কালান্তর পত্রিকা
১৭ এপ্রিল, ১৯৭১
স্বাধীনতা সংগ্রামী বাংলাদেশের পাশে পশ্চিম বাংলা
কমল সমাজদ্বার
আমি দিয়েছিবাংলাদেশের জনগণের উপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁনের সৈন্য বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের সংবাদে পশ্চিম বাংলার মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। কেবলমাত্র বাংলাদেশের পাশে পশ্চিমবাংলা অবস্থিত বলেই নয় বা এই দেশের জনগণের আত্মীয়-পরিজন বাংলাদেশে আছেন বলেই নয়- এই দেশের জনগণ বিগত কয়েক বছর ধরে সানন্দ বিস্ময়ে পূর্ব বাংলার জনগণের সর্বতোমুখীন জনগণের বিকাশ লক্ষ্য করছিলেন। সে দেশের মানুষ সে দেশের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে ব্যাপক উজ্জীবন পশ্চিম বাংলার মানুষের নিবিড় কৌতুহলের বিষয় হয়ে উঠেছিল। তাই সে দেশের মানুষের উপর ফৌজি শাসনের মদমত্ত অত্যাচারের পশ্চিম বাংলার মানুষ স্থির থাকতে পারেনি।
পঁচিশে মার্চের সেই কাল রাতের পর প্রায় এক পক্ষকাল অতিবাহিত হয়ে গেল। এই সময়ের মধ্যে অসংখ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে পশ্চিম বাংলার মানুষ সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে। কয়েকটি কমিটি গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে সর্বতোমুখী সাহায্যের জন্য।
বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার ফৌজবাহিনীর আক্রমণের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরই কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষে শ্রী বিশ্বনাথ মুখার্জী এক বিবৃতি মারফত সভা সমাবেশ মিছিল করে বাংলাদেশের স্বাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামের প্রতি সৌভ্রাতৃত্ব জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে পশ্চিম বাংলার মানুষের প্রতি আহবান জানান।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন, ডি এস ও, ছাত্র পরিষদ (নব কংগ্রেস) প্রভৃতি ছাত্র সংগঠনগুলির আহবানে গত ২৭ মার্চ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক সর্বাত্মক হরতাল হয়। এদিনেই পশ্চিমবঙ্গ যুব সংঘ ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন বাংলাদেশ-এর ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতি আন্তরিক সংহতি জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ষ্টুডেন্টস হলে এক যুব ছাত্র সমাবেশ আহবান করেন এবং সমাবেশের পরে এক যুব ছাত্র মিছিল কলকাতার বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতি রক্তিম অভিবাদন জানান।
বি পি টি ইউ সি-র সম্পাদক শ্রী ভবানী রায় চৌধুরী ও টি এন সিদ্ধান্ত এক বিবৃতিতে বলেনঃ বাংলাদেশের মানুষের উপর বিনা প্ররোচনায় যে পাশব সামরিক হামলা শুরু হয়েছে বি পি টি ইউ সি তার বিরুদ্ধে তীব্র ক্রোধ প্রকাশ করেছে। এ বি টি এ কো-অর্ডিনেশন কমিটি এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে বিপ্লবী অভিনন্দন জানান। জীবনবীমা কর্মচারী সমিতি (পূর্বাঞ্চল) যুগ্ম সম্পাদক শ্রী সুকুমার মুখার্জী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সমর্থনে এক বিবৃতি দেন।
গত ২৮ মার্চ শহীদ মিনার ময়দানে এক বহুদলীয় সমাবেশে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের প্রতি পূর্ণ সংহতি জানিয়ে এই প্রত্যয় ঘোষণা করা হয় যে, সামরিক স্বৈরাচারের নৃশংস নিপীড়ন প্রতিহত করে অনতিবিলম্বেই পূর্ব বাংলার মৃত্যূঞ্জয়ী জনগণ সার্বিক স্বাধিকার অর্জন করবেন। রাজ্য বন কংগ্রেস সভাপতি সিং নাহার- এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি বক্তৃতা দেন।
শ্রী তারা শঙ্কর বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিকবৃন্দ এক বিবৃতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে বাংলার জনগণের উপর মিলিটারী আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ ঘোষনা করেন ও এই নৃশংসতার নিন্দা করে প্রতিরোধের বিষয়ে যথোচিত কর্তব্য পালনে দাবী জানান।
ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটি এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গণতান্ত্রিকতার নকল মুখোশ খুলে পড়েছে।
কলকাতা পৌরসভার গত ২৬ মার্চের সাপ্তাহিক অধিবেশনে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষদের সমর্থনে এক সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়।
ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া কর্মচারী সমিতির পাক সার্কাস শাখা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক তারবার্তা পাঠিয়ে বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলনে সর্বপ্রকার সাহায্যের দাবি জানান।
গত ২৭ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের বাৎসরিক সভায় পূর্ব বাংলায় স্বৈরাচারী অত্যাচারের প্রতি ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়।
