ভুট্টো নিজের দল গােছাতে আরম্ভ করলেন। ১৯৬৭ সালের হিসেম্বরে তৈরি হলাে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, ভুট্টো, হলেন—চেয়ারম্যান ভুট্টো। সে পার্টির স্লোগান হলাে ইসলাম, ডেমােক্রাসি ও সােশালিজম। এখানে লক্ষণীয় যে আয়ুবের ‘ইসলামিক সােশালিজমের সঙ্গে ভুট্টোর স্লোগানের মূলত তফাত কিছুই ছিল না। বাইরের তফাতটুকু ছিল একমাত্র। ডেমােক্রাসির’ স্লোগান। সেই ডেমােক্রাসির কত বড় প্রবক্তা ভুট্টো সাহেব তা সাক্ষ্য সাম্প্রতিক ইতিহাসই দেবে। ভুট্টো সাহেবকে এবার ভূতে পেল। তার ধারণা হলাে যে এরপর নির্বাচন হলে তিনি নিশ্চিত ক্ষমতালাভে সক্ষম হবেন।
‘দ্য গ্রেট ট্রাজেডি অব পাকিস্তান সম্পর্কে ভুট্টো তাঁর সাম্প্রতিক কিতাবে যে মনের কথা ব্যক্ত করেছেন। তার মন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে ভুট্টো-চরিত্রের এই পটভূমির পর্যালােচনা অত্যাবশ্যক। ক্ষমতা—অপ্রতিহত ক্ষমতা—এই হলাে ভুট্টোর জীবনের লক্ষ্য। সেই ক্ষমতার আচকানে দু-চারটে সােশালিজম কিংবা ডেমোেক্রাসির ছাপওয়ালা রঙীন বােতাম যদি ক্ষমতার জেল্লা বাড়াতে সাহায্য করে। তাহলে ক্ষতি নেই। ভুট্টোর কাছে ‘সামজতন্ত্র’ ও ‘গণতন্ত্রের ব্যবহার ঐটুকু—অর্থাৎ নিজের পপুলারিটিকে বজায় রাখা জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়ে। কিন্তু সর্বসাধারণকে সর্বকালের জন্য বােকা বানানাে যায় না। ‘সমাজতন্ত্র অথবা ‘গণতন্ত্রের’ স্লোগান ভুট্টোকে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিতে পারল না। মুজিবর রহমান হলেন সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা।
এমন বিপর্যয় কেন হলাে? ভুট্টো তার কিতাবে ইনিয়ে বিনিয়ে ঝুরি মিথ্যা কথার আমদানি করে তারই ব্যাখ্যানার চেষ্টা করেছেন। তার দুয়েকটা বচনামৃত শুনতে মন্দ লাগবে না—“বাঙালি জাতীয়তাবাদের মাথায় চড়ে কয়েকবার জেল খাটা বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের মানসিক উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনাকে ভীষণভাবে উসকে দিলেন। দারিদ্রপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তিনি বােঝাতে লাগলেন যে তাদের মুক্তি একমাত্র তার ছ-দফা কর্মসূচিতেই মিলবে। ঘৃণার আবরণ সৃষ্টি করে তিনি তাঁর আসল উদ্দেশ্য আড়াল করে রাখলেন। তাঁর ভাষা ও তাঁর পদ্ধতি সবটাই ছিল ফ্যাসিজমের।”
“সাইক্লোন-বিধ্বস্ত জনগণের বিক্ষোভকে মুজিবুর রহমান নিজের কাজে লাগালেন। বহুদূরে অবস্থিত ইসলামবাদের শাসনকর্তাদের তিনি অকর্মণ্যতা ও নিস্পৃহতার জন্য দোষ দিতে থাকলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে শাসন যন্ত্রের প্রচার বিভাগ এই সমস্ত অভিযােগের উপযুক্ত জবাব দিয়ে উঠতে পারল না।”
মহাগণতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্রী জনাব ভুট্টোর জনসাধারণের জন্য দরদ যে কতখানি তার একটা হদিশ এই লাইনগুলাে থেকে পাওয়া যাবে : “পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ শােষণ থেকে মুক্তি চেয়েছিল। তারা অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিল, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি। আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচনের আগে ও পরে বারবার ছ-দফা কর্মসূচিকে তুলে ধরেছে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার কথা তখনও বলেনি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র জনসাধারণ কিন্তু ছ-দফার মর্মোদ্ধার করতে কোনদিনই পারেনি, এমনকি ছ-দফা যে কী তাও তারা অনেকে জানে না।”
