পূর্ব বাংলার গণ-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা
গত ২৩ মার্চ আগরতলা থেকে ত্রিপুরা রাজ্য ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষে সুভাষ চক্রবর্তী, ভূপতি ভৌমিক, রতন ভদ্র ও কৃষ্ণ রায় চট্টগ্রাম যান এবং ৪ এপ্রিল সেখান থেকে তারা যে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসেন, পূর্ব বাংলায় থেকে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তা সংক্ষিপ্তভাবে দেয়া হলাে:
৩ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত রাখার ঘােষণার ফলে সারা পূর্ব বাংলার মানুষ এক ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের গণসংগ্রামের সূচনা করেন। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের নির্দেশে সরকারি এবং বেসরকারি সমস্ত প্রকার কাজ-কর্ম চলতে থাকে। গত ২৪ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সামরিক নায়ক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। ঐদিন মধ্যরাতে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার জনসাধারণকে হত্যা করে। চট্টগ্রামেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত কারখানা অঞ্চলে বস্তির মধ্যে ঘুমন্ত শ্রমিকদের মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে। এই অতর্কিত আক্রমণের প্রথমাবস্থায় জনসাধারণ নির্বিচারে মৃত্যুবরণ করলেও পরবর্তী সময় সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে গঠিত মুক্তিফৌজ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হেনে শহরের একটা অঞ্চলে কোণঠাসা করে রাখতে সমর্থ হন এবং চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করে সেটাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন। অবশ্য সামরিক বাহিনী কালুরঘাটে অবস্থিত বেতার কেন্দ্রের টাওয়ারে বিমান থেকে বােমা ফেলে ক্ষগ্রিস্ত করে। বর্তমানে তাই ঐ বেতার কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে।
সামরিক বাহিনীর সমস্ত প্রকার রসদ সরবরাহ, জল সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ঢাকা অভিমুখে রেল পথটির ফিস প্লেট অপসারিত করে এবং অনেক ব্রিজ ধ্বংস করে সৈন্য চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। মুক্তিফৌজ শহরের চারদিকে প্রতিরােধ করে সৈন্যদের গ্রামে প্রবেশের প্রচেষ্টা প্রতিহত করে এবং বর্তমানে গ্রাম থেকে শহর দখল করার প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন। মুক্তিফৌজের দখলে আছে বর্তমানে কক্সবাজার শহর, চট্টগ্রামের শহরতলীর কিছু অংশসহ বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল। এই সমস্ত মুক্ত এলাকায় অনেকগুলাে কমিটির মাধ্যমে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, কালোবাজারি বন্ধ করা ইত্যাদি কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছেন। প্রতিনিধি দল ৮০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে এসে ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছান। পূর্ব বাংলার প্রতিটি মানুষ আজ যে কোনাে মূল্যে তাদের এই সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ এবং তারা বিশ্বের সমস্ত জনসাধারণের কাছে তাদেরকে সাহায্য করার আবেদন জানিয়েছেন।
গত ৫ এপ্রিল আগরতলা থেকে একদল প্রতিনিধি আখাউড়া বাজারে গিয়ে সেখানকার মুক্তিফৌজের সভাপতি জনাব শহীদুর রহমান এবং অন্য একজন নেতা আবুল হােসেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের কাছ থেকে সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে এক বৈঠকে মিলিত হন।
বর্তমানে সেখানে নিজেদের সরকার সমস্ত প্রকার কাজকর্ম পরিচালনা করছেন এবং মােগরা ও তিস্তা ব্রিজ ধ্বংস করে সামরিক বাহিনীর পথ রােধের ব্যবস্থা করেছেন। তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যেতে গেলে যে সমস্ত উপকরণ প্রয়ােজন তা দিয়ে সাহায্য করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। উক্ত নেতাদ্বয় দেহের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে এই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা দৃঢ়তার সাথে ঘােষণা করেন। বর্তমানে ফ্যাসিস্ট সামরিক বাহিনী শুধু শহরগুলােকেই দখলে রাখতে পেরেছে তাই বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল থেকে শত্রুর শেষ চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য প্রবল প্রস্তুতি চলছে। তারা ভারতের সাধারণ মেহনতি মানুষের কাছ থেকে যে সহানুভূতি ও সাহায্য পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন তার জন্য মুক্তিফৌজের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সূত্র: দেশের ডাক
০৯ এপ্রিল, ১৯৭১
২৬ চৈত্র, ১৩৭৭