গত ৩১ মার্চ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণমুক্তি সংগ্রামের প্রতি আন্তরিক সংহতি ও পাকিস্তানের সামরিক বর্বরতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গে অভূতপূর্ব বন্ধ পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের সকল রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের ডাকে পশ্চিমবঙ্গে এই ২৪ ঘন্টাব্যাপী হরতালে রাজ্যের জনসাধারণ অভূতপূর্বভাবে সাড়া দেন।
আন্তর্জাতিক, পরিচয়, আফ্রো-এশীয় সংহতি ও পশ্চিমবঙ্গ শান্তি সংসদের উদ্যোগে গত ৩০ মার্চ স্টুডেন্টস হলে অনুষ্ঠিত এক মহতী সমাবেশে শ্রী নিরেস চক্রবর্তী সভাপতিত্ব করেন এবং এক সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের যাবতীয় সাহায্যের জন্য চাপ সৃষ্টি ও সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির কথা বলা হয়।
ইউনিভার্সিটি ইনষ্টিটিউট হলে গত ২৯ মার্চ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবিদের এক বিরাট সমাবেশে অন্নদাশঙ্কর রায়, বিবেকানন্দ মুখার্জী, অম্লান দত্ত, মৈত্রয়ী দেবী, ইলা মিত্র প্রমুখ ভাষণ দেন।
স্কটিশ চার্চ কলেজে ও সেন্ট পলস কলেজের ছাত্র ছাত্রী ও অধ্যাপকদের সভায় বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধাদের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
দক্ষিণ কলকাতার পাঠভবন, সাউথ পয়েন্ট, সত্যভামা, জগবন্ধু প্রভৃতি স্কুলের ছাত্ররা গত ৩১ মার্চ ধর্মঘটের পর পাক হাই কমিশনের অফিসে মিছিল করে যান ও সেখানে এক স্মারকলিপি পেশ করেন।
কোন্নগর পৌরসভার গত ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি অভিনন্দন জানান।
বঙ্গীয় স্বর্ণশীল্পী সমিতির অন্যতম সম্পাদক শ্রী নির্মল দত্ত ও মেটাল বক্স ওয়াকার্স তাদের বিবৃতি মারফৎ বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে অভিনন্দন জানান।
ভারতীয় গণসংস্কৃতি সংঘের সভাপতি শ্রী দিগিন বন্দোপাধ্যায় ও সম্পাদক শ্রী অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য এক বিবৃতিতে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সমবেতভাবে বাংলাদেশের জঙ্গীশাহীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আহবান করা হয়।
৩১ মার্চ বারাসতে বাংলাদেশে সংগ্রামের শেঠপুকুর ময়দানে এক বিরাট জনসভায় সর্বশ্রী সুনীল বসু (সি পি আই), অরবিন্দ দাশগুপ্ত (শাসক কংগ্রেস) ভাষণ দেন।
ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির আহবানে ১ এপ্রিল ভারত সভা হলে অনুষ্ঠিত এক মহিলা সভায় পূর্ব বাংলার ভাই-বোনেরা আত্মত্যাগের জ্বলন্ত নিদর্শনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। সভায় সভানেত্রি ছিলেন ডঃ রমা চৌধুরী ও ভাষণ দেন শ্রীমতি গীতা মুখার্জী, অপর্ণা ব্যানার্জী, ইলা মিত্র, অরুণা মুন্সী, কমলা মুখার্জী, মায়া দাস, এবং শ্রীমতি মীরা দত্তগুপ্তা। বাংলাদেশের একজন মুক্তি সংগ্রামীও সভায় ভাষন দেন।
পশ্চিমবঙ্গ সাব-অর্ডিনেয়াত কো-অপারেটিভ এমপ্লোয়িজ এসোসিয়েশন ও পশ্চিমবঙ্গ মৎসজীবি সমিতি বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর ইয়াহিয়ার অমানুষিক অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করেন।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা বাংলাদেশে জনগণের উপর পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর অত্যাচারের প্রতিবাদে কলকাতার পাক ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ দেখান। এছাড়া আই এম এ হলে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সাহায্যার্থে এক রক্তদান কেন্দ্র খোলা হয় ও গত ২ এপ্রিল এম এ সভ্য রা প্রথম কিস্তিতে রক্তদান করেন।
ট্রাম শ্রমিকদের যুক্ত কমিটি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারী কর্মচারী সমিতিসমূহের অস্থায়ী যুক্ত কমিটি, পেট্রোলিয়াম ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, এন্ড্রু, ইউল কোং কর্মচারী সমিতি, ইউ বি আই এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন, বেঙ্গল মোশান পিকচার্স এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী জনগণকে অভিনন্দন জানান।
খড়গপুর থানায় গত ৩১ মার্চ কৃষক সমাবেশে বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহবান জানান।
দমদমে ও পানিহাটীতে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে ৩১ মার্চ বিরাট মিছিল বের হয়।
যাদবপুর বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে সর্বদলীয় জনসভা ও কুলটীতে এক সর্বদলীয় যুক্ত মিছিল বের হয়।
যুবক লেখক সংস্থার উদ্যোগে স্টুডেন্টস হলের জনসভা থেকে ইয়াহিয়ার বর্বরতাকে তীব্র ধিক্কার জানানো হয়।
সাউথ সুবার্বন পৌরসভা ও সিটি কলেজের ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের যুক্ত সভা তাদের নিজ নিজ প্রস্তাব মারফৎ মুক্তিকামী বাংলাদেশের মানুষদের অভিনন্দন জানান।
পথিকৃৎ ও ডি ওয়াই ও-র উদ্যোগে গত ৩ এপ্রিল এক বিক্ষোভ মিছিল পাক হাইকমিশনার দপ্তরে যায়।