নির্বাচনের পর মুজিবুর রহমানের দাবি ছিল ছ-দফার ভিত্তিতে যে জনগণ ভােট দিয়ে তাকে ও তার দলকে জিতিয়েছে সেই ছ-দফাই হবে পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও সংবিধানের মূল ভিত্তি। ভুট্টো কিন্তু এর কোন অর্থ খুঁজে পান না। ভুট্টোর মতে, সেদিন মুজিবুর যদি তাঁর ছ-দফার দাবি নিয়ে অত একগুঁয়েমি না করতেন তাহলে এখন স্বয়ং তিনিই তাে সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। মুজিবুর রহমান এমন ‘ভুল’ কেন করলেন? ভুট্টো বলেন “এর জন্য তাঁর রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের পটভূমির আলােচনা দরকার। তাঁর শিক্ষা ও তার চরিত্রের বিশ্লেষণ দরকার।” বেচারা ভুট্টো। তিনি এখন বুঝতে পারছেন না মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোতে কী তফাত। তাই মুজিব কেন আপসরফায় গেলেন না সেটা। তার কাছে এখনও বিস্ময়। মুজিবের ছ-দফা যে সত্যিই বাঙলাদেশের জনগণের মনের কথা, এটা যতক্ষণ না ভুট্টো উপলব্ধি করতে পারবেন ততক্ষণ তিনি এ ধাঁধার অর্থ করতে পারবেন না।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে এর পরবর্তী ঘটনা এবং সে ক্ষেত্রে ভুট্টো পার্টির ভূমিকা আজ আর কারাে তার কাছেই অজানা নয়। ভুট্টো যতই বাকচাতুর্যে তার আসল ভূমিকাকে চাপা দেবার চেষ্টা করুন না কেন, তার কিভাবে থেকে একথা স্পষ্ট বেরিয়ে এসেছে যে তিনি যদি ক্ষমতার ভাগ পেতেন অর্থাৎ তাকে যদি ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত করা হত, তাহলে তিনি হয়তাে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সম্মত হতেন।
গােড়ার দিকে ভুট্টো তার দল ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কোয়ালিশন চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন দুই পাকিস্তানে দুই পার্টি ক্ষমতায় আসবে। এর ভিত্তিতে তিনি জাতীয় পরিষদের সভা ডাকায় সম্মতি দিলেন গােড়ার দিকে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলেন যে একবার জাতীয় পরিষদের সভা ডাকলে পশ্চিমেরও অনেক দল মুজিবকে সমর্থন করবে, তখন তার ক্ষমতালাভের কোন নিশ্চয়তা থাকবে না। সুতরাং তখন থেকেই ভুট্টো জাতীয় পরিষদ বৈঠক বানচাল করে দিতে বদ্ধপরিকর হলেন।
ভুট্টোর কিতাব থেকে একথাও স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে পঁচিশে মার্চ যে বাঙলাদেশে সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ শুরু হবে একথ্য তিনি জানতেন। সেই কারণেই সামরিক আইনের’ একগাদা প্রশন্তি পেয়েছেন জনাব ভুট্টো তাঁর কিতাবে।
এর পরের ঘটনা সকলেরই জানা। কিন্তু যে ঘটনা অনেকেরই জানা নেই তা হলাে এর পর থেকে ভুট্টো বাঙলাদেশের জনগণের সংগ্রাম দমনে সামরিক শাসকচক্রের আক্রমণের পিছনে সর্বৈব মদত দিয়ে গেছেন। এ কিতাব সেই সত্যকে নির্মমভাবে উদ্ঘাটিত করেছে।

সূত্র: সপ্তাহ, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!